সাহিত্য

রাতের গভীরতায় আতঙ্কিত তুমি

গাছের পাতা ঝরে আমার হাতে পড়তেই কেমন যেন ঘোর ভেঙে চেতনা ফিরে পেলাম। আমি কী যেন একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম! আসলে মন এমনই, কখন কোথায় হারিয়ে যায় বোঝা কঠিন। প্রেমিক-প্রেমিকার ক্ষেত্রে মন দেওয়া-নেওয়া বিষয়টি এ জন্যই প্রচলিত শব্দে রূপ নিয়েছে।

Advertisement

মনের দর্শন, দর্শনের একটি শাখা- যা দেহের সাথে অ্যান্টোলজি, প্রকৃতি এবং মনের সম্পর্ককে অধ্যয়ন করে। দ্বৈতবাদ এবং একত্ববাদ মন-দেহের সমস্যা সম্পর্কিত দুটি কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, যদিও সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি উত্থাপিত হয়েছে। যেগুলো এক বা অন্য শ্রেণির সাথে খুব সুন্দরভাবে খাপ খায় না। দ্বৈতবাদ পশ্চিমা দর্শনে প্রবেশ করল সপ্তদশ শতাব্দীতে। রেনা ডেসকার্টেসকে ধন্যবাদ জানায়, ডেসকার্টসের মতো পদার্থের দ্বৈতবাদীরা যুক্তি দেয় যে, মন একটি স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান পদার্থ, যেখানে সম্পত্তির দ্বৈতবাদীরা মনে করেন যে, মন একটি পৃথক বৈশিষ্ট্য যা মস্তিষ্কে উত্থিত হয় এবং হ্রাস করা যায় না। তবে এটি কোনো স্বতন্ত্র পদার্থ নয়। মনবাদ এমন একটি অবস্থান, যা মন এবং দেহ জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে পৃথক সত্তা নয় (স্বতন্ত্র পদার্থ)।

মন স্বতন্ত্র আবার অনেকে মনে করেন স্বতন্ত্র নয়; এমন দার্শনিক বিতর্কে আলোচনা-সমালোচনায় জড়িয়ে পড়লে দিনের শেষভাগে আমার মনের সাথে জয়-পরাজয়ের হিসেব চুকিয়ে ঘরে ফেরা দায় হয়ে যাবে। সুতরাং আমার এখন বাড়ি ফেরা উচিত।

আমি আসলে ভাবছিলাম মানুষের কথা, যে মানুষ সমাজ-সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে যুগের পর যুগ। সভ্যতার সর্বোচ্চ ধাপে অত্যাধুনিক যুগে তার পদচারণা। তবে সে জয়যাত্রা একদিনে আসেনি।

Advertisement

আজ তেঁতুল গাছের তলায় আমি নিউটনের মত কোনো সূত্র আবিষ্কারের জন্য বসলাম না-কি! আবার শুনেছি তেঁতুল গাছের নিচে বসলে মাথার বুদ্ধি লোপ পায়। তাহলে আজ এমন কি ভিমরতিতে আমাকে ধরলো! আমি কয়েক ঘণ্টা এমন গাছটির নিচে বসে কাটিয়ে দিলাম। আমার মনোজগতে কিভাবে এমন পরিবর্তন নিয়ে এলো, এটিও একটি গবেষণার বিষয় হতে পারে।

আসলে প্রথম প্রেমে পড়লে মানুষ একটু ব্যতিক্রম বা আনমনা আচরণ করে। আমার ক্ষেত্রে তা হবার কথা এখন নয়, কারণ আমি প্রেমের বাজার যাচাই করে এখন তৃতীয় প্রেমে মজনু হয়ে আছি। আফরোজা আমাকে আমের আচার খাওয়াবে বলে তিন ঘণ্টা তেঁতুল তলায় বসিয়ে আমার সাথে প্রতারণা করলো। ফোন ধরে না, আচারও আসে না। এমন প্রতারণা মেয়েদের স্বভাবের সাথে যায়!

বাড়ির সামনে আসতেই বীরদর্পে প্রতাপের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বাবার সাথে গোধূলিলগ্নে আচমকা সাক্ষাৎ হয়ে গেল। এমন সময় বাবার বাড়িতে থাকার কথা নয়, তাহলে আজ কি জন্য এমন করে অপেক্ষা করছে কারও জন্য- এমনটি ভাবতেই বাবার হুঙ্কার এলো।

‘তুমি পড়ালেখা শেষ করে বেকার থেকে আমার অন্ন নষ্ট করছ। তাতে আমার আপওি নেই। তবে এখন থেকে বাড়ির বাইরে যাবে না। এলাকার অবস্থা ভালো না, নেশার আখড়া, এর উপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাকি মড়ক লেগেছে। ওলাবিবি আসার মত, যাকে ধরছে আর ছাড়ছে না, কখন কী হয় বলা মুশকিল। সবমিলিয়ে যতদিন কিছু না করো; ততোদিন ঘরে থেকো। আমার এ কথার যেন ব্যতিক্রম না হয়।’

Advertisement

বাবা হয়তো না জেনে বলেছেন, আমি কিছু করি না। তবে আমি দিব্যি কিছু করছি। এই যে আফরোজার সাথে প্রেম করছি। এটি নিশ্চয়ই ছোটখাটো কাজ নয়। কত কিছু সহ্য করে সবে প্রেম শুরু। তারপর সিডিউল মেইনটেইন করে চলতে হয়। আবার ভুল হলে অফিসের বসের মতো ঝারি দেয়। সবমিলিয়ে আমার চলমান কাজে প্রেসার আছে, শুধু বেতন হয় না। যদিও তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি আমার কাজ করে যথেষ্ট আনন্দ অনুভব করছি।

ঘরে ঢুকতেই আম্মু তার একমাত্র ছেলের যত্ন নিতে বিলম্ব করেনি। সাথে সাথে এতগুলো প্রশ্ন একসাথে ছুঁড়ে দিলো। সারাদিন কোথায় ছিলাম? কী করলাম? সকাল থেকে কোনো খোঁজ নেই কেন? দুপুরে কী খেলাম? কোথায় খেলাম? একটা ফোন দিতে পারতাম। দেশের যে পরিস্থিতি! কখন কি হয়। এলাকার ছেলেরা সব নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। ওদের সাথে মেশা যাবে না। আবার নতুন রোগ এসেছে।

আমি এতগুলো প্রশ্ন আর উপদেশের মিশ্রণে নিজেও একটু ঘোরে পড়ে গেলাম। আম্মুর কোনো প্রশ্নের উওর না দিয়ে ফ্রেশ হয়ে সোজা খাওয়ার টেবিলে বসে পড়লাম। দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। আচার খাওয়ার আশায় সেটিও জোটেনি। যাই হোক, কিছু পেতে হলে কিছু কষ্ট স্বীকার করতে হয়। আমিও তার বাইরে নই। আফরোজার জন্য না হয় এতটুকু মেনে নিলাম।

বাবার হুঁশিয়ারি আমাকে মানতে হবে অনেকটা কারফিউয়ের মত। আসলে বাবা আমাকে বাইরে যেতে নিষেধ করার মূল কারণ দেশে নতুন এক রোগের আবির্ভাব হয়েছে। যা কি-না ছোঁয়াচে এবং কয়েক দিনে কয়েক হাজার মানুুষ সংক্রমিত হয়েছে আমাদের পাশ্ববর্তী কয়েকটি দেশে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি ভালো না। বাংলাদেশও এ ঝুঁকির বাইরে নয়। বিবিসির সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার খবরে এর উপর বিশেষ প্রতিবেদনে এমনটি বলল। রোগটির প্রতিষেধক তৈরি না হওয়ায় মূলত স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সংকট তৈরি হয়েছে। আতঙ্কিত মানুষ, পাড়ার চায়ের দোকানে দু’দিন ধরে টপ অব দ্য টপিকে স্থান করে নিয়েছে বিষয়টি।

সরকার জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে মানুষকে সচেতন হওয়ার জন্য বলেছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ঘরে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় মোড়ের চায়ের দোকানে জড়ো হয়েছে শতাধিক মানুষ। তারা একে অন্যকে বিষয় সম্পর্কে অবহিত করছে এবং সচেতন করছে। বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুললো এমন অবস্থায় সরকারি নির্দেশনা মেনে তারা ঘরে থাকবে। কিন্তু তা না মেনে নিজেরা বিশেষজ্ঞ হয়ে যে জটলা তৈরি করছে, তাতে অসচেতন অতিউৎসাহী হয়ে এক ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে না তো!

আফরোজার ফোনে হুট করে আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো। ফোন রিসিভ করতেই মেয়েটি বাহানা করে অনুতপ্ত হলো আজকের ঘটনার জন্য। তার বাবা হঠাৎ ঢাকা থেকে আজ বাড়িতে এসেছে। সকালে বাবা রওনা দিয়েছে কিন্তু আফরোজা জানে না। তার আম্মুর কাছ থেকে ফোন নিয়ে আমাকে জানানোর সুযোগ করতে পারেনি। ফলে আমাকে তেঁতুল তলায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। যদিও আমি সময়টি দার্শনিক আবহে পার করেছি।

আফরোজার সাথে পরিচয় আমার বান্ধবীর মাধ্যমে। একদিন বাজারে আমার বান্ধবীর সাথে তাকে দেখেছিলাম। দেখেই আমি মায়ায় পড়ে গেলাম। অসাধারণ এক সৌন্দর্য তার মধ্যে লক্ষ্য করলাম। আমার শরীরে এক শীতল রক্তের প্রবাহ বয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। শরীরের রং বলতে গেলে আপেল রঙের। জহির রায়হানের লেখা একুশের গল্পে রেণু চরিত্রের বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে যায়। পরে মারুফা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল আফরোজা তার কাজিন। এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ছে। তারপর তার নাম ফেসবুকে খুঁজে পেলাম। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিতেই সে অ্যাকসেপ্ট করলো, যা অনেকটা অবিশ্বাস্য ছিল। যেমনটি ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অস্ট্রেলিয়াকে তাদের দেশের মাটিতে হারানো। তারপর কথা-বার্তা হতো নিয়মিত। আমি তখন সদ্য ব্রেকআপে ছিলাম। ফলে একাকিত্ব ঘোচাতে দারুণ সময় পার করার প্লাটফর্ম পেয়ে গেলাম। কোনো এক পূর্ণিমা রাতে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে তাকে প্রেম নিবেদন করলাম। সে আমার প্রস্তাবে সাড়া দিলো। যা আমার কাছে এভারেস্ট বিজয়ের আনন্দের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না।

এরপর দীর্ঘ একবছর আমাদের পথচলা। সময়ের সাথে সাথে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতা পাচ্ছে। নির্ভরশীলতা, বিশ্বাস একে অন্যের প্রতি বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমি এটি উপভোগ করছি।

আফরোজাকে দেশের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করলাম। সে-ও জানালো, তার বাবার ঢাকা থেকে আজ বাড়ি আসার কারণ এটি। তাদের অফিস ছুটি দিয়ে দিয়েছে। সে যেমন আতঙ্কিত স্বরে বলল, বিষয়টি তেমনি। তার মন খারাপ বাবা থাকায় আমাদের সাক্ষাৎ হবে না নিয়মিত। আবার ফোনের ব্যবহারে স্বাধীনতা থাকবে না তার।

আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম হুমায়ূন আহমেদের অসাধারণ সৃষ্টি হিমু চরিত্র দিয়ে। যদি ফোন না থাকে তাহলে মনের সাথে মনের সংযোগে আমাদের অনুভবে কোথাও না কোথাও দুজনের সাক্ষাৎ হবে। হুমায়ূন আহমেদ এ পদ্ধতির নাম দিয়েছেন টেলিপ্যাথিক পদ্ধতি। কিছুদিন না হয় আমি হিমু আর তুমি রুপা হিসেবে কাটিয়ে দিলাম। আর সুযোগ হলে ফোনে কথা তো হবেই।

দেশের চলমান সংকটে আমার প্রস্তাব আফরোজার ভালো লাগলো। বেঁচে যদি না থাকি তাহলে দুজন দুজনকে পাবো না। ফলে আমাদের চলমান পরিস্থিতিতে সরকারি বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে এবং পরিবারের সবাইকে তা মেনে চলতে হবে। আমি আফরোজাকে পরামর্শ দিলাম, তোমার বাবা যেহেতু ঢাকা থেকে এসেছেন; সেহেতু উনাকে কিছুদিন একা থাকতে বলো। কারণ রোগটির জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় অনেক দিন থাকে। এটি খুব দ্রুত ব্যক্তি স্পর্শে ছড়িয়ে যায়। সরকারি নির্দেশনায় এমনটি বলা আছে।

আফরোজা বিষয়টি তার পরিবারকে বোঝাতে কতটা সক্ষম হয়েছিল, তা আমি জানি না। তবে তার কিছুদিন পর তার বাবা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলো। এর কিছুদিন পর সেই রোগে মারা গেলেন। অফিসের কারো দ্বারা হয়তো বা তিনি সংক্রমিত হয়েছিলেন। তবে তা প্রকাশ হতে সপ্তাহখানেক সময় লেগেছে। প্রশাসন তাদের এলাকা লকডাউন করলো। তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে সংকটে পড়লো পরিবারটি। জীবাণুর সংক্রমণ নিয়ে আতঙ্কিত হলো এলাকাবাসী। এখন আর কেউ ঘর থেকে বের হয় না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলছে, আফরোজার বাবার পরিণতি দেখে আজ সবাই সতর্ক।

আমি আমার হবু শ্বশুরের মৃত্যুতে যতটা ব্যথিত হলাম; তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত হলাম এ জীবাণু দ্বারা কি আফরোজা সংক্রমিত হয়ে মারা যাবে! আমি ভীত, আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। যদি এমনটি হয়, তাহলে আমিও এমন পরিস্থিতির বাইরে নই। কারণ আমি যে দুদিন আগে আফরোজার হাতে হাত রেখে গল্প করলাম। আবার বাড়িতে এসে আমার বাবা-মার সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশলাম। এখন কি পরিণতি হবে সবার! ঘড়ির কাঁটা যেন স্থির হয়ে আছে। রাতের গভীরতা বেড়ে এক ভয়ার্ত রূপ নিলো। বারবার চমকে উঠছি, আমি গুমড়ে কাঁদছি নীরবে। হয়তো আফরোজাও কাঁদছে নির্জনে, তার বাবার মৃত্যুশোকে!

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

এসইউ/জেআইএম