শাহবাগ শিশু পার্কের অদূরে রমনা উদ্যানে তালাবদ্ধ প্রবেশ গেটে ‘করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে রমনা পার্কে প্রবেশ নিষেধ, আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ’ সাদা কাগজে কালো রঙয়ে বড় বড় অক্ষরে লেমিনেটিং করা একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। ভেতরে রাস্তা দখল করে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে একটি কুকুর। পার্কের ভেতরে দু’একজন নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া কেউ নেই। ভোর হয়েছে বেশ কিছুটা সময় আগেই। কিন্তু সূর্যিমামার দেখা নেই। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যেন নীরবে কান্না করছে। যুগ যুগ ধরে বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রভাতেই রমনার বটমূলে প্রভাতী আয়োজন ‘ছায়ানট’ এর সরোদবাদন দিয়ে বর্ষবরণ করে নিতে কেউ নেই। রমনা বটমূলের চৌহদ্দিজুড়ে সুনসান নীরবতা। জনশূন্য এ রমনা বটমূল একেবারেই অচেনা। বিবর্ণ নববর্ষের ভোর, যা দেখে অভ্যস্ত নয় বাঙালি জাতি।
Advertisement
আজ মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) বাংলা নববর্ষ ১৪২৭ এর প্রথম দিন। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে কাকডাকা ভোর থেকে রমনা উদ্যান অভিমুখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে নতুন রঙিন পোশাক পরে রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষকে বরণ নেয়ার শুভ সূচনা করেন তারা। উপস্থিত সকলের মুখে উচ্চারিত হয় ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’।
কিন্তু এ বছর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মারাত্মক ধরনের সংক্রামক ব্যাধি করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে সরকারিভাবে জনসমাগম ঘটিয়ে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার সকল ধরনের অনুষ্ঠান পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। নববর্ষ উপলক্ষে গতকাল ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বৈশ্বিক দুযোর্গ করোনা পরিস্থিতির কারণে সবাইকে ঘরে বসে নববর্ষ পালনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ডিজিটালি বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে ‘উৎসব নয়, সময় এখন দুর্যোগ প্রতিরোধের’- এ প্রতিপাদ্যে এ বর্ষবরণের আয়োজন করা হয়েছে৷ ফলে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ মঙ্গলশোভাযাত্রা বের হবে না। শাহবাগ থেকে পল্টন মোড়, শেরাটন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে বাংলা একাডেমি ও কার্জন হল পর্যন্ত বৈশাখের মেলা বসবে না। থাকবে না পান্তা ইলিশের আয়োজন। শিশুদের কাঁধে নিয়ে বাবা-মায়েদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যাবে না।
Advertisement
প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদফতর, আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদফতর, জাতীয় জাদুঘর, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, কপিরাইট অফিস, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বিসিক নববর্ষ মেলা, আলোচনা সভা, প্রদর্শনী, কুইজ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে থাকলেও এবার নেই। পহেলা বৈশাখের নিরাপত্তা দিতে পুলিশকে এবার দিনভর ঘাম ঝরাতে হবে না, মানুষের স্রোত সামাল দিতে খেতে হবে না হিমশিম।
জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক আজ কাকডাকা ভোর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ ও রমনা উদ্যানের আশেপাশে সরেজমিন পরিদর্শনকালে রাস্তাঘাটে হাতেগোনা কিছু শ্রমজীবী মানুষ ছাড়া কাউকে দেখতে পাননি। রমনা উদ্যানের সবকটি গেটে তালা ঝুলছে।
নিরাপত্তারক্ষী জানান, ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে। বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে শাহবাগের ফুলের মার্কেটটি প্রতি বছর জমজমাট থাকলেও আজ সব দোকান বন্ধ। এরপরও দু’একজন দোকানিকে গোলাপ ফুল নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়।
ভোরের দিকে রাস্তায় ট্রাফিকসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কাউকেই দেখা যায়নি। সকাল ৭টার দিকে এ প্রতিবেদক যখন রমনা বটমূলের সামনে থেকে চলে আসছিলেন তখনও পর্যন্ত সূর্যিমামা লুকিযে ছিলেন মেঘের আড়ালে। এ যেন বাঙালি জাতির বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে না পারার সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ!
Advertisement
এমইউ/এসএইচএস/এমকেএইচ