একজন বড় শিল্পপতির সাথে কথা বলছিলাম। এই করোনাকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের খারাপ অবস্থার কথা বলতে গিয়ে জানালেন, আরও এক মাস সবকিছু বন্ধ থাকলে তার বাণিজ্যিক গ্রুপটি বড় বিপদে পড়বে। কী করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জানালেন, তিনি কোনো কর্মী ছাঁটাই করবেন না, বেতনও বন্ধ করবেন না। তবে তিনি হিসাব করতে শুরু করেছেন, কীভাবে কৃচ্ছ্রতা সাধন করা যায়, কোন কোন হেড-এ বাড়তি বা অযাচিত খরচ কমানো যায়।
Advertisement
আমরা সবাই বেশ ভালোই বুঝতে পারছি, এটি এক যুদ্ধ, কিন্তু করোনাভাইরাস কোনো শত্রু দেশ নয়। শুধু হুংকারে সে ভয় পাবে না। কৌশলে তাকে মারতে হবে। যুদ্ধপ্রস্তুতি কেমন ছিল বা ছিল না, সেই প্রশ্নের চেয়ে এখন অনেক বড় সংকল্প হলো মানুষকে বাঁচানো। এই শিল্পপতি মনে করছেন, করোনার ঘা সহজে শুকাবে না। অনেকদিন থাকবে।
ধনী দেশগুলোর ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীরা চিকিৎসাসেবা দিতে দিতে বিদ্ধস্থ। একে একে তারাও আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনায় চিকিৎসকরা এভাবে অসুস্থ হয়ে গেলে কে করবে চিকিৎসা? বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া এসব চিত্র আমাদের বুকে কাঁপন ধরায়। আতঙ্কিত হতে চাই না, কিন্তু চিন্তামুক্ত থাকতে পারি না।
বাংলাদেশে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি চলছে। কোথাও কোথাও জেলা-উপজেলা বা এলাকাভিত্তিক লকডাউন চলছে। এই ছুটি ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে। এরপরও কি বাড়বে? এমন একটা জিজ্ঞাসা আছে সর্বত্র। নির্ভর করবে কত দ্রুত ভাইরাস তার থাবা বাড়াচ্ছে। তবে সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগ প্রতিদিন যে ব্রিফিং দেয়, সেটি হিসাবে নিলে পরিস্থিতির উন্নয়ন নেই সেভাবে। প্রতিদিনই বাড়ছে। শুক্রবার এই লেখার সময় দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনাভাইরাসে মোট মৃতের সংখ্যা ২৭। নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৯৪। মৃত্যু আর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
Advertisement
প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর আমরা কেবল ৩৫ দিন পার করেছি। ভারত ৭০ দিন পার করে দেখছে করোনা আক্রান্ত রোগী কেবল বাড়ছেই। পাকিস্তান ৪৩ দিন পার করে পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আমরাও দেখছি দিন দিন সংক্রমণের গতি বাড়ছে, নতুন নতুন এলাকা যুক্ত হচ্ছে। কারণ আগে একটি মাত্র পরীক্ষাগার ছিল ঢাকার আইইডিসিআর, এখন তা বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে বিভিন্ন জেলার ১৪টি ল্যাবে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা হচ্ছে। এটাও অপ্রতুল। সরকার চেষ্টা করছে এর পরিধি বাড়াতে। সরকার সেনাবাহিনী নামিয়েও মানুষকে ঘরে রাখতে পারছে না। নানা অজুহাতে বেরিয়ে পড়ছে। অজ্ঞতা, তাচ্ছিল্য মনোভাবই হয়তো এই রোগের ছড়িয়ে পড়ার বড় কারণ হবে।
হ্যাঁ, ছুটি বা লকডাউন মানে মানুষকে না খাইয়ে রাখা নয়। সরকার হতদরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্যসাহায্য দিতে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে কমমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি করছে। প্রধানমন্ত্রী সাড়ে ৭২ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। এগুলো সবই ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং এগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু সবাই বলছে, আগামী কয়েকটা দিন প্রধানমন্ত্রীকে আরও কঠোর হাতে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। প্রয়োজনে কারফিউ দিয়ে হলেও মানুষকে ঘরবন্দি করতে হবে। আমরা ইউরোপ-আমেরিকা বা ইরানকে দেখে বুঝেছি, যারাই প্রাথমিক পর্যায়ে এর বিরুদ্ধে কোমরবেঁধে নামার ব্যাপারে অনীহা দেখিয়েছিল, তাদেরই আজ মৃত্যু দিয়ে প্রমাণ করতে হচ্ছে, কত বড় ভুল তারা করেছিল।
প্রতিটি মানবিক সংকট বা বিপর্যয়ই দেশে সাধারণ মানুষের জন্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। বিশ্বায়নের এই যুগে জীবনে চলে অর্থনীতির জ্বালানিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আজ পৃথিবী সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। তাই অর্থনৈতিক পদক্ষেপের একটা হতে পারে জাতীয় কৃচ্ছ্রতা সাধনের ডাক। ভারতে মন্ত্রী-এমপিদের বেতন তিরিশ শতাংশ কমানো হয়েছে দুই বছরের জন্য। আরও অনেক জায়গায় এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
দেশ ভেদে পরিকল্পনা ভিন্ন। তবে সবার নজরই অর্থনীতিতে। কারণ করোনার পরও থাকবে অন্ধকার সময়। চীন এক ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার উদ্দীপ্তকরণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে আর করোনায় বড়ভাবে আক্রান্ত ইরান ১৯৬২ সালের পর প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে হাত পেতেছে বেলআউট বা সংকটমোচন প্যাকেজ নিয়ে। প্রাথমিকভাবে ইরান চেয়েছে ৫০০ কোটি ডলার।
Advertisement
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই নভেল করোনাভাইরাসের বিস্তারের একদম শুরু থেকে বলে আসছে টেস্ট, টেস্ট অ্যান্ড টেস্ট। অর্থাৎ যত পরীক্ষা করা হবে ততই এই রোগের সংক্রমণের তথ্য হাতে আসবে, একে মোকাবিলা করা সহজ হবে। এখন অর্থনীতির বেলায় বলা হচ্ছে প্ল্যান, প্ল্যান অ্যান্ড প্ল্যান। পরিকল্পনা করে এগুতে হবে যেন, অর্থনীতির মূল জায়গাগুলো ভেঙে না পড়ে।
বর্তমান সরকারের আমলে যে উন্নয়ন জোয়ার ছিল তাকে অব্যাহত রাখতে হলে সরকারের চলতি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রতা আনতে হবে। অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতা থেকে সরে আসতে হবে এবং সেটা করতে কবে দক্ষতার সাথে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের এখনই এক কোটি টাকা দামের গাড়ি দেব নাকি পরে দেব, উপ-সচিব পর্যন্ত গাড়ি, গাড়ির খরচ অব্যাহত রাখব, নাকি স্বাস্থ্যখাতের জরুরি বরাদ্দ বাড়াব, আর্থিক খাতে কী ধরনের সৃজনশীল পদক্ষেপ নেব- এমন অনেক পরিকল্পনার সময় এখন।
এইচআর/বিএ/এমএস