দেশজুড়ে

যেভাবে দ্বিতীয় দফায় করোনায় আক্রান্ত হলেন তিনজন

পুরো উপজেলা অবরুদ্ধ করে রেখেছে প্রশাসন। কঠোর নজরদারি পুলিশের। রাস্তাঘাট জনশূন্য। সর্বত্র নিস্তব্ধতা। সবার মনে ভয়, আতঙ্ক। দ্বিতীয় দফায় করোনার হানায় নির্বাক সবাই। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে সবার।

Advertisement

করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ১৯ মার্চ মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা লকডাউন করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। এরই মধ্যে কয়েকজন ইতালিফেরত করোনায় আক্রান্ত হন। তাদের সংস্পর্শে এসে পরিবারের সদস্যরাও আক্রান্ত হন। তাদের আইসোলেশন ওয়ার্ডে নেয়া হয়। সেখানে ইতালিফেরত এক যুবকের বাবার মৃত্যু হয়। এতে কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে শুরুর ধাক্কা সামলে নেয় উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। করোনার সংক্রমণ না বাড়ায় আতঙ্ক কেটে যায়। এ পর্যন্ত জেলায় ১১ জন করোনায় আক্রান্ত হন। এর মধ্যে অনেকেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। প্রথমবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে বিভিন্ন কাজে যোগ দেন অনেকেই।

বাড়ির সামনে মসজিদ। মসজিদে গিয়ে মুসল্লিদের সঙ্গে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছেন কেউ কেউ। রোগ-মুক্তির পর শোকরানা আদায় করতে মসজিদে গত ৩ মার্চ দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করা হয়। সেখানে আত্মীয়-স্বজন মিলে প্রায় ৬৫ জন দোয়ায় অংশ নেন।

কিন্তু এরই মধ্যে আসে দুঃসংবাদ। রোববার (০৫ এপ্রিল) শিবচর উপজেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা তিনজনের শরীরে আবারও করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। তারা তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠা ইতালিফেরত যুবকের সংস্পর্শে ছিলেন। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত তিনজন ইতালিফেরত ওই যুবকের শ্বশুর-শাশুড়ি ও বন্ধু। গত ২৭ মার্চ ওই তিনজনকে আইসোলেশন ওয়ার্ড থেকে ছাড়পত্র দেয় মাদারীপুর সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপর আবার আক্রান্ত হলেন তারা।

Advertisement

দ্বিতীয়বার করোনা পজেটিভ আসায় ওই মসজিদ লকডাউন করে দেয়া হয়। এখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় না করার অনেুরোধ করা হয়েছে। শিবচরে এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগী নয়জন। এরা দুই ইতালি প্রবাসী পরিবারের সদস্য। গত ২৪ মার্চ এদের মধ্যে এক ইতালি প্রবাসীর বাবা মারা যান। বাকি আটজনের সবাই একে একে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। শিবচর করোনা রোগী মুক্ত হয়। জনসাধারণের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে।

কিন্তু ৫ এপ্রিল এদের মধ্যে তিনজন আবারও করোনায় আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে ভর্তি হন। পরদিন স্বাস্থ্য বিভাগ ওই দুই পরিবারের আরও তিনজনকে আইসোলেশনে পাঠান। তাদের সংস্পর্শে আসা অন্তত ৫০ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। এতে জনমনে নতুন করে আতঙ্কের সৃষ্টি হলো।

স্থানীয় সূত্র জানায়, শিবচর উপজেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা তিনজনের শরীরে আবারও করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। পরে তাদের সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। রোববার দুপুরে তাদের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। আইসোলেশনে থাকা তিনজনের মধ্যে দুজন স্বামী-স্ত্রী। এরা ইতালি প্রবাসীর শ্বশুর-শাশুড়ি ও শিবচর উপজেলার পাঁচ্চর ইউনিয়নের হাজিপুরের বাসিন্দা। অপরজন একই উপজেলার বহেরাতলা ইউনিয়নের ইতালি প্রবাসীর বন্ধু।

জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায়, মাদারীপুর থেকে এ পর্যন্ত ৩৯ জনের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৩৬ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়। ৫০ জনের হোম কোয়ারেন্টাইন শেষ হয়েছে। বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ১৭০ জন। আইসোলেশনে আছেন চারজন। সর্বমোট হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন ১৪২৪ জন।

Advertisement

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এক নারী জানিয়েছেন, প্রথম দফায় আমার স্বামীকে ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি করি। পরে আমাদের তিনজনকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে নেয়ার পর আমার স্বামীর কাছে একই রুমে রাখা হয়। সেখানে দুই সন্তানকে আলাদা রাখা হয়। রোগীর খাবারসহ জ্বর, সর্দি-কাশির ওষুধ দেয়া হতো আমাদের। বাইর থেকে কিছু দেয়ার সুযোগ ছিল না। চিকিৎসক ও নার্স নিরাপদ দূরত্বে থেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। করোনায় আমার শ্বশুর মারা যাওয়ার পর ভয় পেয়ে যাই। গত রোববার থেকে আমার মা-বাবা দুজনই আইসোলেশনে আছেন। বড় বেশি দুশ্চিন্তা লাগছে।

করোনা আক্রান্ত শিবচরের ইতালি প্রবাসী বলেন, ইতালিতে একটি রুমে আমরা তিনজন থাকতাম। এ পর্যন্ত অপর দুজনের করোনা সংক্রমণ হয়নি। বিমানে আসার সময় হয়তো কারও সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছি আমি। বাড়ি আসার পর শাশুড়ি এসে আমার বাসায় দুদিন ছিলেন। পরে আমার শ্বশুর এসে তাকে নিয়ে যান। এতে আমার শ্বশুর আক্রান্ত হন। পরে শাশুড়িও আক্রান্ত হন।

তিনি বলেন, আমি এবং আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে ১৮ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। পরে সুস্থ হয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি আসি। কিন্তু এখন আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হচ্ছে সব। কখন কি ফলাফল আসে জানি না। চারদিন ধরে বাড়ির সামনে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। পুলিশ অনেক বড় দায়িত্ব পালন করছে। তবে এখন সুস্থ বলে মনে হচ্ছে আমাদের। কারণ করোনার উপসর্গ নেই। কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি ও বন্ধুর জন্য খারাপ লাগছে। তারা মূলত আমার সংস্পর্শে এসেই করোনায় আক্রান্ত হলেন।

পাঁচ্চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ইতালি প্রবাসীর শ্বশুর করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে আইসোলেশন থেকে ফিরে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করেছেন। মসজিদে নামাজ আদায় করেছেন। গত শনিবার মসজিদে দোয়া ও মিলাদ পড়ান। সেখানে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। এতে মুসল্লিরা ঝুঁকিতে রয়েছেন। ছয়জনের বাড়ি লাল পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করে দিয়েছে প্রশাসন। আইসোলেশনে থাকা তিন ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা পরিবারের সদস্যসহ আশপাশের কয়েকজনের নমুনা সংগ্রহ করেছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি টিম।

উত্তর বহেরাতলা দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অলিউল্লাহ খালাসি বলেন, জেলা প্রশাসনের কঠোর নির্দেশনায় ইউনিয়নের প্রতিটি রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড দিয়ে চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

শিবচর পৌরসভার মেয়র আওলাদ হোসেন খান বলেন, সুস্থ হয়ে আবার করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় উপজেলাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দুপুর ২টার পর ওষুষের দোকান ছাড়া সব দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মাদারীপুর জেলা পরিষদের সদস্য আয়শা সিদ্দিকা বলেন, শিবচরের ২৭ হাজার মানুষের মাঝে ২০০ মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে ২৫০০ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন। পাশাপাশি জেলা পরিষদ, শিবচর পৌরসভা ও উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন। খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে যাতে করোনা সংক্রমণ না ছড়ায় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়েছে।

মাদারীপুরের সিভিল সার্জন শফিকুল ইসলাম বলেন, সুস্থ হয়ে আবার করোনায় আক্রান্ত তিনজনকে সদর হাসপাতালের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি আরেক প্রবাসীসহ তিনজনকে আইসোলেশনে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।

মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মাহবুব হাসান বলেন, শিবচরের সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওষুধের দোকান ছাড়া সব দোকানপাট বন্ধ থাকছে।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর শিবচরকে আমরা লকডাউন ঘোষণা করেছি। সুস্থ হয়ে আবার করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে নেয়া হয়েছে। সবাইকে ঘরে রাখতে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি আমরা। এতে কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হবে না।

জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ ও মাদারীপুর-১ আসনের এমপি নূর-ই-আলম চৌধুরী বলেন, এমন পরিস্থিতিতে সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। সবাইকে যার যার ঘরে থাকতে হবে। আমরা পর্যাপ্ত খাবার দেব। খাবারের অভাবে কোনো মানুষ কষ্ট পাবে না।

একেএম নাসির/এএম/পিআর