করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্ব থমকে গেলেও নতুন করে জেগে উঠেছে যেন পরিবেশ। নতুন করে, আপন মনে সেজে উঠছে প্রাণ ও প্রকৃতি। সারা বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে এ চিত্র। বাদ নেই বাংলাদেশও।
Advertisement
করোনার কারণে ভ্রমণ নিষিদ্ধ হওয়ায় কক্সবাজার সমূদ্র সৈকত এখন পুরোপুরি পর্যটকশূন্য। সেখানে এখন নেই পরিবেশ দূষণ। নেই কোলাহল। কক্সবাজার সমূদ্র সৈকত যেন ফিরে পেয়েছে নতুন প্রাণ। সমূদ্রের পানি গাড় নীল। তাতেই সপ্তাহ খানেক আগে ভেসে বেড়াতে দেখা গেছে ডলফিনের দলকে।
পর্যটকশূন্য কক্সবাজারে যখন ডলফিন দলের খেলার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। কক্সবাজার সৈকতে ডলফিনের বিচরণ দেখে দেশের পর্যটনকে নতুনভাবে সাজানোর কথাও উঠে আসছে নানা মাধ্যমে। ঠিক তখনই সৈকতে অতিথি হিসেবে আসা এই ডলফিনদেরকেও রেহাই দিলো না কিছু অমানুষ।
কক্সবাজারের টেকনাফের শাপলাপুর সৈকতে প্রথমে একটি ডলফিনকে তুলে হত্যার অভিযোগ ওঠে স্থানীয় জেলেদের বিরুদ্ধে। প্রথমদিন একটি ডলফিনকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ আসার পরদিন দেখা যায়, সৈকতে আরও দু’ থেকে তিনটি ডলফিন মৃত পড়ে আছ।
Advertisement
মুহূর্তেই মৃত ডলফিনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। মৃত ডলফিনগুলোর শরীরে দেখা যায় আঘাতের চিহ্ন। একটি ডলফিনের লেজের দিকে মোটা রশিও বাধা ছিল। কিন্তু কে বা কারা এই ডলফিনগুলোকে মেরেছে, সেটা রয়ে গেছে অজ্ঞাত।
মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে জেলেরা ডলফিনগুলোকে পিটিয়ে মেরেছে বলে মিডিয়াকে জানিয়েছেন স্থানীয় পরিবেশকর্মী সেভ দ্য ন্যাচার অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন রিয়াদ।
মারাত্মক দূষণের কারণে কক্সবাজার সমূদ্র সৈকতে ডলফিনের দেখা পাওয়া ছিল দুঃস্বপ্নের মত। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের পদচারনা এবং দূষণের কারণে ডলফিন সৈকতের আশ-পাশেও ঘেঁষতো না কয়েক দশক। পরিবেশবাদীরা বলছে, অন্তত ৩০ বছর কক্সবাজারের সৈকতে ডলফিনের দেখা মেলেনি।
কিন্তু করোনায় লকডাউনের কারণে কক্সবাজার এখন পুরোপুরি পর্যটকশূন্য হওয়ার কারণে পরিবেশটাও বদলে গেছে। কলাতলি বিচ পয়েন্টের গাড় নীল পানিতে তাই দুই দলে অন্তত ২০ থেকে ২৫টি ডলফিনকে দেখা গেলো মনের আনন্দে ডুব-সাঁতার খেলতে। যেখানে ছিল গোলাপি রংয়ের দুর্লভ প্রজাতির একটি ডলফিনও।
Advertisement
কিন্তু সৈকতে অতিথি হয়ে আসা এসব ডলফিনের অবাদ বিচরণের ভিডিও প্রকাশের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হলো তাদেরকে। জেলেদের জালে আটকে পড়ার পর যেখানে তাদেরকে অক্ষত অবস্থায় ছেড়ে দেয়ার কথা, সেখানে নিষ্ঠুর কায়দায় রশি লাগিয়ে পিটিয়ে মারা হলো।
কক্সবাজারের বণ্যপ্রাণী গবেষক নাদিম পারভেজ জানান, গত দুই মাসেই অগভীর সমূদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে জেলেদের জালে আটকা পড়ে কিংবা ট্রলারের পাখায় আঘাত লেগে অন্তত ১১টি ডলফিন মারা গেছে। অধিকাংশ ডলফিনের গায়েই জালে আটকে পড়ার চিহ্ন ছিল।
কক্সবাজারের পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মীরা জানান, গত শুক্র, শনি ও রোববার- এই তিনদিনে তিনটি ডলফিনকে মারা হয়েছে কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ সৈকত এলাকায়।
শনিবার মৃত একটি ডলফিনের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করেন স্থানীয় যুবক জালাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি মিডিয়াকে জানান, জালে আটকা পড়ায় জালেরা সেটি সৈকতে এনে ফেলে দেয়। ডলফিনটি অনেক বড় এবং তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সন্ধ্যা থেকে ডলফিনটি আর দেখা যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
কক্সবাজারের পরিবেশকর্মী, সেভ দ্য ন্যচার অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন রিয়াদ জানান, শাপলাপুরে যে ডলফিনটা উদ্ধার করা হয়েছে, সে ডলফিনের মাথায় বিশাল ক্ষত এবং লেজের দিকে যে রশি দিয়ে বাধা হয়েছিল কিংবা কিছুতে আটকে ছিল, তা ক্ষত দেখেই প্রতীয়মান হয়।
মোয়াজ্জেম হোসেন আরও জানান, নানা টোটকা ওষুধের জন্য ডলফিন হত্যা করে তার মাংস ও হাড় নিয়ে যায় জেলেসহ একটি চক্র। এ ডলফিনগুলোকেও সে কারণে মারা হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি এও জানান, প্রশাসনকে জানানো হলে ডলফিনটি মাটি চাপা দেয়া ছাড়া আর কোনো তৎপরতা দেখায় না তারা। বিচার না হওয়ার কারণেই সামুদ্রিক প্রাণী হত্যার হার বাড়ছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা দোষিদের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মিডিয়াকে জানানি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যদি এ সম্পর্কে যদি কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়, তাহলে যে সমস্ত জেলে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কক্সবাজারের জেলা মৎস কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জামান বলেন, ‘যেহেতু এই ডলফিনগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছে, সেটা জেলেদের কারণেও হতে পারে, আবার প্রাকৃতিক কারণেও হতে পারে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশেনোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন মুন্না শঙ্কা প্রকাশ করেন, এমন চলতে থাকলে তা হবে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশের যে বন্ধু, সমূদ্রের যে বন্ধু- ডলফিন, যেগুলো আমাদেরকে সু-বার্তা দিচ্ছিল, সেগুলো যদি এভাবে মারা পড়ে, তাহলে সেটা কিন্তু আমাদের জন্য অশনি সঙ্কেত।’
সমূদ্র পরিবেশের বন্ধু ডলফিন রক্ষর জন্য এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান এই সমূদ্র বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপক মোসলেম উদ্দিন মুন্নাা বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে ডলফিনের যে ইকোলোকেশন পদ্ধতি, সেই ইকোলোকেশন পদ্ধতিতে তারা সাউন্ড দিয়ে কম্যুনিকেট করে। সে সাউন্ড ফ্রিকোয়েন্সি ইউজ করে তাদেরকে কিন্তু লোকেট (অবস্থান নির্ণয়) করা যায়, অথবা এভাবে তাদের গতিবিধিও এখন ফলো করা হচ্ছে। যে কেনো পর্যায়ে সেই উন্নতি পদ্ধতি ব্যবহার করে হলেও আমাদের বঙ্গোপসাগরে এই ডলফিনকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।’
জেলেদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে কক্সবাজার জেলা মৎস কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জামান বলেন, ‘জেলেদের প্রতি আমাদের পরামর্শ এই যে, যখনই আপনাদের জালে ডলফিন ধরা পড়বে, তৎক্ষণাৎ জাল উঠিয়ে তাকে মুক্ত করে দিতে হবে খুব সাবধানতার সঙ্গে। এমনভাবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যে, তাকে সুন্দরভাবে কোলে নিয়ে মাথায় এবং লেজে হাত বুলিয়ে তাকে পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। জেলেদের প্রতি এই পরামর্শ আমরা সব সময় দিয়ে থাকি।’
আইএইচএস/