অর্থনীতি

প্যাকেজের ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা আসবে যেভাবে

করোনাভাইরাসের প্রভাব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়ার আগেই বেশ মন্দাভাব দেখা যায় রাজস্ব আহরণে। ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সচল রাখতে ব্যাংক ঋণনির্ভরতা বাড়তে থাকে। পাশাপশি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়ায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

Advertisement

এ অবস্থার মধ্যেই আসে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ভয়াল থাবা। বর্তমানে এ ভাইরাসের কারণে থমকে গেছে বৈশ্বিক সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ভুগছে বাংলাদেশের অর্থনীতিও। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

এই বাজেট ঘাটতি বাড়ার আশঙ্কা থাকলেও অর্থনীতির ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটাতে এবংপরিস্থিতির উত্তরণে পাঁচটি প্যাকেজে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। রোববার (৫ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন চারটি প্যাকেজে ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন। এর আগে তৈরি পোশাক খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন সরকারপ্রধান।

ক্রমান্বয়ে সরকারের আয় কমছে, এ পরিস্থিতিতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণায় সবার মনে প্রশ্ন, প্রণোদনার অর্থের সংস্থান কিভাবে হবে? এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পুরো টাকাটাই আসবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। সরকারকে বাড়তি তেমন কোনো টাকা ব্যয় করতে হবে না।

Advertisement

পৌনে ৭৩ হাজার কোটি টাকা প্যাকেজের মধ্যে ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার অর্থায়ন করবে দেশের ব্যাংকিং খাত। প্যাকেজের বাকি ৫ হাজার কোটি টাকা দেয়া হবে চলতি অর্থবছরের (২০১৯-২০) বাজেট থেকে। পাশাপাশি প্যাকেজের ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং বাকি ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করবেন শিল্পোদ্যোক্তারা।

এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে তা কেবল আপদকালের জন্য। বিশেষ বিবেচনায় দেয়া এ প্যাকেজে সরকারের ব্যয় তেমন বাড়বে না। কারণ অধিকাংশ টাকাই আসবে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে। তাই বাজেট বাস্তবায়নে বা বাজেট ঘাটতিতে এটি কোনো চাপ ফেলবে না।

প্রধানমন্ত্রীর প্যাকেজ ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, এই প্যাকেজের আওতায় দেশের বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র শিল্প ও সেবাসহ মৎস্য, ডেইরি, পোলট্রি খাতও তাদের চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ গ্রহণ করতে পারবে। মূলত ৪-৬ মাসের জন্য এই ঋণ দেয়া হবে। ওই সময়ের মধ্যে প্যাকেজের অর্থ ফেরত দিয়ে নতুনভাবে আবার ঋণ নিতে পারবেন।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এই প্যাকেজের ব্যবহারের নীতিমালা করবে, যেন সুষ্ঠুভাবে এটি বাস্তবায়ন করা যায়।

Advertisement

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্যাকেজ ঘোষণার পর এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষ করে এ অর্থের ব্যবহার, উপকারভোগীর শ্রেণী, প্যাকেজ থেকে ঋণ নেয়া ও পরিশোধের সময়সহ বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা নিয়ে নীতিমালা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি খুব শিগগির জারি করা হবে। এরপর প্যাকেজ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করবে সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।

প্রধানমন্ত্রীর নতুন করে ঘোষিত চার প্যাকেজের মধ্যে প্রথম প্যাকেজে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের জন্য ৩০ হাজার কোটি ঋণ সুবিধা দেয়া হবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। সুদের অর্ধেক সরকার ভর্তুকি দেবে। বাকি অর্ধেক দিতে হবে উদ্যোক্তাদের।

দ্বিতীয় প্যাকেজে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা দেয়া হবে। এর সুদ হারও হবে ৯ শতাংশ। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ৫ শতাংশ সুদ ভতুর্কি দেবে। এ দুই প্যাকেজে ভতুর্কি বাবদ সরকারের খরচ বাড়বে কমই। কারণ এতে সব মিলিয়ে খরচ হবে মাত্র তিন হাজার কোটি টাকা। এই তিন হাজার কোটি টাকা বাজেট থেকে দেয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরিচালন ঋণ থেকে তা নেয়া হতে পারে। ভতুর্কি বাদে পুরো টাকাটাই আসবে ব্যাংকিং খাত থেকে।

ঘোষিত চারটি প্যাকেজের বাকি দুটি মূলত তহবিল। এর একটি হলো এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ)। ব্লক টু ব্লক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বাড়াতে সরকার শুধু এর আকার বাড়িয়েছে। এতে অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা যুক্ত হবে। এ টাকার পুরোটাই দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া প্রিশিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করবে। এটিও বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা করবে।

সাধারণত দেশে তফসিলি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো সব সময়ই ঋণ দিয়ে থাকে। যে চারটি নতুন প্যাকেজের ঘোষণা এসেছে তার সব সুবিধাই মূলত ঋণ হিসেবে গণ্য হবে। আর এ ঋণ আসবে সেই ব্যাংকগুলো থেকেই। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সরকারকে কিছুই করতে হচ্ছে না। যা করার ব্যাংকগুলোই করবে। ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক ভিত্তিতে এ ঋণ দেওয়া হবে।

এছাড়া রফতানিমুখী শিল্পের জন্য আগেই ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে নীতিমালা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব প্রতিষ্ঠানের মোট উৎপাদিত পণ্যের ৮০ শতাংশ পণ্য রফতানি হয় সেসব প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য ঋণ নিতে পারবে। এক্ষেত্রে শিল্পমালিকরা ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিয়ে এ ঋণের সুবিধা নিতে পারবেন।

এমইউএইচ/এইচএ/এমএস