ফিচার

লকডাউনে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে যা করবেন

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন

Advertisement

বিশ্বব্যাপী মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাসের ফলে মানুষ গৃহবন্দি। বারবার লকডাউন বা গৃহবন্দি থাকার সময় বাড়ছে। এখনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রত্যাশিত সুখবর নেই পৃথিবীর কাছে। বাংলাদেশ সরকার ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও ইতোমধ্যে দুই বার ছুটি বাড়ানো হয়েছে।

ফলে গৃহবন্দি থাকার সময় বাড়ছে। ইতোমধ্যে সন্ধ্যার পর কেউ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এভাবে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি থাকার ফলে মানুষগুলোর মধ্যে নানা মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে সতর্ক থাকতে বলেছে। মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে শুধু গৃহবন্দি মানুষ বা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানুষ নয়; আছেন কর্তব্যরত ডাক্তার, সেবাকর্মী ও নিরাপত্তা কর্মীরাও।

যে ধরনের ঝুঁকি: মানুষের মধ্যে মানসিক বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে মূলত ভয় ও আতঙ্ক থেকে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন নতুন নতুন আক্রান্ত ও রোগীর মৃত্যুর খবর মানুষকে আরও বেশি ভীত করে তুলতে পারে। মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা ও হতাশা দেখা দেবে। এছাড়া অনেকের মাঝে আগামী দিনের আর্থিক নিরাপত্তা ও চাকরি হারানোর ভয় চলে আসতে পারে। বিচ্ছিন্নতা মানুষের মধ্যে একাকিত্ববোধ তৈরি করবে।

Advertisement

আরেকটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভ্রান্তিকর খবর ও নানাভাবে ছড়িয়ে পড়া গুজব। বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া অসত্য, অর্ধসত্য খবর দেখে অনেকে বিভ্রান্ত ও ভীত হয়ে পড়ছেন। করোনা নিয়ে গুজব ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভ্রান্তিকর তথ্য মানুষকে অযৌক্তিকভাবে ভীত করছে। ফলে পরিবারের সাথে থাকার পরও মানুষের মধ্যে হতাশা, ভয়, রাগ, অনিদ্রা ও অরুচির মতো সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

দ্য ল্যানসেট জার্নাল বলছে, হতাশা, মানসিক চাপ, অল্পতে রেগে যাওয়া, অনিদ্রা, বিরক্তিভাব মানুষকে মানসিকভাবে আরও দুর্বল করে ফেলতে পারে। মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও কমিয়ে ফেলে।

সুস্থ থাকতে যা করবেন: প্রথমেই নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব দরকার। সামাজিক দূরত্ব নয়। সামাজিক দূরত্ব শব্দটি আমাদের ভুল বার্তা দিচ্ছে। ফলে আমাদের বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। বিচ্ছিন্নতা কমাতে মোবাইল বা অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ ও খোঁজ-খবর নেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে।

পরিবারকে সময় দেওয়া দরকার। বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। যেহেতু করোনাভাইরাসে বয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যুর হার বেশি। ফলে বয়স্কদের মৃত্যু ভয় দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। শিশুদের স্কুল বন্ধ। তারা জানে না, কেন এমন হচ্ছে। ফলে তাদের সময় দেওয়ার পাশাপাশি গল্প বলা, ছবি আঁকা বা বিনোদনমূলক সময় পার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে টিভি চ্যানেলগুলো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারে।

Advertisement

করোনা নিয়ে কোনো ধরনের আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক খবর জানা জরুরি। অসত্য, অপূর্ণাঙ্গ খবর এড়িয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা আইইডিসিআরের ওয়েবসাইট থেকে করোনা সম্পর্কে তথ্য জেনে সচেতন হতে হবে। সেই সাথে জরুরি কাজে বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করা ও সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।

গৃহবন্দি সময়ে অনিদ্রার মতো সমস্যা বেশ প্রকট হতে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত ঘুমানো ও কম ঘুমানো দু’টাই শরীর ও মনের জন্য ক্ষতিকর। এ পরিস্থিতি এড়াতে ডাক্তাররা বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। প্রথম বাসায় বা ছাদে (শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে) দিনের কিছু সময় হাঁটা চলা করা। দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠা। সেই সাথে দিনে অন্তত একবার গোসল করতে হবে। ফলে মন ও শরীর ফুরফুরে থাকবে।

বিষণ্নতা বাদ দিতে অপ্রয়োজনীয় চিন্তা বাদ দিতে হবে। নিজেকে দিনভর সচল রাখুন, নীতিবাচক চিন্তা বাদ দিয়ে গান শোনা, বই পড়া, ছবি আঁকা বা বাগান করার কাজে সময় দিন। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে পানি পান ও সুষম খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।

অল্পতে রেগে যাওয়া ও বিরক্তিভাব এলে হাতের আঙুলে ১-১০ পর্যন্ত গোনা চর্চা করুন। ইউগা বা অন্যান্য ব্যায়াম করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ইউটিউবের ভিডিও সহযোগিতা করবে। যেহেতু মসজিদ ও অন্যান্য প্রার্থনালয় বন্ধ। ফলে বাড়িতে বসে বসে নামাজ, প্রার্থনা বা ধ্যান করতে পারেন। সকাল বেলা উঠে নিঃশ্বাস ধরে রেখে শ্বাস নেওয়ার চর্চা করতে পারেন।

ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ধরনের উদ্বিগ্নতা তৈরি হলে নিজের যত্ন নিন। নিজের ভালো অর্জনগুলোর কথা ভাবুন। সেই সাথে আগামী দিনের স্বপ্নগুলোকে কল্পনা করুন। ভিজ্যুয়াল ড্রিম আপনাকে আশাবাদী রাখবে। তবে নিজেদের যেকোনো মানসিক সমস্যা প্রকট হলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিতে পারেন টেলি-ডাক্তারের।

সব শেষে ডাক্তার, সেবাকর্মী, প্রশাসক ও নেতাদেরও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সজাগ হওয়া উচিত। জার্মানির একটি স্টেটের অর্থমন্ত্রীর আত্মহত্যা আসলে একটি অশনি সংকেত। ডাক্তাররা পিপিই পরে প্রতিদিন রোগী দেখছেন। অনেক ডাক্তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। প্রতিদিন চোখের সামনে আর্তনাদ ও অসহায় মৃত্যু দেখছেন। তাই ডাক্তারদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে শিফট ভিত্তিক কাজ ভাগ করে দেওয়া যেতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমএস