করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সরকার দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষকদের বেতন না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আংশিক বেতন দিচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
Advertisement
রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, ছুটিতে বাড়িতে বসেও অনলাইনে পাঠদান, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন ও ফলাফল তৈরির কাজ করেও বেতন পাচ্ছেন না তারা। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করতে না পারা ও নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ থাকায় শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মার্চ মাসের পূর্ণ বেতন পরিশোধ করেছে। এর কয়েকটি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শিক্ষকদের বেতন দিয়েছে। তবে এ সংখ্যাটা খুবই কম। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষকদের আংশিক বেতন পরিশোধ করেছে। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয় বেতন বাবদ কোনো অর্থই পরিশোধ করেনি শিক্ষকদের।
জানা গেছে, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি তার শিক্ষকদের এখনো মার্চের বেতন পরিশোধ করেনি। এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সর্বমোট শিক্ষক রয়েছেন ২৫০ জন। এর মধ্যে অস্থায়ী ও খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছেন ৭৩ জন। যদিও স্থায়ী ও অস্থায়ী কোনো শিক্ষকেরই মার্চ মাসের প্রাপ্য বেতন পরিশোধ করেনি এ বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ না করার বিষয়টি স্বীকার করেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ও গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
Advertisement
তিনি বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি জমা নিতে পারিনি। নতুন শিক্ষার্থী ভর্তিও বন্ধ রয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলেও অনেক শিক্ষার্থী ফিরে আসবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের চার শতাধিক বিদেশি শিক্ষার্থী ছিল, তাদের বেশির ভাগ চলে গেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের দেয়া টিউশন ফি’র টাকায় চলে। তাদের কাছ থেকে টাকা না পাওয়ায় শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।
অন্যদিকে শিক্ষকদের বেতন হয়নি ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিরও। বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, করোনার এ সংকটের কারণে গত এক মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এমন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে অনলাইনে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, ভর্তি কার্যক্রম শুরু হলে সবার বেতন পরিশোধ করা হবে। এ জন্য লিখিতভাবে শিক্ষামন্ত্রী ও ইউজিসি চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
শিক্ষকদের আংশিক বেতন পরিশোধ করেছে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রায় এক হাজার শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষক ভেদে ৩০-৪০ শতাংশ হারে কম বেতন পরিশোধ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ সংকটে রয়েছে, তারা বেতন কম দিলে একটা যুক্তি থাকত। কিন্তু ড্যাফোডিলের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেক বেশি। তারা ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে আমাদের বেতন কম দিয়েছে। যদি মানবিক ও নৈতিক দিক থেকে চিন্তা করত, তাহলে পূর্ণ বেতন পরিশোধ করত।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, একদিকে বেতন কম দিচ্ছে, অন্যদিকে কাজের চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনলাইনে ক্লাস নিতে হচ্ছে। ১৫ এপ্রিলের মধ্যে গত সেমিস্টারের ফল জমা দিতে বলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তবে অবস্থার উন্নতি ঘটলে শিক্ষকদের বেতন সমন্বয় হবে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়টির মুখপাত্র ও স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা দুর্যোগকালের জন্য একটি কমিটি করেছি। সে কমিটি ডিন ও বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সম্মতি নিয়ে বেতনের বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শিক্ষকদের আংশিক বেতন দিয়েছে উত্তরা ইউনিভার্সিটি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষক সংখ্যা ২৭৯। এর মধ্যে অস্থায়ী ভিত্তিতে চুক্তি ভিত্তিক রয়েছেন ৭২ জন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অন্য সময় মাসের প্রথম দিন বেতন পরিশোধ করা হলেও মার্চ মাসের বেতন পরিশোধ করেছে গত ৮ এপ্রিল। সব শিক্ষককে মাত্র ২৫ হাজার টাকা করে বেতন দিয়ে পরবর্তী সময়ে সমন্বয় করা হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যাদের বেতন ৩৫ হাজার তাদেরও ২৫ হাজার দেয়া হয়েছে। আবার যাদের বেতন ৫০ হাজার, তাদেরও ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ বেগম বলেন, আসলে আর্থিক সংকটের কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমরা তাদের বলেছি, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা অবশ্যই সমন্বয় করে দেব। আসলে সিনিয়র শিক্ষকদের অনেক টাকা বেতন, এত অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে না থাকায় এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।
শিক্ষকদের বেতন না দেয়া বা কমিয়ে দেয়াকে অন্যায় ও অমানবিক উল্লেখ করে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের পূর্ণ বেতন পরিশোধ ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্রিম বেতন দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে শিক্ষকদের মতো পেশাজীবীদের বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে কয়েকজন শিক্ষক মৌখিকভাবে আমাদের কাছে তাদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন। বন্ধের সময়ে শুধু অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম করতে বলা হলেও অনেকে নতুন ভর্তি ও পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভর্তি বা পরীক্ষ নেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হলেও তা নাকজ করে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের দায়িত্বশীল ও মানবিক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ইউজিসি চেয়ারম্যান।
এমএইচএম/এমএফ/জেআইএম