১৯০২ সালে ভারতের বোম্বেতে প্লেগ রোগের মহামারি দেখা দেয়। প্রথম দিকে ওই রোগে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা আক্রান্ত হয়। ফলে মুসলিম উলেমারা প্রচার করেন যে, মুসলমানদের শত্রু হিন্দুদের দমন করার জন্য আল্লাহর তরফ থেকে ওই রোগ প্রেরণ করা হয়েছে। মুসলিম উলেমাদের ওই ফতোয়ায় খুশি হয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের জন্য মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন করেন। নানা প্রান্তের নানা মানুষের আগমনের ফলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে মুসলিমদের ঘরে ঘরে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। কোনো ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ লাভের আগেই হাজার হাজার মুসলিম ওই প্লেগ রোগে মারা যায়। মুসলিম উলেমাদের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্ম নতুন নয়, ইতিহাসের পাতা ঘাটলে তার হাজার হাজার উদাহরণ দেয়া যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, সাধারণ মুসলিমরা ধর্মনেতাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন ওই কাজকর্ম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেননি।
Advertisement
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়া। সম্প্রতি ভারতের দিল্লি মারকাজের তাবলিগ জামাতের উলেমাদের আচরণ দেখে অথবা বাংলাদেশের আলেম-উলেমাদের একাংশের বাংলাদেশের সরকারের মসজিদে গণজমায়েত বাতিল করার প্রজ্ঞাপন প্রত্যাখান করার ঘটনা ইতিহাসের নির্মম ওই সত্যবাণীর কথা মনে করিয়ে দেয়। ভারতের তাবলিগ জামাতের আমির মাওলানা সাদের মতো বাংলাদেশের অনেক উলেমাও ইসলামে ছোঁয়াচে রোগ বলে কিছু নেই তত্ত্ব নিয়ে ব্যস্ত আছেন। মক্কা ও মদিনার সব মসজিদে জুম্মার নামাজ বন্ধে কারফিউ জারি করা হলেও উলেমারা সাধারণ মানুষকে মসজিদমুখী করতে নানা তৎপরতা চলাচ্ছেন। তাদের ওই ধর্মীয় গোঁড়ামির খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
দিল্লির মারকাজে তাবলিগ জামাতে অংশগ্রহণকারী অনেকে এখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে বাংলাদেশিও রয়েছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের বিশ্বব্যাপী প্রকোপ বিবেচনা করে ওই তাবলিগি গণজমায়েত বাতিল করা যেত। তাবলিগের সমাবেশে অংশগ্রহণ করা ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিধানের অংশ নয়। ঐচ্ছিক কাজ। বরং মানুষের জীবন রক্ষা করা মৌলিক বিধানের অংশ। ফরজ কাজ। কিন্তু গোঁড়াপন্থী ধর্মনেতারা ধর্মের এই সহজ বিধান উপলব্ধি করতে পারেননি। তারা ফরজকে বাদ দিয়ে ঐচ্ছিক নফল নিয়ে মেতেছিলেন। কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে থেকে তাদের ওই বালখিল্য আচরণের খেসারত দিতে হচ্ছে এখন ধর্মপ্রাণ অনেক সাধারণ মুসলিমকে।
অন্যদিকে ঢাকার মিরপুরসহ অনেক এলাকায় মসজিদ থেকেই করোনা ছড়িয়েছে। মসজিদের ইমাম করোনায় প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন করোনার কোনো ধর্ম নেই। করোনা হিন্দু-মুসলিম, পাপী-পুণ্যবান চেনে না। করোনায় যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। করোনার ধর্মই হচ্ছে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হওয়া। তাই করোনা প্রতিরোধে সাধারণ মুসলিমদের উচিত গোঁড়াপন্থী উলেমাদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের পরামর্শ গ্রহণ করা। আর সাধারণ মানুষ যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তাহলে হয়তো বাংলার মানুষকে আরও বড় খেসারত দিতে হবে। মৃত্যুর মিছিলে বাংলাদেশ স্পেন-যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।
Advertisement
উলেমাদের উৎসাহে সাধারণ মানুষের অনেকেই করোনাভাইরাসকে ছেলেখেলা মনে করছেন। অনেকে ভাবছেন, করোনাভাইরাস তো সামান্য জ্বর-সর্দি-কাশি, এ আর এমনকী! কিন্তু চীনের উহানের পর ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে বোঝা যায় করোনাভাইরাস কতটা ভয়ংকর। ওই দেশগুলোতে দিনে হাজার মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সবচেয়ে উন্নত জীবন ও চিকিৎসাব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও উন্নত বিশ্বের ওই দেশগুলো মানুষের মৃত্যর মিছিল থামাতে পারছে না।
যদিও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে রোগের মাত্রা বিবেচনায় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই মৃত্যুর মিছিল থামানো যেত। চীনের প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও ম্যাকাও, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান তার বড় উদাহরণ হতে পারে। চীনে যখন করোনাভাইরাস আক্রমণ করেছে তখন ওই রাষ্ট্রগুলো তাদের পূর্ববর্তী সার্স ভাইরাস মোকাবিলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রথম থেকেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
করোনাভাইরাসের টিকা ও ওষুধ না থাকায় তারা প্রধানত দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এক. যারাই ওই সময় ওই দেশে প্রবেশ করেছেন তাদের সবাইকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা করেছে। দুই. আক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিক বিছিন্নতার নীতি মেনে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে বা অন্যদের থেকে আলাদা রেখেছেন। ফলে করোনাভাইরাসের জীবাণু কেউ বহন করলেও একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষ এখনও যদি যথাযথভাবে সামাজিক বিছিন্নতার নীতি মেনে চলেন তাহলে আশা করা যায় করোনাভাইরাস বাংলাদেশে দুর্বল হয়ে পড়বে। জাতিসংঘ যে এই অঞ্চলে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করছে তা মিথ্যা প্রমাণিত হবে।
আর জাতিসংঘের ওই জরিপ মিথ্যা প্রমাণ করতে হলে সামাজিক বিছিন্নতার নীতি কঠোরভাবে মেনে সব ধরনের গণজমায়েত এড়িয়ে চলতে হবে। মসজিদও এর বাইরে নয়। তাই উলেমাদের কথায় বিভ্রান্ত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করাই সাধারণ মানুষের প্রধান কর্তব্য হবে। মনে রাখা দরকার, আল কুরআনে ও হাদিসে আল্লাহ জ্ঞানীদের বা উলেমাদের পরামর্শ গ্রহণ করতে বলেছেন। কিন্তু সেই উলেমা বা জ্ঞানী মানে বাংলাদেশের কথিত উলেমা বা আলেম সমাজ নয়। কারণ করোনাবিষয়ক পরামর্শ দেয়ার জন্য যে ধরনের বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান থাকা দরকার তা এদেশের উলেমাদের নেই। আর বর্তমান উলেমারা মসজিদ খোলা রাখার পক্ষে যে সওয়াল-জওয়াব করছেন তার মূল কারণ ধর্ম নয়, অর্থনীতি।
Advertisement
উলেমাদের একটি পক্ষকে সরকার করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জানাজা ও দাফন-কাফনের কাজে নিয়োজিত করেছেন। অন্যপক্ষকে সম্পৃক্ত না করায় তারা এখন মসজিদে নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। পাশাপাশি অনেকের রুটি-রুজির সংস্থান হয় মসজিদে ইমামতি বা মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে। তাই অনেকে মনে করছেন মসজিদ বন্ধ হয়ে গেলে তাদের বেতনও বন্ধ হয়ে যাবে। জুম্মার দিনে সাধারণ মুসলিমদের নিকট থেকে যে হাদিয়া পেতেন তাও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
সরকার যদি ইমামদের দুই মাসের অগ্রীম বেতন প্রদান করে মসজিদ বন্ধ করার কথা ঘোষণা করত তাহলে রাজনৈতিক কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণে কোনো ইমামই সরকারি নির্দেশের বিরোধিতা করতেন না। কারণ তারা জানেন তারা সরকারি নির্দেশের বিরোধিতা করে যে বক্তব্য প্রদান করছে তা ইসলাম সম্মত নয়। কিন্তু নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখতেই তারা ওই সব বলছেন। সরকারি নির্দেশনার বিরোধিতা করছেন। সাধারণ মানুষকে এই বিষয়গুলো বোঝা দরকার।
উলেমাদের মধ্যে যারা মসজিদে নামাজ পড়া সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশের বিরোধিতা করছেন তার মূল কারণ রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক। আর ওই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে লাভবান হওয়ার জন্য উলেমাদের ওই অংশ সাধারণ মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করতে চাইছে। তাই সাধারণ মানুষের উচিত হবে সরকারি নির্দেশ মেনে ঘরে অবস্থান করা। ঘরে নামাজ আদায় করা। উলেমাদের বদলে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের পরামর্শ মেনে চলা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/বিএ/এমএস