বহুবার সভ্যতা ও শান্তির সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে বিশ্ব। কখনো যুদ্ধ, কখনো ঝড়-ঝাপটা, মহামারি, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, উতরেই এগিয়ে চলেছি আমরা। বসন্ত, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, প্লেগ, ওলাওঠা, ডেঙ্গু, মার্স, সার্স- আরও কতো রকম রোগ-শোকে বিশ্বের একেক অঞ্চল একেক সময় উজাড় হয়েছে; জনপদ ভীত হয়েছে। অনেকবার অনেক কিছুতেই শঙ্কিত হতে হয়েছে আমাদের। সংকট আসে; সংকট আবার চলেও যায়। কষ্টগুলো বহুদিন ধরে আঁকড়ে থাকে না। কিছুটা ভোগায়; ক’টা জীবন কেড়ে নেয়। আবার শান্তি ফিরে আসে। এইতো চলছে দুনিয়াজুড়ে।
Advertisement
এখন চলছে করোনাভাইরাসের ঝড়। অদৃশ্য করোনার ভয়ে কাঁপছে গোটা দুনিয়া। করোনা যেন আমাদের সুখ কেড়ে নিয়েছে। ভীতিকর অবস্থা সবখানে। বিশ্বের কোথাও যেন কোনো সুসংবাদ নেই। দুঃসংবাদ আর দুঃস্বপ্নে কাটছে সবার জীবন। এভাবে আর চলে না। আমাদের হাসতে হবে। নইলে আমরা যে অসুস্থ হয়ে যাব। নিদেনপক্ষে মনোরোগ পেয়ে বসবে আমাদের।
করোনাভাইরাসের সংকটে শত ভয়ের মাঝেও অনেক সুখবর আসে কানে। আশা জাগে মনে। এরই মধ্যে করোনায় সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ এর ওষুধ, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের খবর পাচ্ছি আমরা। তবে কেউই এখনো ওষুধ আবিষ্কারে পূর্ণতা পায়নি। পরীক্ষামূলক ব্যবহার চলছে। এভাবেই হয়তো একদিন আমরা সুখবরটা পেয়ে যাব। সেই সময় পর্যন্ত আমাদের নিয়ম-কানুন মেনে ঘরে থাকতে হবে হয়তো। করোনা ঝড় ঠিকই একদিন থেমে যাবে। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের শান্তির দিন ফিরিয়ে দেবেনই একদিন। এমন সুখস্বপ্ন আঁকি বুকে। আশায় থাকি সুদিনের।
বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উদ্ভাবনের এই সময়ে বিশ্বময় করোনাভাইরাস নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে বটে। আবার করোনা ভ্যাকসিন কিংবা ওষুধ তৈরি নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আশারও সঞ্চার হয়েছে। যে গতিতে গবেষণা চলছে তাতে হয়তো করোনাভাইরাসকেও জয় করতে সক্ষম হবো আমরা। অনেক চিকিৎসাবিজ্ঞানী সফলতার দ্বারপ্রান্তে আছেন বলেও দাবি করছেন। সু-সংবাদ প্রাপ্তির সে সময়টা হয়তো অনেক দূরে নয়। বিশ্ববাসী আবার হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে। করোনা যেমন বিজ্ঞান, অগ্রগতি, উদ্ভাবন, সবকিছুকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে; আবার সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে আমাদের স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা একদিন হয়তো আশার আলো দেখাবেন। আমরা সেই দিনের অপেক্ষাতেই রইলাম।
Advertisement
খবরটা সুখের বটে! উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলে করোনার প্রকোপ হ্রাস পেতে পারে। বাংলাদেশের আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র হচ্ছে ক্রমশ। তাহলে তো আমাদের সামনে ভালো থাকার কথা। ভালো খবর, আশার খবর। স্রষ্টা যেন আমাদের ভালো রাখেন সেই প্রত্যাশাই করছি। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের রাশ টেনে ধরতে পারে বলে মতটি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) বিজ্ঞানীদের। তাদের মতে, এশিয়ার যে দেশগুলোয় বর্ষা মৌসুম রয়েছে, সেসব দেশে এই ভাইরাস হয়তো কিছুটা কম ছড়াতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আবহাওয়াজনিত পার্থক্যের কারণেই চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ অঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব অনেকটাই কম। উষ্ণ আবহাওয়ার দেশ ইরানেও করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমে আসছে। সম্প্রতি দেশটির কয়েকটি অঞ্চলে বন্যা শুরু হয়েছে, আবহাওয়ার উষ্ণতাও বাড়ছে। আগামী দিনগুলোতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ও অঞ্চলগুলোতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও কমতে পারে।
এমআইটির গবেষক কাশিম বুখারিসহ বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নভেল করোনাভাইরাসে সৃষ্ট কোভিড-১৯ সংক্রমণের তথ্য সংগ্রহ এবং আবহাওয়ার দুটি মানদণ্ড তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ভিত্তিতে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেছেন। তাদের গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, গত ২২ মার্চ পর্যন্ত বিশ্বের যে যে অঞ্চলে কোভিড-১৯ ছড়িয়েছে, সেসব অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল ৩ থেকে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। ওই অঞ্চলে প্রতি ঘনমিটারে আবহাওয়ার আর্দ্রতা ছিল ৪ থেকে ৯ গ্রাম। আক্রান্ত দেশগুলোর গড় তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল বলে এমআইটির বিজ্ঞানীরা বলছেন। এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এশিয়ার যে দেশগুলোয় বর্ষা মৌসুম আছে, সেসব দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়তো কম হবে। আশা জাগানিয়া সংবাদে বেশ সুখ মিলছে মনে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আশার আলো জাগায় করোনা ভ্যাকসিন। এই মুহূর্তে এর চাইতে বড় এবং আনন্দ-আশার খবর আর কিছুই হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীদের দাবি, তারা প্রায় করোনাভাইরাস ঠেকানোর ভ্যাকসিন তৈরি করে ফেলেছেন। পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউএমপিসির সহযোগিতায় কাজটি চালানো হচ্ছে। টাকার যোগানের দায়িত্বে রয়েছে এনআইএইচ ইনস্টিটিউট। ল্যানসেট ইবায়োমিডিসিনের একটি জার্নালে এ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে মানুষের শরীরে যেভাবে ভ্যাকসিন দেয়া হয় তার ধারা বদলে দেবে এই চিকিৎসা প্রক্রিয়া। গবেষকরা বলেছেন, খুব দ্রুত এই ভ্যাকসিন ক্যানডিডেট থেকে দীর্ঘমেয়াদী ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে যাবে। ইঁদুরের শরীরে এর কার্যকারিতা দেখে দাবি করা হয়েছে, করোনা আক্রান্ত মানুষের শরীরেও একইভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি করবে এই ভ্যাকসিন। তাদের ওপর আশা রাখা যায় কারণ, সার্স (SARS-CoV) ও মার্স (MERS-CoV) ভাইরাসের প্রতিরোধী ভ্যাকসিনও তৈরি হয়েছিল পিটসবার্গ স্কুল অব মেডিসিনে। তাদের কথায়, ‘আগের দুটো মহামারির ভয়াবহতা আমরা দেখেছি। তখনো ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা হয়েছিল। করোনাভাইরাসের সঙ্গে সার্স ও মার্স ভাইরাসের মিল রয়েছে। তাই এই নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ক্যানডিডেট কেমন হবে সেটা অনুমান করা গিয়েছে। তারা বলেছেন, করোনার ভাইরাল প্রোটিনগুলোকে শনাক্ত করে ল্যাবেই এমন ভাইরাল প্রোটিন বানানো হয়েছে যা দেহকোষে শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরি করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে। শুধু কোভিড-১৯ নয়, আগামী দিনে এমনই কোনো সংক্রামক ভাইরাসঘটিত রোগকে রুখতেও এই ভ্যাকসিন কাজে আসতে পারে।
এদিকে ভরসার কথা শুনিয়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরাও। তারা জানিয়েছেন, করোনাকে ধ্বংস করার ভ্যাকসিন তৈরি করে ফেলেছেন তারা। এখনই ভ্যাকসিন হাতে তুলে দেয়া যাবে না ঠিকই, তবে কাজ অনেকটাই সাফল্যের দিকে। মানুষের ওপর এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্যও তৈরি তারা। সেজন্য নাম নিবন্ধনের প্রক্রিয়া চলছে। ট্রায়ালে অন্তত ৫০০ জনের ওপরে প্রয়োগ করা হবে এই ভ্যাকসিন। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল প্রায় শেষ। অক্সফোর্ড জানিয়েছে, সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারীর ওপরে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে। ১৮ থেকে ৫৫ বছর বয়সী এমন ৫১০ জনের স্ক্রিনিং চলছে। ইংল্যান্ডের টেমস ভ্যালি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই মানুষের ওপর ট্রায়াল চলবে এই ভ্যাকসিনের। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এমন সুখের খবর ছাপা হয়েছে। এমন দুঃসময়ে করোনার ভ্যাকসিন তৈরির সুখ-সংবাদ বেশ আশা জাগায় মনে।
Advertisement
গত ৩০ মার্চ ঢাকা নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বাংলাদেশের মানুষের উদ্দেশে খোলা চিঠি দিয়েছেন। তার চিঠিটি আমাদের জন্য বেশ আশা জাগানিয়া। চীন অনেক দেশকেই শত্রু জ্ঞান করে চলে। উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিযোগিতার সারিতে রাখে সবসময়। দুঃসময়ে নানা কারণে চীন বাংলাদেশের পাশে থাকবে। আর খোলা চিঠিতে সে প্রতিশ্রুতিই মিলেছে। কম খরচে পণ্য উৎপাদন করা যায় বলে বহু চীনা শিল্প কারখানা এখন বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। অনেক কিছুতেই চীন ঠিকাদারিও করছে বাংলাদেশে। সেসব কাজ এখন চলমান। চীন এই বাজার ঠিকই ধরে রাখতে চাইবে। করোনা মোকাবিলা, চিকিৎসা সহায়তা, উন্নয়ন প্রকল্প এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যসহ সব জায়গায় বাংলাদেশের সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি জানানো হয়েছে ওই খোলা চিঠিতে। এর অবশ্য আরও বিশেষ কারণ আছে। রাষ্ট্রদূত বলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। বাংলাদেশিরা চীনে করোনাভাইরাস ধরা পড়ার দুর্যোগ মুহূর্তে পাশে থেকেছেন। বাংলাদেশের নাগরিকরা চীনের জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন। বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আমাদের জন্য প্রার্থনা করেছেন। বাংলাদেশ থেকে চীনের দুঃসময়ে বিভিন্ন সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহানুভূতি এবং সমর্থন জানিয়ে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে চিঠি দিয়েছেন। তিনি বলেন, বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। প্রকৃত বন্ধুদের পাশে থাকবে চীন। এই দুঃসময়ে চীনের এমন সমর্থন সত্যিই আশা জাগায়। চিঠিতে বলা হয়, এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৪৯ জন আক্রান্ত (চিঠি লেখা পর্যন্ত) হয়েছেন। বাংলাদেশ এই মহামারি ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে যা প্রশংসার দাবি রাখে।
করোনা আক্রান্ত দেশ চীন যদি বলে বাংলাদেশ ভালো আছে তাহলে তো তা ভালো খবরই বটে। এ কথা সত্য বাংলাদেশের মানুষ অন্য যে কোনো দেশ থেকে এখনো ভালো আছে। মহামারিতে রূপ নেয়নি বাংলাদেশে। এটাতো সুখসংবাদই। তাছাড়া করোনায় অভিজ্ঞ চীন আমাদের এই সংকটে পাশে থাকবে এমন আশ্বাসে সুখ জাগে মনে। আরও সুখ পাই করোনা পরবর্তী বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে চীন তাদের পাশে রাখবে এই সংবাদে। কালে কালে তো কতো কিছুই দেখলাম। দুঃসময় আসে, আবার ঘুরে ফিরে আসে সুসময়ও।
ইতিহাস সাক্ষী, ২০০৩ সালে সার্স ও ২০১৪ সালে মার্স রোগে কী ভয়ংকর পরিস্থিতিতেই না ফেলেছিল বিশ্ববাসীকে। তখন মারা যায় সাড়ে সাত শতাধিক মানুষ। সার্স ঠিকই মোকাবিলা করেছিল হংকং। আমরা ভুলে যাইনি, বসন্ত, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া, প্লেগ এমন আরও কত রকম রোগ-শোকে বিশ্বের একেক অঞ্চল একেক সময় উজাড় হয়েছে, ভীত হয়েছে জনপদ। আমরা দেখেছি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সব ঝড় আবার থেমেও গেছে। পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হয়েছে। সভ্যতার চরম বিকাশের এই একুশ শতকে বিশ্বময় মানবসভ্যতার জন্য যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং গভীর সংকট তৈরি করেছে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯, তা যেন নজিরবিহীন। এ ভাইরাসে বিশ্ব থমকে আছে। অতীতের মনুষ্যসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সঙ্গেই যেন এর কোনো তুলনা চলে না। বিশ্ব কাঁপিয়ে দিচ্ছে প্রাণবিধ্বংসী এই করোনাভাইরাস। তবু হতাশ হলে চলবে না। করোনাকেও আমরা জয় করব একদিন। সেই সুখ স্বপ্নই আমরা দেখি।
লেখকসাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক
এইচএ/জেআইএম