যিনি জাতিকে ভাষা দিলেন, জাতিকে বিশুদ্ধ জাতিতে রূপান্তরিত করলেন, সেই বিশুদ্ধ জাতিকে বাংলাদেশ দিলেন, তাঁর শতবর্ষ ২০২০-২০২১ সাল। সেই শতবর্ষে প্রতিটি বাঙালি, পিতার জন্মশতবর্ষ জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালন করবে এটাই হওয়ার কথা ছিল। হ্যাঁ পুরো জাতি, পিতার শতবর্ষ উদযাপনের জন্য সকল রকমের প্রস্তুতি নিয়েছিল। যাহোক সেদিকে আর গেলাম না, পিতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। শতবর্ষে প্রত্যাশা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বেঁচে ছড়িয়ে যাক।
Advertisement
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনার অস্তিত্ব ধরা পড়ে। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে সেই খবর পৌঁছার সাথে সাথে মুজিববর্ষের সকল আয়োজন স্থগিত করে দেন এবং ঘোষণা দেন আমরা মুজিববর্ষ পরে পালন করব। যেহেতু করোনা সারাবিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করেছে, আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মানুষকে আগে রক্ষা করতে চাই। পুরো জাতিকে রক্ষা করার জন্য যা যা সিদ্ধান্ত, যা যা পদক্ষেপ নেয়ার তা সবই নিলেন। এবং আরও ঘোষণা করলেন যেহেতু করোনা বিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করেছে, সেহেতু আমরা স্বাধীনতা দিবসের এবারের অনুষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করব না। করোনা থেকে রক্ষা করার জন্য পুরো জাতিকে সম্পৃক্ত করে ঘোষণা দিলেন, করোনা মোকাবিলার যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে। আমরা বীরের জাতি। আমরা জয়ী হবই ইনশাআল্লাহ। আমাদের ইতিহাস তাই বলে। চাইলেন ১৮ কোটি মানুষের সহযোগিতা, ঘরে থাকার যুদ্ধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যুদ্ধ ,করোনাভাইরাস দূরীকরণের যুদ্ধ। আমরা জয়ী হব ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু পাবলিক!!!পাবলিকের প্রশংসা করতেই হয়। দূরে না যাই? খুলির (বাড়ির সামনে) গল্পটাই দিয়েই শুরু করি। আবার বাংলাদেশি পাবলিক বটে। সত্যি কোনো বিশ্লেষণের ঘাটতি নেই। এরা আবার নাকি করোনা নিয়ে আতঙ্কিত! বাপ বা! এটা আবার কী? খায় না মাথায় দেয়। যদিও কথাগুলো এভাবে বলা উচিত নয়, তারপরও বলতেই হবে। কারণ বাংলাদেশি পাবলিক বলে কথা। বুঝি, না বুঝি, পারি, না পারি, করি, না করি, করার চেষ্টাও করি না, আবার বড় বড় নসিহত দেই, নিজের খাছিলতের কথা কখনও মুখে আনি না। আনার চিন্তাও করি না।
করোনা আছে কি না তা পরীক্ষার জন্য ঢাকার উত্তরায় দিয়াবাড়িতে কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এবার যায় কই? পাবলিক সেই কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্প বাতিলের জন্য রাস্তায় অবরোধ করতে নামল। শুধু কি একাই, চৌদ্দগোষ্ঠী মিলে। করোনা মোকাবিলায় সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ বলে এই পাবলিকরাই ফেসবুকে নসিমন ঝড় তুললেন। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করল। ওরে বাবা! সাথে সাথেই পাবলিক করোনা মোকাবিলায় চলে গেলেন শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানা, প্রেম পার্ক, জাতীয় জাদুঘর,.....খেলার মাঠে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জমে উঠল পহেলা বৈশাখ আর বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের আমেজে। রাস্তাঘাটের মোড়গুলোতে মানুষ বসা শুরু করল গরুর হাটের মতো। এ যেন নির্বাচন। পাবলিক বটে? বাঙালি পাবলিক। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম আঙুল থেকে মুখে উদ্ভাসিত করে তুলল পাবলিক ঝড়ের ওপর ঝড়। সরকার.....। ফেসবুক পাড়ায় পাবলিকের ঝড়, উত্তর পাড়ায় পাবলিকের ঝড়, দক্ষিণ পাড়ায় পাবলিকের ঝড়। মাইক পাড়া, সেলুন পাড়া, কাজী পাড়া সব পাড়ায় পাবলিক....। মানি না বন্ধ, মানব না বন্ধ, বন্ধ,বন্ধ.. সবকিছু বন্ধ।
Advertisement
সরকার ঘোষণা দিল, সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ, সব সামাজিক ধর্মীয়, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান স্থগিত, হত-দরিদ্র গোষ্ঠীর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করবে সরকার, জরুরি সেবা খোলা থাকবে, যাদের অসুবিধা আছে মসজিদে যাবে না, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাড়ির বাইরে যেতে পারবে না, সীমিত আকারে চলবে ব্যাংকিং সেবা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, কাচাঁবাজার, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সেবা খোলা থাকবে, গণপরিবহন সীমিত আকারে থাকবে।
যেই ঘোষণা, পাব-------লিক! গেলেন মামাবাড়ি, খালাবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, দাদুর বাড়ি, নানাবাড়ি, বিয়েবাড়ি, কক্সবাজার, সুন্দরবন, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, বিভিন্ন পার্টি, নামি-দামি হোটেল, প্রেম ঘাটি আরও কত জায়গা। রাতে ফেসবুক পাড়া, অমুক, তমুক পাড়ায় পাবলিক, করোনা মোকাবিলায় সরকার ব্যর্থ। এক গ্রুপ প্রচারে ব্যস্ত সরকার মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করছে। সরকার কিন্তু তা একবারও উচ্চারণ করেনি। সৌদি আরবে করোনার কারণে মসজিদ বন্ধ হওয়ার পরও তাদের পাবলিক চুপচাপ। বাঙালি পাবলিক বটে। অন্দরমহলে থাকা গ্রুপ এবার বাণিজ্যে ব্যস্ত। আলু, কচু, পটল, শাক সবজি, মাছ, মাংস, ডাল এমন কিছু নেই যার দাম বাড়িয়ে দিলো না। পায়খানার বদনা পর্যন্ত এই দাম বৃদ্ধির তালিকায়। এইবার সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ। এই পাবলিকরাই সরকারের সমালোচনায় সবচেয়ে বেশী ব্যস্ত।
আসি স্বাস্থ্যখাতে। পাবলিক বটে! সাবান থেকে শুরু করে হুইল, রেইন, ডেটল, ওষুধ, মাস্ক একদিনে বাজার থেকে নাই। হায় রে পাবলিক? সরকার নির্দেশনা দিল, করোনা ছোঁয়াচে রোগ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবেন। এবার পাবলিক শুরু করল, "সারা জীবন মোর নাকতে(নাক) কেনো সমস্যা নাই, হাতে কোনো সমস্যা নাই। আর এইটা নাকি নাক দিয়া ঢুকবে। মোক বোকা পাইছে? এটা আওয়ামী লীগের দোষ, করোনা আওয়ামী লীগ নিয়া আসছে। হায়রে পাবলিক? কেউ কেউ আবার "করোনা" কারো মেয়ে মনে করে দেখতে যাচ্ছে।
সরকারের ঘোষণা করোনা মোকাবিলায় সবকিছুই বন্ধ। কিছু জরুরি সেক্টর বাদে। এবার পাবলিক ছুটল ঈদ করার উদ্দেশ্যে। রাস্তাঘাট, বাস, বিমান, নৌপথ রেলপথ, সাইকেল পথ, ভ্যান পথ, অটো পথ, নসিমন-করিমন পথ এমন কোনো পথ বাকি নাই। ছুটছে বাড়ির পথে ঈদ করতে। বিয়ে করতে.....। পাবলিক বটে। বাঙালি পাবলিক। সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ পাবলিকের বিশ্লেষণ। হায়রে পাবলিক। এবার পাবলিকের টকশো। লকডাউন..... লকডাউন। করোনা মোকাবিলায় এবার পুলিশ, সেনাবাহিনী মাঠে। পাবলিক, সরকার অত্যাচার শুরু করেছে আবার ক্ষমতায় আসার জন্য। হায়রে পাবলিক। বিদেশফেরতদের সরকার বললেন, হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে আর সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগ রাখতে। তারা হানিমুন স্টাইলে ঘোরাঘুরি শুরু করল। এই হচ্ছে পাবলিক। এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ মামলায় কারাভোগকারী বেগম খালেদা জিয়া ও তার কর্মীরা তো রীতিমতো বৈশাখী মেলার আয়োজন করল। এরা বিএনপি পাবলিক। সব দোষ সরকারের?
Advertisement
সরকার করোনা মোকাবিলায় সকল রকমের সহযোগিতার ঘোষণা দিল, হতদরিদ্র মানুষের অভাব দূরীকরণে রফতানি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ, করোনায় অনেকে কাজ হারিয়েছেন, বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান, এনজিওগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ সাময়িক স্থগিত, অতিরিক্ত পণ্য মজুত করবেন না, সীমিত আয়ের মানুষদের সুযোগ দিন, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের বিনামূল্যে ঘর ও ৬ মাসের খাদ্য ও নগদ অর্থ দেয়া হবে। পাবলিক যায় কই, কয় এটা সরকার খাবে, কিছুই দেবে না। কিছু মানবে না, কিছু বুঝবে না, কিছু শুনবে না, কিছু সইবে না, কিছু করবেও না? এরই নাম বাঙালি পাবলিক। ওদিকে ছাত্রলীগের কর্মীরা দিনরাত পরিশ্রম করে সেবায় ব্যস্ত একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। পাবলিক, এরা তো চাঁদাবাজি করছে। হায়রে পাবলিক। কী আর বলি?
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর চীনাদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে পাবলিকরা। নাস্তিক, কাফের, মুশরেক... কত কী ভাষায়। আরও কত কী...? করোনা মোকাবিলায় প্রথম চায়নারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন এবার পাবলিক চলে গেল ঝাড়ফুঁক আর গুজবে। গুজবীরা এবার করোনা টিকা আবিষ্কার করে ফেললেন? কালাজিরা, তেজপাতা, কলাপাতা, লবঙ্গপাতা, তুলসী পাতা, পুদিনা পাতা, কত রকমের যে পাতা। করোনা টিকা আবিষ্কার করে ফেলল। কেউ কেউ আবার করোনাবিরোধী মিছিলও করছে। হায়রে পাবলিক দিন শেষে আবার সরকারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার।
আসুন সকল পাবলিক সচেতন হই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকি। নিজে সুস্থ থাকি। পরিবারকে সুস্থ রাখি। সমাজকে সুস্থ রাখি। সমাজকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব নেই, দেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নেই। সরকারের দেয়া সকল নির্দেশনা মেনে চলি। সকলের সুস্বাস্থ্য কামনা। জয়ী হবই ইনশাআল্লাহ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক গণিত বিভাগ, সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও পরিচালক, বঙ্গবন্ধু চর্চাকেন্দ্র বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগ।
এইচআর/বিএ/জেআইএম