জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসির পরোয়ানা জারি হয়েছে। মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে পাকিস্তান-লিবিয়া-ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থাকা এ আসামি সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়ার পর বুধবার (৮ এপ্রিল) তাকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ও মামলার রায় পড়ে শোনান বিচারক। এরপর তার ফাঁসির পরোয়ানা ইস্যু করা হয়। আইনি প্রক্রিয়া যখন এভাবে এগোচ্ছে, তখন অনেকেরই মনে প্রশ্ন, আত্মস্বীকৃত এই খুনি কি আপিল করতে পারবেন? আপিল করলেও কি গ্রহণ হবে? তার ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের পরবর্তী প্রক্রিয়াইবা কী?
Advertisement
এসব বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা। একপক্ষের মতে, এই রায়ের বিরুদ্ধে আর আপিলের সুযোগ নেই। সরকার চাইলে যে কোনো সময় মাজেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারবে। অন্যপক্ষের অভিমত, এই আসামি শেষ সুযোগ হিসেবে তামাদি আইনে লিভ টু আপিল করতে পারবেন। এক আইনজীবী বলেছেন, আপিল বিভাগের রায়ের রিভিউসহ আইনি সব প্রক্রিয়া শেষ। এখন রাষ্ট্রপতির কাছে মার্সি পিটিশন (প্রাণভিক্ষার আবেদন) করতে পারবেন মাজেদ। তবে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আপিল ও দণ্ড কার্যকরের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
মাজেদের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘তিনি (ক্যাপ্টেন মাজেদ) বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়ার পর বিচারিক আদালত এবং হাইকোর্টের পর আপিল বিভাগও তাকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডায়িত করেন। এখন গ্রেফতারের পরপরই মাজেদের বিরুদ্ধে রায় কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই এ রায় কার্যকর করা হবে।’
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর হওয়ায় এই মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
Advertisement
দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকা আসামি মাজেদ গ্রেফতার হয়েছেন, তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া কী হবে, জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার একজন আসামি এতোদিন গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরে গ্রেফতার হয়েছেন। এখন চাইলে তিনি আপিল আবেদন করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। এতোদিন পালিয়ে থেকে একজন আসামি আপিল করলেই তার আপিল আবেদন গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে না। এখন তার দণ্ড কার্যকরের পালা। বিচারিক আদালত থেকে মৃত্যু পরোয়ানা গেলেই কারা কর্তৃপক্ষ তার ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে।’
এ বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ উদ্দিন ফকির জাগো নিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার একজন আসামি এতোদিন পর গ্রেফতার হয়েছেন। যেহেতু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি সুপ্রিম কোর্টে হয়ে গেছে। তাই এতোদিন পালিয়ে থেকে এ আসামি আপিল করলেই তার আপিল গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে না। এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
একই ধরনের অভিমত দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই আসামির মৃত্যুদণ্ড কনফার্ম করেছেন হাইকোর্ট। এরপর আপিল বিভাগও তা বহাল রেখেছেন। রিভিউ নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে মার্সি পিটিশন (প্রাণভিক্ষার) আবেদন করার সুযোগ রয়েছে এই আসামির। তা না হলে বিচারিক আদালত থেকে মৃত্যু পরোয়ানা গেলেই কারা কর্তৃপক্ষ তার ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে।’
এ বিষয়ে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসামিতে তো এতোদিন পলাতক ছিলেন। হাইকোর্টে তার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন। ডিলে (বিলম্বিত) হওয়ার উপযুক্ত কারণ তুলে ধরে তিনি আইন অনুযায়ী আপিল করতে পারবেন। সেটা গ্রহণ করা না করা সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার।’
Advertisement
তিনি বলেন, ‘এখন এই আসামি আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করার সুযোগ পাবেন। লিভ টু আপিল খারিজ হয়ে গেলে তিনি রিভিউ করারও সুযোগ পাবেন। তবে, তাকে আবেদনে এতোদিন লিভ টু আপিল না করার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখাতে হবে।’
এ বিষয়ে সাবেক বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সরকার চাইলে মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে। আসামি আপিল করার সুযোগ পাবেন না। কারণ বিচারিক আদালতের দেয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হয়ে গেছে। সেখানে নিশ্চয় আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন। হাইকোর্ট তার মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের পর আপিল বিভাগও তা বহাল রেখেছেন। সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেছে। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে সরকার।’
প্রায় অভিন্ন মত দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া আসামি এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদের তৎকালীন আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ‘কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আসামি মাজেদ আপিল বিভাগে একটি আবেদন করতে পারেন। আপিল বিভাগ আবেদন গ্রহণ করলে তিনি লিভ টু আপিলের সুযোগ পাবেন। আপিল বিভাগ যদি মাজেদের পিটিশন খারিজ করে দেন, তাহলে সরকার তার ফাঁসি কার্যকর করতে পারবে।’
বুধবার (৮ এপ্রিল) অবশ্য ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ হেলাল চৌধুরী বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে মাজেদের বিরুদ্ধে ফাঁসির পরোয়ানা জারি করেন। পরে তাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা সেসময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান। নির্মম সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার অন্যতম আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএস) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। একই বছরের ১২ মার্চ ছয় আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।
১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।
২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। পরে হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে। দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে পাঁচ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়।
পরে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। এ পাঁচ আসামি হলেন- সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ও মুহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি কার্যকর হয়।
২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান আসামি আজিজ পাশা। আবদুল মাজেদসহ পলাতক থাকেন ছয়জন। এরা হলেন খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী ও মোসলেম উদ্দিন। মাজেদ আইনের আওতায় চলে আসায় এখন বিভিন্ন দেশে পলাতক অবস্থায় আছেন পাঁচজন।
এফএইচ/এইচএ/পিআর