ফিচার

কেউ খবর নেয়নি খণ্ডকালীন শিক্ষকদের!

‘নিতান্ত নির্বোধ শুধু সেই জন, অমূল্য সময় করে বৃথাই যাপন।’ এমন অনেক ভাব-সম্প্রসারণ আমরা পড়েছি। এমনকি পড়িয়েছি বহু শিক্ষার্থীকে। যার মূলভাব হলো, সময়ের অবহেলা মানে জীবনকে অবহেলা করা। সে-ই বোকা, যে সময়কে মূল্য দিতে জানে না। সুতরাং সময়ের সদ্ব্যবহার যেকোনো ব্যক্তির জন্য উন্নতির শিখরে আরোহনের প্রধান চাবিকাঠি। এ ভাব-সম্প্রসারণের মূলভাবে ধরেই নিতে পারেন খণ্ডকালীন শিক্ষকরা নিজেদের অবহেলাই করছেন। নয়তো কী আর এ অসময়ে তাদের খবর নিতে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! অনেকটাই যেন দুর্ভাগ্য! কিংবা নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস। দিনের পর দিন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা খণ্ডকালীন শিক্ষকদের কথা কেউ মনে রাখেনি।

Advertisement

মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্কুল-কলেজগুলোতে যখন শিক্ষক সংকট ছিল, ঠিক তখন চাকরির পেছনে হন্যে হয়ে ছোটা যুবকরা নিতান্তই নামমূল্যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের সুযোগ পেয়েছিল। প্রতিষ্ঠানের যেমন তাদের প্রয়োজন ছিল; ঠিক তেমনই তাদেরও তখন কাজের খুব দরকার ছিল। হয়তো ভাগ্যদেবতা প্রসন্ন হওয়ায় মিলেছে অতিথি শিক্ষক কিংবা খণ্ডকালীন শিক্ষকের তকমা। প্রতিষ্ঠানই তাদের প্রাপ্য বেতন পরিশোধ করতো। টেনেটুনে কোনো রকমে জীবন পাড় করে যাওয়া আর কী। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন শিক্ষক রয়েছে। হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠানে কম, নয়তো কোনোটাতে বেশি। পরিসংখ্যান করে বের করাটাও কঠিন। তবে আনুমানিক বলে দেওয়া যায় যে, এমন প্রতিষ্ঠান হাতেগোনা খুব কমই আছে; যেখানে খণ্ডকালীন শিক্ষক নেই।

জাতির এ ক্রান্তিকালে হতভাগ্য খণ্ডকালীন শিক্ষকরা পড়েছেন বিপাকে। আত্মমর্যাদাপূর্ণ চাকরি হলো শিক্ষকতা। শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ড ভাবা হয়, সে মেরুদণ্ড সোজা রাখার কারিগর হলেন শিক্ষকরা। আপনি অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, খণ্ডকালীন শিক্ষকরা শিক্ষক নয়! এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মতই তারা শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন। কখনো কখনো মাসিক পে-অর্ডার পাওয়া শিক্ষকদের আক্রোশের মুখেও পড়েন। বলছি না যে, সব শিক্ষকের আক্রোশের মুখে পড়েন। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, এমনটাও ঘটে।

শত কষ্ট বুকে নিয়েও তারা দিব্যি তাদের কাজ করে যায় আপনমনে। কখনো মুখ ফুটে চাহিদার কথা বলতেও পারেন না। দেশের এ সংকটময় মুহূর্তে বেশ বিপাকে পড়েছেন শিক্ষক নামের মানুষ গড়ার কারিগররা। খণ্ডকালীন শিক্ষক হলেও নামের আগে তো শিক্ষক বলা হয়, তাই আত্মমর্যাদা তো অনেক বড়। কাউকে নিজেদের কষ্টের কথা বলতেও পারেন না।

Advertisement

খুশির খবর হলো, মাস শেষে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ঠিকই তাদের মাসিক বেতন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পেয়ে যাবেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান থেকে বিলি করা খণ্ডকালীন শিক্ষকরা আদৌ তাদের সামান্য এ বেতন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ সামান্য টাকার ওপর ভর করে হয়তো কারো কারো পুরো পরিবারের ভরণ-পোষণ চলে।

এমতাবস্থায় তারা কারো কাছ থেকে খুঁজে যে নেবে, সে সাহস কিংবা আমি বলবো দুঃসাহস দেখাবে না মনে হয়। কারণ তারা যে মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের আত্মসম্মানবোধ অনেক। তাদের অনেক শিক্ষার্থী হয়তো গাড়ি-বাড়ির মালিক। কিন্তু যারা আলো বিলান, তারাই যে অন্ধকারের নিচে বাস করেন; সে কথা ক’জনই বা জানেন।

আপনি ধরে নিতেই পারেন যে, এটা তো আর পার্মানেন্ট চাকরি নয়। সুতরাং তাদের কথা কেন চিন্তা করতে হবে? কিন্তু ভাবুন তো, এ মানুষটার কাছেই হয়তো আপনি শিখেছেন কীভাবে কলম ধরতে হয়, কিভাবে শুদ্ধ করে কথা বলতে হয়, কিভাবে হিসাব করতে হয়, কিভাবে জীবন চালাতে হয়। আপনার কাছে হয়তো তারা নিতান্তই অতিথি শিক্ষক, কিন্তু যারা তাদের কাছে শিখে গেছেন; তাদের কাছে যে মহান শিক্ষাগুরু।

তাই গুরু ভক্তির কথা স্মরণ করাতে চাই না, চাই না কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করতে। খণ্ডকালীন শিক্ষকদের কথা একবার ভাবুন। খোঁজ নিয়ে দেখুন, এ সংকটময় সময়ে কেমন আছেন তারা? ক্ষুধার জ্বালায় মরে গেলেও তারা বলবেন না, আমাকে একটু খাবার দাও। পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানের পেশায় আছেন তিনি, হোক না খণ্ডকালীন।

Advertisement

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী। এ দুঃসময়ে তিনি খণ্ডকালীন এসব শিক্ষকের পাশে দাঁড়াতে পারেন। শিক্ষামন্ত্রীসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এ যে সম্মানের পেশা, মাথা নত না করার পেশা। হীন অবস্থায় থাকলেও শির কিন্তু টান করেই রাখে খণ্ডকালীন শিক্ষকরা। কারণ সরকারি, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যেমন শিক্ষক, তেমনি খণ্ডকালীন শিক্ষকরাও শিক্ষক।

দেশে চাল, ডাল, ত্রাণ চোররা ঠিকই ভালো আছে। শুধু ভালো নেই, যারা বলতে পারছেন না লোকলজ্জার ভয়ে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রার্থনা, এ সংকটে আপনি খণ্ডকালীন শিক্ষকদের পাশে দাঁড়ান। আমরা সৃষ্টিকর্তার পরে আপনার দিকেই চেয়ে আছি।

এসইউ/পিআর