মতামত

প্রয়োজন দেশব্যাপী লকডাউন আরও কঠোর পদক্ষেপ

মানুষের পদভারে, কর্মকোলাহলে, যন্ত্রের গর্জনে শুরু হওয়া দিনগুলো আজ সারা পৃথিবীতে থমকে দাঁড়িয়েছে। মানবসভ্যতা এক অভাবনীয় সংকটের মধ্য দিয়ে সময় অতিক্রম করছে। ‘করোনাভাইরাস’- এক অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে, তার আক্রমণের ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে পৃথিবীর প্রাণস্পন্দন।

Advertisement

দেশে দেশে চলছে লকডাউন, শাটডাউন, জনতার কারফিউ, কারফিউ। তারপরও প্রতিদিন আতঙ্কে হিম সময় অতিক্রম করছে মানুষ। বাংলা ভাষার এক কবি লিখেছিলেন : ‘এই মৃত্যু, উপত্যকা আমার স্বদেশ নয়’- কিছু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। আজ তার সেই পঙতি যেন রূপান্তরিত হয়ে ‘স্বদেশ নয়’-এর স্থলে ‘এই মৃত্যু, উপত্যকা আমার পৃথিবী নয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিদিন মৃত্যুর হিসাব কষছে এই গ্রহের মানুষ- কতজন সর্বশেষ নিষ্প্রাণ হলেন মৃত্যুর তালিকায় ‘সংখ্যা’রূপে। মানুষ এখন একটি ক্রমিক নম্বর মাত্র। যেন আমরা সবাই মৃত্যুর মিছিলে শামিল।

এমন এক অভাবনীয় পরিস্থিতিতে কাজ করতে হচ্ছে ডাক্তার, নার্স, ব্রাদার, স্বাস্থ্যকর্মীদের। কাজ করতে হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীদেরও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডাক্তারসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের কাজ করতে হচ্ছে রোগ সংক্রামক প্রতিরোধকারী পোশাক ও সামগ্রী ছাড়াই।

Advertisement

পিপিইর সংকট শুধু দেশে নয়, পৃথিবীব্যাপী। যুক্তরাজ্যে ডাক্তাররা ময়লা ফেলার প্লাস্টিক ব্যাগ কেটে ভঙ্গুর পিপিই বানিয়ে মানবসেবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যখন করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে, তখন আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তার পেশাগত পরিচয়ে ডাক্তার হিসেবে রোগীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাই মানবতার ডাকে কাজ করছেন।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমকর্মীরাও মানবতার সেই লড়াইয়ে পিছিয়ে নেই। মানবসেবায় ব্রতী ডাক্তার যেমন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তেমনি গণমাধ্যমকর্মীরাও আক্রান্ত হয়েছেন। কয়েকটি সংবাদপত্র ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়ে এই দুঃসময়ে তাদের মুদ্রণ স্থগিত করেছেন। একটি ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম তাদের ৪৭ জন কর্মীকে করোনাঝুঁকির কারণে আইসোলেশনে পাঠিয়েছে। অধিকাংশ সংবাদপত্র এখন পর্যন্ত মুদ্রিত সংস্করণের প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছে। পেশাগত দায়িত্বশীলতার অংশ হিসেবে আমাদের কর্মীরা প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখেও প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে কাজ করে চলেছেন। পূর্ণোদ্যমে চলছে অনলাইন।

২.

‘প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’- আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে এ কথা বলা হয়েছে। তাই মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী করোনাভাইরাসে এই অপমৃত্যুর মিছিল মৃত্যুকে যেন মানবজাতির আত্মসমর্পণের এক অসহায়তার সাক্ষী করে তুলেছে। প্রথিতযশা এক মনীষী বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে আসার পথ একটি; কিন্তু যাওয়ার পথ অসংখ্য।’ করোনাভাইরাস তার জিন পাল্টে পাল্টে যেন সেই অনেক পথের জায়গা একাই দখল করে বসেছে। আর সে কারণেই করোনার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়তে হবে পৃথিবীবাসীকে।

Advertisement

মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘স্বাস্থ্যের অধিকার’। সেই অধিকারকে যে আমরা পৃথিবীব্যাপী অবহেলিত রেখেছি- সাম্প্রতিক করোনা-সংকট সেই অবহেলাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। যে অধিকারকে আমরা ‘তুচ্ছ’ করেছি, সেই অধিকারের জন্য আজ ‘উচ্চমূল্য’ দিয়েও ক্ষতি পূরণ করা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে দিকনির্দেশনাগুলো দিয়েছেন সেটা আমাদের সবার অনুসরণ করা প্রয়োজন এ মুহূর্তে। আগামী কয়েক সপ্তাহ আমরা ঘরে থেকে শুধু নিজেদের ঘরই নয়, বাঁচাব পৃথিবীকেও।

৩.

দেশে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিভিন্ন দেশে মারা যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালি। সংক্রামক এই রোগকে কোনোক্রমেই অবহেলা করার অবকাশ নেই।

বৈশ্বিক এবং দেশীয় বাস্তবতাকে গভীরভাবে আমলে নিয়ে সরকারের গৃহীত বহু ব্যবস্থার মধ্যেও দুটি মারাত্মক বিচ্যুতি ঘটে গেছে, যা অমানবিক এবং দুঃখজনক। গার্মেন্টকর্মীদের ছুটিতে গাদাগাদি করে গ্রামে চলে যাওয়া এবং ছুটি শেষ হয়েছে বলে ঢাকায় ফিরতে বলার ঘটনায় চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় মিলেছে। এর মাশুলটা হতে পারে ভয়াবহ। এখনই গোটা দেশ লকডাউন করা প্রয়োজন। এই উদ্যোগ নিতে যত দেরি হবে, ক্ষতি হবে তত। প্রয়োজন হতে পারে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের।

৪.

পৃথিবীব্যাপী চলছে শাটডাউন, লকডাউন, জনতার কারফিউ- এই মুহূর্তে ঘরে অবস্থান করা একটা বড় কর্তব্য। বড় কাজ। ‘শারীরিক’ দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং বৈশ্বিক দায়িত্ব পালনের ঐতিহাসিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে পৃথিবী নামের এই গ্রহবাসীর। আমরাও তার বাইরে নই।

এই মুহূর্তে সবাই ঘরে অবস্থান করে শুধু নিজেকে, নিজের স্বজনদেরই আমরা রক্ষা করব না, আমরা রক্ষা করব গোটা পৃথিবীকে। মানুষকে বাঁচাতে, মানবসভ্যতাকে বাঁচাতে এই মুহূর্তে ঘরে থাকাটাই একটা যুদ্ধ। এই নতুন মাত্রার যুদ্ধে আমরা হেরে যাব যদি ঘরে না থাকি। যদি না স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। এই মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় ধর্ম- আমি যেন আরেকজনকে আক্রান্ত করে মৃত্যুবীজ ছড়িয়ে না দিই!

৫.

বাংলাদেশের সব দুর্যোগ ও দুঃসময়ে সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যমগুলো জাতির কাছে সঠিক দিকনির্দেশনা ও করণীয় তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যম ষোলো কোটি মানুষের ভরসার জায়গা হিসেবে সব সময় কাজ করেছে এবং তার প্রমাণ রেখেছে। বর্তমানে এই অভাবনীয় দুর্যোগেও নানা বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের অপনোদনে সঠিক তথ্য জনগণের কাছে তুলে ধরছে দেশের সংবাদকর্মী এবং সংবাদমাধ্যমগুলোই।

আমরা এই দুঃসময়ে দেশের মানুষের পাশে সঠিক তথ্য পরিবেশনে অবিচল থেকে কাজ করে যাব, ইনশাআল্লাহ। আর এ জন্য প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ঐকান্তিক সাহায্য ও সহযোগিতা।

৬.

করোনা পাল্টে দিচ্ছে আমাদের জীবনযাপনের প্রচলিত ধারণাকে। পাল্টে দিচ্ছে সমাজবদ্ধতার ধারণাকেও। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগেও আমরা যদি প্রযুক্তির সহায়তায় ‘শারীরিক দূরত্বে’ থেকে ‘সামাজিক ঐক্য’ গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে একে অপরের বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াব, নিজেরা নিজেদের অজান্তেই। কেননা করোনা রাজা-প্রজা বাছ-বিচার করে না। তাই ছোট-বড় সবাইকে সামাজিক ও মানবিক দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

৭.

আমাদের এই গ্রহ শুধু মানুষের জন্য, মানুষের একচ্ছত্র ভোগের সামগ্রী নয়। এই গ্রহের মাটিতে-জলে-বাতাসে স্রষ্টার সৃষ্ট সব প্রাণের রয়েছে অধিকার। করোনা আজ আমাদের ভেতর সেই সর্বপ্রাণ অধিকারের চেতনাকে উজ্জীবিত করুক।

আপনারা ঘরে থাকুন, আমরা বাইরে আছি আপনাদের জন্য। ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, জনসেবার জন্য প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, গণমাধ্যমকর্মী- আমরা আপনাদের প্রয়োজন পূরণেই বাইরে আছি। আমাদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করুন।

আশা করি, এই দুর্যোগ অতিক্রান্ত করতে পারব আমরা। মৃত্যুর পৃথিবী নয়, জীবনের পৃথিবী নির্মাণ করা সম্ভব সবার সম্মিলিত সহযোগিতায়।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর ওসভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব।

এইচআর/বিএ/জেআইএম