মৃত্যু-ভয়-আতঙ্ক। সব মিলিয়ে এক দমবন্ধ অবস্থা। সেটা গোটা বিশ্বজুড়ে। দমচাপা ভাবটা বাড়ছে দিনে দিনে। যেমন গুণে গুণে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। লকডাউন হচ্ছে একের পর এক দেশ। অঞ্চল। গোটা পৃথিবী প্রায় এখন লকডাউন। তার মধ্যে মৃত্যুর মিছিলে পাল্লা দিচ্ছে এক দেশকে আরেক দেশ! সবাইকে ছাপিয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ। বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অর্থ-অস্ত্র সবকিছুই মার্কিনিদের কাছেও নিরর্থক হয়ে দাঁড়াচ্ছে! সেটা কোভিড নাইনটিনের কারণে। করোনা আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা আজ যেন পৃথিবী হারিয়ে ফেলেছে।
Advertisement
শুধু ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়। আক্রান্ত চীন থেকে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সবাই। কার ঘরে আগুন বেশি লেগেছে, কোথায় দাউ দাউ করে আগুনটা বেশি জ্বলছে বিষয়টা মোটেও সে রকম নয়। আগুন লাগলেও দেখা যায়। কিন্তু করোনার এই আক্রমণ অদৃশ্য। শুধু দৃশ্যমান হচ্ছে সংক্রমণ। দেখা যাচ্ছে করোনার আঘাতে মানুষের মৃত্যু।
কিন্তু এ কেমন মৃত্যু! যে মৃত্যুর সময় প্রিয়জনকেও পাশে পাওয়া যাচ্ছে না। যে মৃত্যুর পর আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব কেউ দুফোটা চোখের জল ফেলতে আসতে পারছেন না! অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে পারছেন না! পৃথিবী কি প্রতিদিন মানুষের এমন মৃত্যু এর আগে কখনো দেখেছে? কত যুদ্ধ, কত মহামারি এই পৃথিবীতে হয়েছে, কিন্তু এ রকম মহামারি কি দেখা দিয়েছে।
সংখ্যাতত্ত্বে করোনা কেড়ে নিয়েছে এখন অব্দি লাখ মানুষের প্রাণ। কিন্তু এর আগে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণাও সহ্য করেছে পৃথিবী। তবে এতটা অসহায় কী ছিল সেই সময়ের পৃথিবী এবং তার মানুষ। যে অসহায়ত্ব এনে দিয়েছে করোনা।
Advertisement
করোনা মানবসভ্যতাকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিয়ে যাচ্ছে। যে চিকিৎসক একজন রোগীর কাছে জীবন ফিরিয়ে দেয়া দেবদূতের মতো, করোনা কেড়ে নিচ্ছে সেই চিকিৎসকের জীবন। করোনাভাইরাস এখনো প্রতিরোধহীন, প্রতিকারহীন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। দেশে দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী, কর্মকর্তারা শুধু প্রতিদিন আক্রান্ত, মৃত আর সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের হিসাব মেলাচ্ছেন। গণমাধ্যমের সামনে এসে সংখ্যাগুলো বলে যাচ্ছেন! আসলে তারাও নিরুপায়। নিরুপায় গণমাধ্যমকর্মীরাও। সেই মৃত্যের সংখ্যা, আক্রান্ত্রের সংখ্যা জানাচ্ছেন, তারা পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে। তারাও আক্রান্ত হচ্ছেন। ভয় পাচ্ছেন।
চিকিৎসক চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন! সাময়িকভাবে বরখাস্ত হচ্ছেন। আসলে সেও বাঁচতে চাইছেন পালিয়ে! আবার উল্টো চিত্রও আছে। চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু জীবন তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে খ্যাতি-প্রতিপত্তির অন্য কোনো বন্দরে। বিপন্ন মানবতার পাশে ছুটে আসতে দ্বিতীয়বার ভাবছেন না সেই পুরোনো দিনে পড়া চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্ঞান নিয়ে মানবসেবায়। এমন অনেককেও দেখা যাচ্ছে। নিজের দেশে মৃত্যুর সংখ্যা যখন বাড়ছে, ঠিক সেই সময় করোনার মাঝেও রাজনীতি-কূটনীতি খুঁজে পাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নাকি চীনের দিকে ঝুঁকে আছে। পক্ষপাতিত্ব করছে। অতএব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছেন ডোনাল্ড জে ট্রাম্প!
আজকের লড়াইটা কোনো একটা দেশের নয়। গোটা পৃথিবীর। যে যুদ্ধে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে যাওয়া উচিত, সেই সময় বিভেদের সাইরেন বাজাচ্ছেন ট্রাম্প। যা আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ট্রাম্প-পুতিন-কিম-জনসন-মোদি-ইমরান পৃথিবীর সব দেশের সরকারপ্রধানের কণ্ঠে থাকার কথা ঐক্যের সুর। সেটা বেসুরা লাগছে! বিপন্ন মানবতার জন্য আরও বিপজ্জনক সেটা।
করোনায় মানুষ মরছে। লকডাউনে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করছে অন্যদের জীবন। ভেঙে পড়ছে দেশে দেশে অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তবু লড়াই চালিয়ে যেতে হবে অদৃশ্য এই শত্রুর বিপক্ষে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এ রকম সময় নিজের চারপাশেও দেখছি অন্যায়, অনিয়ম। বাংলাদেশ সরকার যখন করোনা মোকাবিলায় গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াছে ত্রাণসাহায্য নিয়ে, আহ্বান জানাচ্ছে বিত্তবানদের কাছে সাহায্যের জন্য, তখন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমাদের সংবাদ প্রচার করতে হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ত্রাণের খাদ্য লুটপাট করছেন ক্ষমতাবানরা! এদের আচরণ মনে করিয়ে দিচ্ছে, একাত্তরের সেই দিনগুলোর কথা। মানুষ যখন প্রাণভয়ে পালাচ্ছে, তখন স্থানীয় প্রভাবশালী অনেকে অন্যের বাড়ি লুট করেছেন! আজকের দিনেও কেউ ত্রাণসামগ্রী মেরে খাচ্ছেন। কেউ আগামীতে বেশি মুনাফার কথা ভেবে নিত্যপণ্য মজুত করছেন! হায়রে লোভ! আজ যে যুদ্ধে মানুষ লড়ছে, যেখানে মৃত্যুর পর লাশ দাফনের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না অনেকে, সে সময়েও লুট-মজুতদারির মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা গেল না!
Advertisement
কেউ জানি না, এই যুদ্ধকালীন অবস্থায়, আপনি, আমি কে বেঁচে থাকব, পৃথিবীতে কতজন মানুষ জীবিত থাকবে, কিন্তু অবশিষ্ট মানবতাটুকুকে এভাবে মেরে ফেলতে যেন আমরা উদ্যোগী না হয়ে পড়ি। করোনা কারও ক্ষমতা, দম্ভ, অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তিকে ছাড়ছে না। তবু বেঁচে থাকার জন্য আপনাকে বারবার বলা হচ্ছে, আপনি নিজেকে রুদ্ধ করুন আপন ঘরে। তবে খুলে রাখুন রুদ্ধ মনের দ্বারটা।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/বিএ/পিআর