মতামত

করোনা সংক্রমণ ও গাজীপুর সিটি মেয়রের উদ্যোগ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ৩১ দফা নির্দেশনা আসার পর মানুষের জীবন বাঁচাতেই করোনাভাইরাসের কিট আমদানি করেছেন গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। যেহেতু ১৪ মার্চ বিমানবন্দরে পৌঁছে কোয়ারেন্টাইনে থাকার পর গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় পঞ্চাশের অধিক ইতালি প্রবাসী বাড়ি ফিরেছেন সে জন্য করোনাভাইরাস বিস্তারের একটা সম্ভাবনা আছে ধরে নিয়েই তিনি জনস্বার্থে কাজ করছেন। আমরা সকলে জানি, যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে ইতালি। গত ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ইতালিতে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি।

Advertisement

অন্যদিকে গাজীপুরেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। ২০১৮ সালে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সিটি এলাকার উন্নয়নে মনোযোগী হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম। ২০১৯ সালে দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা অভিযোগে নিজের অফিসের ১৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তিনি।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সে সময় নির্বাচিত বিএনপি সমর্থিত মেয়র ওই এলাকার উন্নয়নে কোনো কাজই করেননি। বরং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দাদের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করেন। পক্ষান্তরে জাহাঙ্গীর আলম মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। এ মুহূর্তে করোনাভাইরাসে পতিত বৈশ্বিক দুর্যোগে নিজের দেশের মানুষকে সহায়তা করতে তিনি নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।

৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বর্তমানে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দুইশর ওপরে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিতভাবে সরকারি কর্মকর্তা-চিকিৎসক এবং দেশবাসীকে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ইতোমধ্যে ৩১ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি অফিস-সংস্থা-সংগঠন এবং জনপ্রতিনিধিদের তাগাদা দিয়েছেন। ভাইরাস মোকাবিলার পথ-নির্দেশ এবং জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব স্পষ্ট রয়েছে নির্দেশনার কয়েকটিতে। যেমন- ‘করোনাভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। লুকোচুরির দরকার নেই, করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। পিপিই সাধারণভাবে সকলের পরার দরকার নেই। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবার জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। এই রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্কসহ সব চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সব চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ সংশ্লিষ্ট সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনে আছেন, তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে। নিয়মিত হাতধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন। নদীবেষ্টিত জেলাসমূহ নৌ-অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে হবে। সারাদেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। ...’

Advertisement

নির্দেশনায় আরও আছে- ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজের সব স্তরের জনগণকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রশাসন সবাইকে নিয়ে কাজ করবে। জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসন ওয়ার্ডভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করে দুস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ করবেন।’

অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক স্পষ্টভাবে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আর এই কারণে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম তৎপর হয়েছেন মানুষের জীবন রক্ষার কাজে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে র‌্যাপিড কিট আমদানি করেছেন তিনি। র‌্যাপিড টেস্ট কিট দ্রুত সময়ের মধ্যে ‘করোনাভাইরাস শনাক্ত’ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক জনপ্রতিনিধি হিসেবে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি ছাড়াই তিনি জনগণের উপকারের কথা ভেবে নিজের উদ্যোগে এসব কিট আমদানি করেছেন। রোগ নির্ণয়ের জন্য নানা জায়গায় বিতরণও করেছেন। কিন্তু মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের এই কিট আমদানিকে কেন্দ্র করে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিষয়টিকে নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশ করছে। তবে দেশের এই সংকটের সময়ে অনুমোদনের জন্য বসে না থেকে মানুষের কল্যাণে আমদানি করা কিটগুলো বিতরণের দাবি করেছেন সাধারণ মানুষ।

এ বিষয়ে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম মিডিয়াকে জানিয়েছেন, ‘চীন এই কিট ব্যবহার করেই করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সফল হয়েছে। তাই দেশের এই দুঃসময়ে আমি নিজের টাকায় এসব কিট আমদানি করেছি। এখানে সিটি করপোরেশনের এক পয়সাও খরচ হয়নি।’ অনুমোদন ছাড়া আমদানির বিষয়ে মেয়র বলেন, ‘আইন আগে না, মানুষের জীবন আগে? আমি মানুষের জীবন বাঁচাতেই এই কাজ করেছি। মানুষ যখন মৃত্যুর ঝুঁকিতে, তখন কোনো আইন চলে না। মানবতার কল্যাণের জন্যই আমি করোনা ভাইরাসের র‌্যাপিড কিট আমদানি করেছি। মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে আমি কোনো অপরাধ করিনি।’

তিনি ৫০ হাজার কিট আমদানি করেছেন। এছাড়া চীনে আরও ১ লাখ কিট প্রস্তুত আছে। চাইলে সেগুলোও তিনি আনতে পারবেন। তার মতে, ‘বাংলাদেশে যেসব কিট এনেছি, সেগুলো আমি বিভিন্ন হাসপাতালে দিয়েছি। এছাড়া আমার স্টকে কিছু আছে।’

Advertisement

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর দ্বারা এগুলোর মান নির্ণয় করা না হলেও র‌্যাপিড কিট আমদানি আমাদের জন্য অবশ্যই একটি সুখবর। কারণ যেখানে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরির সুবিধা নেই, সেসব এলাকায় র‌্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহার করা যেতে পারে। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ীই এসব কিট ব্যবহার করা হবে। বিশ্বজুড়ে মহামারির মধ্যে দেশের বিপদ মোকাবিলার জন্য গাজীপুরের মেয়র র‌্যাপিড টেস্ট কিট ছাড়াও পারসোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) আমদানি করেছেন। তিনি র‌্যাপিড টেস্ট কিট আমদানি করে ইতোমধ্যে অন্যান্য জেলায়ও দিয়েছেন। পাবনার বেড়া এবং নাটোরের সিংড়া উপজেলায় এ ধরনের ২০০ টেস্ট কিট দিয়েছেন তিনি। ওইসব জায়গায় পিসিআর মেশিন না থাকায় এই টেস্ট কিট কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম অনুমতি নেয়ার দীর্ঘসূত্রিতার পথে না হেঁটে দ্রুত সময়ে কিট আমদানি করেছেন- আমাদের মতে, এতে তিনি কোনো অপরাধ করেননি। কারণ ব্যবহার করার আগে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এগুলোর মান নির্ণয় করলেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে। তাছাড়া মনে রাখতে হবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশ যখন সংকটে তখন এক দল সুবিধাভোগী মহল শেখ হাসিনা সরকারের অর্জনকে বিভিন্নভাবে হেয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে বিচিত্র গুজব রটানো হচ্ছে। বিশেষত করোনা আক্রান্ত ২১৮ জন নয় হাজার জন, করোনা রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা মিলবে না, সরকারের কোনো ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে চলছে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

অথচ ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরলস দায়িত্ব পালনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন, আবার তিনি কর্তব্যে অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন। করোনা মহামারি থেকে জনগণকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজে যেখানে প্রতিনিয়ত নজরদারিতে রেখেছেন সমস্ত কর্মকাণ্ড সেখানে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ব্যক্তিগত খরচে কিট আমদানির বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসিত হবে। কারণ মান যাচাই না করে সেগুলো ব্যবহৃত হবে না- এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি।

শেখ হাসিনা সরকারের সতর্ক দৃষ্টি এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপকহারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা গেছে। যদিও জাতিসংঘের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে এমন ভয়াবহ সংকট আর সৃষ্টি হয়নি। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে সামষ্টিক স্বার্থে সামাজিক দূরত্ব মেনে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে এবং ঘরে বসে স্বাধীনতা উপভোগ করার আহ্বান জানান হয়েছে। দেশে যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী মজুত রয়েছে। করোনা মোকাবিলায় ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

নিম্নআয়ের মানুষদের ‘ঘরে ফেরা কর্মসূচি’র আওতায় নিজ নিজ গ্রামে সহায়তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনী মাঠে থাকায় দেশের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে। উপরন্তু এই সংকট মুহূর্তে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের উজাড় করে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। করোনা প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার স্বাস্থ্যসেবায় নবতর ব্যবস্থার উন্নতি করে চলেছে। আর দেশের এই চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় করোনা টেস্টে চিকিৎসকদের সহায়তার জন্য গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের সক্রিয় ও মহতী উদ্যোগও গুরুত্বের সঙ্গে সকলের কাছে স্বীকৃতি পাচ্ছে।

লেখক : বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্টসাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরামএবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/বিএ/জেআইএম