প্রবাস

পরবাসে বন্দি জীবনের আকুতি

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। নিয়ম করে ঘুম থেকে ওঠে। নাস্তা করা, কাজে যাওয়া, কলেজে যাওয়া। কলেজ থেকে ফিরে আবার কাজ শুরু করা। সবশেষে রাতে বাসায় ফেরা। কাজ আর কলেজ দুটো মিলিয়ে এক ক্লান্তিমাখা দিন পার করতে হতো প্রতিদিন। পৃথিবীটা রঙিন হলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ তার বিপরীত।

Advertisement

বিদেশে সংগ্রাম আর যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। তাই মনকে সেভাবেই মানিয়ে নিয়েছিলাম। আর সপ্তাহ শেষে যখন কচকচে ইউরোর নোট পকেটে ঢুকত তখন চোখেমুখের ক্লান্তির ছাপগুলি আপস করে নিত টাকার সঙ্গে। নিজেকে খুব সুখি মানুষ মনে হয় তখন।

এইভাবেই ছুঁটে চলছিলাম অধরা স্বপ্নগুলি বাস্তবতার দিকে। কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়ে এলোমেলো করে দিলো সব। চূর্ণ-বিচর্ণ করে দিলো পুরো পৃথিবীকে। স্তব্ধ হয়ে গেল পৃথিবী। থমকে গেল কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথচলা। কেউবা এখনও হাঁটছে। তবে এর শেষ কোথায় কেউ তা জানে না।

এ থমকে যাওয়া জীবনের মাঝেও মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। কেউ দু’বেলা খেয়ে বাঁচতে চায়, কেউ বা না খেয়েও বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু যারা প্রবাসে থাকে তাদের কি চাওয়া?

Advertisement

পাল্টে গেল প্রবাসীদের জীবনচিত্র। কাজকাম নেই, বেকার জীবন পার করছি ২ সপ্তাহ যাবত। নেই কোনো ব্যস্ততা। নেই কোনো ছুঁটে চলার প্রতিযোগিতা। দিনশেষে আসে না চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। পেটে ক্ষুধাও আসে না। ঘুমের ঠিক নেই, নেই কোন খাবারের ঠিক। বাসায় বসে থাকতে থাকতে হাত-পাঁ গুলিও যেন অচল হয়ে পড়ছে। সবসময় এক মানসিক অস্বস্তিতে ভুগছি। সময়ের সাথে সাথে প্রতিদিন বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা, সেইসাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও।

কত মানুষ প্রবাসে ৫ বছর ১০ বছর ধরে পড়ে আছে, হয়নি দেখা প্রিয়জনদের মুখগুলি। পরবাসে বাস্তবার কঠিন পাথরের দেয়াল ভাঙতে ভাঙতে একদিন লাশটাই যায় দেশে। কিন্তু বর্তমান সময়ের যে পরিস্থিতি মরলে লাশও যাবে না দেশে। মৃত্যুকে এখন আর ভয় করি না। তবে আকুতি শুধু একটাই অন্ততঃ মরার আগে একবার প্রিয়জনদের দেখা। সমস্ত প্রবাসীদের এখন এই একটাই চাওয়া।

প্রিজনদের বুকে একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারলেই যেন মরে গিয়েও আত্মাটা শান্ত হবে। একজন মানুষকে যে একজীবনে কত কষ্ট সইতে হয়। কত আনন্দের ভার বইতে হয়, জীবন যে কত আলোর রেখায় রঙিন হতে পারে, পাশাপাশি ঘাত-প্রতিঘাতের চড়াই-উতরাইয়ে হতে পারে কত খণ্ডে চূর্ণ-বিচূর্ণ; জীবনের শেষবেলায় এসে আমরা কজন মানুষ পারি নির্মোহভাবে সেসব সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে, কজন মানুষ পারি নির্লিপ্তভাবে সেই জীবনটিকে গভীর উপলব্ধি আর বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি দার্শনিক সত্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে।

মো. মাহাফুজুল হক, নিকোশিয়া, সাইপ্রাস থেকে/এমআরএম/এমএস

Advertisement