করোনাভাইরাস নতুন রোগ, আর কখনো এই ভাইরাস পৃথিবীতে দেখা যায়নি। তবে বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা একেবারে মেধাশূন্য নয় যে এটিকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। সার্সসহ এর সমগোত্রীয় ভাইরাস তারা আগে দেখেছেন এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে সফল হয়েছেন। সেই কারণে এখনো যে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসবে- এটা মানুষের বিশ্বাস আছে। তবে মানুষকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুসারে নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে চলতে হবে, যেন ভাইরাসটির প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত ব্যাপকভাবে না ছড়ায়।
Advertisement
কোভিড-১৯ এর আক্রমণ নির্বিচার এবং গমনাগমন বিশ্বের সর্বত্র। বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন। স্পেনের রাজকুমারীর মৃত্যু হয়েছে। ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল ছিল চীনের উহানে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই কারণে ভাইরাসের নাম দিয়েছেন ‘চাইনিজ ভাইরাস’। শুরু থেকে পাত্তা দেননি, জনগণকে সতর্ক করেননি। এখন নিজে আক্রান্ত কিনা দুইবার পরীক্ষা করিয়েছেন। করোনার আক্রমণে বিধ্বস্ত আমেরিকা, বিব্রত ট্রাম্প। আক্রমণ আর মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না।
প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত কোভিড-১৯ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। এটি থেকে বাঁচার আপাতত উপায় হলো সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টাইন। বাসায় বসে থাকা, লোকালয়ে না যাওয়া। আক্রান্ত হয়ে গেলে আইসোলেশনে যাওয়া। সরকার এবং ডাক্তারদের নির্দেশনা মানা।
আমাদের বয়স কম হয়নি। আমরাও অপ্রতিরোধ্য বহু রোগ দেখেছি। ওইসব রোগে আক্রান্ত হলে উপায় থাকত না হয়তো মৃত্যু হতো না হয় অঙ্গহানি হতো। গ্রামে একটি রোগের নাম ছিল অবিরাম জ্বর। কবিরাজরা শান্নি বাত বলত। ৯৯ প্রকার বাত নিয়ে কবিরাজি শাস্ত্রের চর্চা। মাথাব্যথা হলে শিরবাত, গিরায় ব্যথা হলে গেটে বাত, ইত্যাদি। অবিরাম জ্বর হলো বর্তমান যুগের টাইফয়েড। এখন ডাক্তারের পরামর্শে কয়েকটি ক্যাপসুলের এক কোর্স খেলে সব খতম। ১৯৫৬ সালে প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত এই অবিরাম জ্বর ভয়াবহ রোগ ছিল। এখন একে কেউ কোনো গুরুত্বই দেয় না। করোনাকেও আগামী দিনের মানুষ একইভাবে গুরুত্বহীন রোগ ভাববে। স্রষ্টা মানুষকে মেধা দিয়ে তৈরি করেছেন। মানুষ তার মেধা দিয়ে পরিত্রাণের উপায় বের করে ফেলে।
Advertisement
ইসলামী দর্শনে বলে স্রষ্টার মনে প্রেম জন্মেছিল মাটির পুতুল তৈরি করার জন্য। তাই তিনি মানবজাতির সৃষ্টি করেছেন। স্রষ্টার প্রেমে মানবজাতির সৃষ্টি সুতরাং এখন যা হচ্ছে তা হলো প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমাস্পদের লীলা। আল্লাহ চাহে তো অচিরেই প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়ে যাবে। আপনার লক্ষ্য করে দেখবেন কুকুরও জলাশয়ে নেমে পা ধুয়ে আসে। আর পাঁচটি কুকুর যদি এক জায়গায় ঘুমায় তারা একে অপরের থেকে চার-পাঁচ ফুট ব্যবধানে ঘুমায়। নির্বাক কুকুর যদি তার সৃষ্টির হুকুম মানে তবে সর্বোত্তম জ্ঞানী প্রজাতি মানুষ কেন মানবে না! না মানা তো তোয়াক্কা না করার স্বভাব। তোয়াক্কা না করলেই তো শাস্তি।
চীন করোনাভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেছে। সুতরাং মূল জিনিসটাই যখন মানবজাতির হাতে এসে গেছে তখন প্রতিষেধক আবিষ্কার সময়ের ব্যাপার মাত্র। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠিত করে তুলেছিল প্লেগ রোগ। পাঁচ বছর স্থায়ী হয়েছিল এই রোগ। তখন সারাবিশ্বে ১৫ কোটি আর ইউরোপে পাঁচ কোটি লোকের প্রাণহানি হয়েছিল। তখন ছিল বিজ্ঞানের প্রিমিটিভ স্টেজ। এখনতো বিজ্ঞানের চূড়ান্ত বিকাশ হয়েছে। মানুষ প্লেগের মতো পাঁচ বছর ভোগান্তিতে পড়বে না। সুতরাং অল্প কয়দিন নিজেদের চলাফেরা সীমিত করতে অপারগ হবে কেন!
নারায়ণগঞ্জের মেয়র কারফিউ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ মানুষের চলাচল বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয় নারায়ণগঞ্জ ও মাদারীপুরের শিবচরে। পরে ঢাকার বাসাবো, টোলারবাগসহ ঢাকার বাইরে ১৮ জেলায় ছড়িয়ে গেছে। এখন করোনাভাইরাস ছড়ানোর একটা অন্যতম বড় স্থান নারায়ণগঞ্জ। সারাদেশেই নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কোভিড-১৯ রোগী পাওয়া যাচ্ছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা ও স্থানীয় লোকজনের কথায় উঠে এসেছে, লকডাউনে দেরির সুযোগ নিয়েছে করোনা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ৮ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ২১৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২০ জন মারা গেছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৩৩ জন। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল আর ১৮ মার্চ প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। নারায়ণগঞ্জে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৩৮ জনের মধ্যে এ ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। এ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে মারা গেছেন ৫ জন। আরেকজন করোনার লক্ষণ নিয়ে মারা গেলেও তার পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায়নি।
Advertisement
নারায়ণগঞ্জ শিল্প এলাকা সেখানে শ্রমিকবস্তি বেশি। তাদের এখন চাকরিও নেই। মেয়র আইভীকে অনুরোধ করব বস্তিতে খাওয়ার অথবা রিলিফ সরবরাহে সহায়তা করার জন্য। ভুখা মানুষ ভোগের জন্য দৌড়াদৌড়ি করবেই। যেভাবে ধীরে ধীরে করোনা ঢাকা শহরে ছড়াচ্ছে তার গতি যদি তীব্র হয় তবে ১৫-২০ দিনের উপরে সামাল দেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই।
ইতালির মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী একমাসের মাথায় বলতে বাধ্য হয়েছেন- আসমানের দিকে হাত তোলা ছাড়া এখন উপায় নেই। সুতরাং বাংলাদেশের মানুষের সংযমী আচরণ শুধু তাদেরকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে। যে সমস্ত এলাকায় করোনা প্রসারমান সেইসব এলাকায় ব্লক ব্লক করে কারফিউ দেয়া সম্ভব কিনা চিন্তা করা দরকার। আর মানুষের বোঝা দরকার আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হলে দাফন-কাফনের জন্য লোক এগিয়ে আসছে না। নিজের করুণ পরিণতির কথা চিন্তা করেই মানুষ যেন সংযত হয় সেই অনুরোধ করব।
তাবলিগ জামাতের মুরুব্বিদের অনুরোধ করব তারা যেন এখন দাওয়াতি কাজ বন্ধ করে দেন। দ্বীন পালনের অর্থ এই নয় যে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনা। তাবলিগ জামাতের কাজ হলো সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত থাকা, আল্লাহর দ্বীনের হুকুম-আহকাম সহিহভাবে পালনের শিক্ষা দেয়া। আর জিকিরে জিকিরে আল্লাহকে স্মরণ করা। অন্ধত্ব, ধর্মীয় গোড়ামি, জ্ঞানহীনতা, পশ্চাদপদতা প্রদর্শন নয়। অথচ সঠিক নেতৃত্ব আর সামান্য ভুলের জন্য এখন এই নিরীহ লোকগুলো ভারতে নিন্দার মুখোমুখি হয়েছেন। আমি নিজেও তাবলিগের এমন আচরণের বিরোধী।
তাবলিগের উৎপত্তি ও প্রসার ভারত থেকেই কিন্তু তাদের স্মরণে রাখা উচিত ছিল যে ভারত মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র নয়। মুসলমানদের নিচু করে দেখানো, হয়রানি, নির্যাতনের জন্য হিন্দু মৌলবাদী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রদায়িক সরকার আর তার পোষ্য চরম সাম্প্রদায়িক কিছু মিডিয়া রয়েছে। সরকারের নির্দেশ না মেনে এই সময়ে একই ধরনের আচরণ গোড়া হিন্দুরা করলেও সেইসব মিডিয়া সাম্প্রদায়িক ভাইরাস ছড়ায় না। সুতরাং তাবলিগের ইচ্ছামতো যা ইচ্ছা তা করা কখনই উচিত হবে না।
তাবলিগের ঢাকায় কাকরাইলের মসজিদের মুরব্বিদের অনুরোধ করব তারা যারা মসজিদে আটকা পড়েছেন, ছয়জন করে ভাগ হয়ে যেন খতমে কোরআনে বসে যান। অন্য সময় হলে রমনা পার্কে বসতে বলতাম, এখন তা উচিত হবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার ৩০ জন আলেমকে দিয়ে দিল্লির লালকেল্লায় অবিরাম খতমে কোরআনের ব্যবস্থা করেছিল এবং তা পাঁচ বছরব্যাপী স্থায়ী হয়েছিল। এখন করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সরকারের নির্দেশনা মেনে চলা আর সর্বতোভাবে স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ ব্যতীত কোনো উপায় নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com
এইচআর/বিএ/জেআইএম