বিশেষ প্রতিবেদন

সংস্কারে নবরূপ পেয়েছে বাহাদুর শাহ পার্ক

পুরান ঢাকার সদরঘাটের কাছে লক্ষ্মী বাজারে ময়দানটির প্রথম নাম ছিল ‘আন্টাঘর’। ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল এই ময়দানে। ক্লাবঘরটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নবাব আব্দুল গণি ও নবাব আহসান উল্লাহ। ১৮৫৮ সালে রাণী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণের পর এই ময়দানের নামকরণ হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’।

Advertisement

১৯৫৭ সালে (মতান্তরে ১৯৬১) সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে ময়দানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। ভারতীয় উপমহাদেশে তথা বাংলাদেশে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনামলের স্মৃতিবিজড়িত বাহাদুর শাহ পার্ক গৌরব বহন করে আসছে। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পার্কটির পুরানো ঐতিহ্য ঠিক রেখে সংস্কারের মাধ্যেমে নতুন রূপে সাজিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

সংস্কারের মাধ্যমে এর আধুনিকায়ন করা হলেও প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এই পার্কে বজায় রাখা হয়েছে পুরনো ঐতিহ্য। নতুন নকশায় সাজানো হলেও পুরনো কোনও কিছু বদলানো হয়নি।

জানা গেছে, ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনের অগ্রাধিকার পাওয়া ‘জল সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় বাহাদুর শাহ পার্ক সংস্কার করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ছয় কোটি ৬৮ লাখ টাকা। জিট ইন্টারন্যাশনাল ও প্রোমা ইন্টারন্যাশনাল নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কাজ করেছে। ৮৫ কাঠারও বেশি আয়তন জুড়ে পার্কটির ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগত পটভূমি ছিল নকশার মূল ভাবনায়।

Advertisement

ঐতিহ্যবাহী পার্কটির চারদিকে ১২ ফুট চওড়া হাঁটার পথ তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে ব্যায়ামের সরঞ্জাম। হাঁটার পথ ঘেঁষেই বেড়ে উঠবে ছোট ছোট সৌন্দর্যবর্ধক গাছ। পাশে থাকা বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হাঁটার পথের নিচে খনন করা হয়েছে চার ফুট গভীর ড্রেন। এর মাধ্যমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে অতিরিক্ত পানি ভিন্ন ড্রেনের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হবে। একইভাবে ড্রেন থেকে পার্কে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। পাশেই সিপাহী বিদ্রোহ স্মৃতিস্তম্ভের মাঝের অংশ অনেকটা মঞ্চের মতো। এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে। এসব আয়োজন উপভোগে মঞ্চের উল্টো পাশে থাকবে একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার।

আগে পার্কের দুটি স্মৃতিস্তম্ভ অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকতো। সংস্কারের ফলে এতে যুক্ত হয়েছে আলোর ব্যবস্থা। এর মধ্যে আছে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন বেশকিছু বাতি, পার্কের বাকি অংশে লাল রঙের আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

অন্যদিকে ওয়াকওয়ে ছাড়া পার্কের সবখানেই কংক্রিট এড়িয়ে নতুন নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। একইসঙ্গে এখানকার একটি গাছও যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হয়েছিল। পাশাপাশি রোপণ করা হয়েছে বেশকিছু গাছের চারা।

পার্কের প্রকৌশলীরা জানান, কোনও জায়গায় ছায়া থাকলে ঘাস জন্মায় না। আর পার্কের মাঝপথে বৃষ্টির সময় কাদা জমে যায়। তাই এক ফুট পুরু করে ছোট ছোট নুড়িপাথর দিয়ে জায়গাটি ঢেকে দেয়া হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি পাথরের নিচ দিয়ে চলে যাবে নির্দিষ্ট ড্রেনে। অন্যদিকে পার্কে আসা দর্শনার্থীদের জন্য উত্তর-পূর্ব কোণে একটি আধুনিক পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে।

Advertisement

জানা গেছে, বাহাদুর শাহ পার্কে রয়েছে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ। এর একটি ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহকে মনে করিয়ে দেয়। অন্যটি ঢাকার নবাব আহসানউল্লার বড় ছেলে খাজা হাফিজুল্লার স্মৃতিস্তম্ভ। সংস্কারের সময় কোনও পরিবর্তন না এনে এগুলো পরিষ্কার করে রঙ দেয়ার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে বাতি। সিপাহী বিদ্রোহ স্মৃতিস্তম্ভের মেঝের পুরনো পাথর সরিয়ে ডিএসসিসি বসিয়েছে ভালো মানের পাথর। পাশাপাশি এতে দেয়া হয়েছে শ্বেতশুভ্র রঙ। রাতের জন্য স্মৃতিস্তম্ভ দুটির চারদিকে রয়েছে আলোর ব্যবস্থা।

ঐতিহ্য ঠিক রেখে সংস্কার এবং আধুনিকায়নের মাধ্যেমে গত ১১ মার্চ পার্কটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।

পার্কের বিষয়ে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক দীর্ঘদিন ধরে নিরাপত্তাহীনতায় ছিল। এতে মানুষের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা খুব একটা ছিল না। পার্কটির উন্নয়ন হওয়ায় ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা পেয়েছে। একইভাবে মানুষ এটি সঠিকভাবে ব্যবহারের অধিকার ফিরে পেয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের মাধ্যমে মাঠের উন্নয়ন করছি। এ প্রকল্পের আওতায় মাঠ ও পার্কের দৃশ্য বদলে দিয়েছি। আধুনিকায়নের মাধ্যমে এসব পার্ক ও খেলার মাঠগুলো আন্তর্জাতিক মানের করা হচ্ছে।

জানা গেছে, মেয়র হিসেবে মোহাম্মদ সাঈদ খোকন নির্বাচিত হওয়ার পর ডিএসসিসির ১৯টি পার্ক আর ১২টি খেলার মাঠ আধুনিকায়নে প্রকল্প গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে নকশা পরিবর্তনের কারণে ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৭০০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এই বরাদ্দের ৭০ শতাংশ দেয় সরকার, বাকি ৩০ শতাংশ বহন করে ডিএসসিসি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ‘জল-সবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের আওতায় ডিএসসিসিতে ৩১টি মাঠ ও পার্কের নকশা প্রণয়ন করেন রফিক আযমের নেতৃত্বে ৭০ জন স্থপতি। মাঠগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ইতিমধ্যে সর্বসাধারণের জন্য খুলেও দেয়া হয়েছে। আরও কয়েকটি মাঠ উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। মেয়র সাঈদ খোকনের মেয়াদকালেই (আগামী মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত) এ প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হচ্ছে।

প্রকল্পভুক্ত পার্ক ও মাঠগুলোর মধ্যে বাহাদুর শাহ পার্ক ছাড়াও রয়েছে মতিঝিলের সিরাজ উদ্দৌলা পার্ক, বংশালের ত্রিকোণাকার পার্ক, কলাবাগান খেলার মাঠ, গোলাপবাগ খেলার মাঠ, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা পার্ক, মালিটোলা পার্ক, সিক্কাটুলী পার্ক, মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পার্ক, আউটফল স্টাফ কোয়ার্টার শিশুপার্ক, বাসাবো মাঠ, শহীদ আব্দুল আলীম খেলার মাঠ, জোড় পুকুর মাঠ, রসুলবাগ পার্ক, গুলিস্তান পার্ক, নবাবগঞ্জ পার্ক,গজমহল পার্ক, হাজারীবাগ পার্ক, বাংলাদেশ মাঠ, সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ, পান্থকুঞ্জ পার্ক, আজিমপুর শিশুপার্ক, শহীদনগর মিনি স্টেডিয়াম, সামসাবাদ খেলার মাঠ, দেলোয়ার হোসেন খেলার মাঠ, বালুরঘাট খেলার মাঠ, ওসমানী উদ্যান বা গোসস্যা নিবারণী পার্ক, বকশীবাজার পার্ক ও বশির উদ্দিন পার্ক।

প্রকল্পের আওতায় মাঠ বা পার্কগুলোতে যা থাকছে

ডিএসসিসি সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় মাঠ বা পার্কের কোনো কোনোটিতে এলইডি লাইটিং, কফি হাউজ, ফুড কোর্ট, কার পার্কিং, জাদুঘর, পাঠাগার, গ্রিন জোন, পাবলিক প্লাজা, লেডিস কর্নার, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, হাতিরঝিলের মতো জলাধারের পাশাপাশি সবুজ বাগান ও বেষ্টনী। গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের ভাস্কর্যও থাকছে। ফলে পরিবার নিয়ে বেড়ানোর জন্য মনোরম জায়গা হয়ে উঠছে একেকটি মাঠ ও পার্ক।

এএস/এএইচ/পিআর