হাওরের ধান নিয়ে কৃষক-সরকার উভয়পক্ষই চিন্তিত। করোনাভাইরাস ও এর জেরে লকডাউনের কারণে এক জেলা থেকে ধানকাটা শ্রমিক আসতে পারবে না অন্য জেলায়। এই অবস্থায় হাওরের ধান যেন কৃষক গোলায় তুলতে পারে সেজন্য সরকারও চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় ধানকাটা মেশিন সরবরাহ করেছে সরকার। তারপরও কৃষক উদ্বিগ্ন। শেষ পর্যন্ত ধান গোলায় তোলা যাবে কি-না, সেই দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের। এদিকে সরকারও ভাবছে কৃষককে যতটুকু সুবিধা দেয়া যায়। দেশের হাওরবেষ্টিত সাত জেলায় বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২০ ভাগ। সরকার চাইছে, হাওরের ধান ঠিক মতো কৃষকের ঘরে তুলতে। এতে সরকারের খাদ্যভান্ডারও শক্তিশালী হবে।
Advertisement
দুই বছর আগের চৈত্রের শেষের সময় সর্বনাশা বর্ষণ হাওরের বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়েছিল কৃষকের সোনালী ফসল। বিনষ্ট হয়েছিল সব পাকা ও আধাপাকা ধান। ধান হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলেন হাওর পাড়ের লাখ লাখ কৃষক। এবারও সেই শঙ্কা, সেই ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। একই সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার ধানের মূল্য কম পাওয়ার দুশ্চিন্তা। এ অবস্থায় উচ্চ সুদে ঋণ পরিশোধসহ উৎপাদনের খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হবে কৃষকদের। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কৃষকদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলার কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা।
নেত্রকোণা কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, জেলায় মোট ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাওরাঞ্চলের ছোটবড় ১৩৪টি হাওরে মোট ৪০ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়। শ্রমিক সংকট ও আগাম বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন উঠতি বোরো ধান। সারা জেলায় এই মৌসুমে বোরোর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ১১ লাখ ১৯ হাজার ৫৬১ মেট্রিক টন ধান।
নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক মঈন উল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বোরো ধান কাটার শ্রমিক সংকট রয়েছে। এ বছর নেত্রকোণায় কৃষকদের ধান কাটার জন্য নতুন ৪২টি ও পুরাতন ৮২টিসহ মোট ১২৪টি হারভেস্টার মেশিন বিতরণ করা হচ্ছে। নতুন-পুরনো মিলিয়ে যে হারভেস্টার মেশিন রয়েছে তাতে সংকটের সমাধান হবে। প্রয়োজনে আরও মেশিনের ব্যবস্থা করা হবে। দ্রুত ধান কাটার জন্য আধুনিক যন্ত্র সরবরাহ করা না হলে আগাম বন্যার ঝুঁকিতে থাকবে হাওরাঞ্চলের কয়েক লাখ কৃষকের বছরের একমাত্র বোরো ধান।
Advertisement
নেত্রকোণার কৃষকরা জানান, বোরো ফসল উঠিয়েই ধান বিক্রি করে ধান কাটার শ্রমিক, মাড়াই এবং ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এ সময় প্রতি বছর ধানের দাম একদম কম থাকে। করোনাভাইরাসের কারণে ধানের দাম আরও কমে যাওয়া আশঙ্কা করছেন তারা। এমনটা যদি হয় তবে কৃষকরা এবারও ঋণের বোঝা কমাতে পারবেন না।
কিশোরগঞ্জ ইটনা ধইলংয়ের কৃষক বাচ্চু মিয়া বলেন, এখন পর্যন্ত ধান কাটার জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক ম্যানেজ করতে পারিনি। ইতোমধ্যে বিআর২৮ ধান পেকে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এ ধান না কাটতে না পারলে নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যদিকে বাকি জাতের ধান আগামী ১০ দিনের মধ্যে কেটে শেষ করতে হবে। না হয় হাওরে পানি চলে আসবে। এখন কী করব বুঝে উঠতে পারছি না।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ধান কাটার কম্বাইন হারভেস্টার ও রিপার দেয়া হয়েছে। ধান কাটার পুরো সময়টুকুতে হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, নিকলী এবং তাড়াইলের ইউএনও এবং কৃষি কর্মকর্তারা সমন্বয় করে কাজ করবেন।
তিনি বলেন, ধান কাটার জন্য জামালপুর, কুড়িগ্রামসহ আরও কয়েকটি জেলা থেকে শ্রমিকরা আসেন। যানবাহন বন্ধ থাকায় এবার একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে অনেক হাওরে বিকল্প পদ্ধতিতে শ্রমিকরা এসেছেন।
Advertisement
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের পরিচালন বাজেটের আওতায় হাওরাঞ্চলের (কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ধান কাটার জন্য জরুরি ভিত্তিতে নতুন ১৮০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১৩৭টি রিপার বরাদ্দ দেয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে হাওর অঞ্চলে ৩৬২টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ১০৫৬টি রিপার সচল রয়েছে। এছাড়াও পুরনো মেরামতযোগ্য ২২০টি কম্বাইন হারভেস্টার ও ৪৮৭টি রিপার অতি দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে কৃষি সচিব নাসিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ধান কাটার শ্রমিক পেতে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। সেজন্য এবার আমরা অতিরিক্ত ধান কাটার যন্ত্রপাতি দিয়েছি। অন্যান্য জেলা থেকে ধান কাটতে আসা শ্রমিকরা যেন সমস্যায় না পড়েন সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে হাওর এলাকায় শ্রমিকরা যেন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারেন, সেই উদ্যোগ নেয়া হবে।
তিনি বলেন, ঢাকা থেকে প্রচুর শ্রমিক গিয়ে এখন গ্রামে অবস্থান করছেন। তারা এখন ধান কাটার কাজে অংশ নিতে পারবেন। তাই ধান ওঠানোর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করি।
কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ১০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে রিপার ও হারভেস্টার কেনা হয়েছে। যন্ত্রপাতিগুলো হাওরে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বৃষ্টি না হওয়ায় হাওর শুকনা, কোনো কাদা নেই। তাই এই কমন হারভেস্টার বা রিপার দিয়ে ধান কাটতে কোনো সমস্যা হবে না। সেজন্য শ্রমিক পাওয়া এবার একটু কঠিন হলেও সমস্যা হবে না। আর প্লেইন ল্যান্ডে বোরো ঘরে তুলতে সমস্যা হবে না ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. আবদুল মঈদ বলেন, কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ৫০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে ধান কাটার মেশিন দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ধান কাটার শ্রমিক সঙ্কট জটিল আকার দেখা দিলে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে অন্যান্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। কৃষকদের ধান ঘরে তোলার স্বার্থেই সরকার হাওরের ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ইতোমধ্যে হাওরে বাঁধগুলোর নির্মাণকাজ সমাপ্ত হয়েছে। আশা করছি সুন্দরভাবেই কৃষক ঘরে ফসল তুলতে পারবে।
তিনি বলেন, আাগামী জুনের মধ্যে ৬৪ জেলায় তিন ক্যাটাগরির কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন- কম্বাইন হারভেস্টার, রিপার এবং রাইস ট্রান্সপ্লান্টার সরবরাহ করা হবে।
এফএইচএস/এইচএ/পিআর