ফিচার

করোনা: সচেতনতাই মুক্তির মূলমন্ত্র

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম

Advertisement

করোনার প্রকোপ পৃথিবীজুড়ে। প্রতি মিনিটে ১০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর বড় সংকটে এখন বিশ্ব, বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। দিনদিন এর ধ্বংসযজ্ঞ বেড়েই চলছে। করোনাভাইরাসে লন্ডভন্ড প্রায় পুরো বিশ্ব। বিভিন্ন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এখন পর্যন্ত করোনার শিকার ২০৫টি রাষ্ট্রের মানুষ। প্রাণঘাতী করোনায় লাশের মিছিল বেড়েই চলছে। অধিকাংশ দেশেই লকডাউন। তবুও করোনার লাগাম টানা যাচ্ছে না। এর আক্রমণ থেকে গরিব, ধনী, রাজা, রানি কেউই বাদ যাচ্ছে না।

ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন বৃটিশ রানি, প্রধানমন্ত্রীসহ স্বাস্থ্যমন্ত্রীও। মারা গেছেন স্পেনের রাজকন্যা। করোনা বিষয়ক অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তায় আত্মহত্যা করেছেন জার্মানের অর্থমন্ত্রী থমাস শেফার। মারা গেছেন জাপানিজ কৌতুক অভিনেতা কেন শিমুরা। বাংলাদেশও ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের শিকার। প্রচণ্ড ঝুঁকিতে রয়েছে দেশবাসী। সর্বশেষ পাওয়া খবরে জানা যায়, বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রায় তেরো লাখ মানুষ আক্রান্ত। আর মৃতের সংখ্য প্রায় ৭০ হাজার। দফায় দফায় বৈঠকে বসছেন বিশ্ব নেতারা। কিভাবে ঠেকানো যায় এ অদৃশ্য ঘাতককে। কী ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এর বিস্তার রোধ করা যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তাদেরও নানা করণীয় নিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা। কিন্তু ফলাফল শূন্য।

এ শূন্যতা থেকেই সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে মানবিক বিপর্যয়ের মত দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশের মত অনেক উন্নয়নশীল দেশেও লকডাউনের পাশাপাশি চলছে সাধারণ ছুটি। রেডিমেট ওয়্যার রফতানিকারক দেশ হিসেবে পৃথিবীর তৃতীয় তালিকায় থাকা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পও হুমকির মুখে। এর বৃহত্তর বাজার ইউরোপ। কিন্তু সেই ইউরোপের অবস্থাও করুণ। ফলে একে একে অর্ডার বাতিলসহ তৈরি করা পণ্য ডেলিভারি না নেওয়ায় জটলা বাঁধছে। শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিয়েও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। এরই মধ্যে অর্ডার বাতিল হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে প্রায় ২১ লাখ পোশাকশ্রমিক। ফলে গত ২৭ মার্চ বিজিএমইএর আওতাধীন পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

Advertisement

এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে দেশের সব পোশাক কারখানা। করোনাভাইরাসে আজ সব অবরুদ্ধ। স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ। আতঙ্কিত জনপদ। দুর্বিষহ মানব জীবন। দরিদ্র শ্রেণির জন্য চরম বিপর্যয়। বড় বড় কোম্পানিগুলোর পরিচালকরা হতাশাগ্রস্ত। তারা বুঝতে পারছেন না, এর ভবিষ্যৎ কী। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ৭২ হাজার ৫৭০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সাধারণ ব্যবসায়ী, দোকানি ও দিনমজুরদের অবস্থা শোচনীয়। নাজুক অবস্থায় তাদের দিন কাটছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক সহায়তা তহবিল ২.২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘোষণা করেছে দেশটির প্রেসিডেন্ট। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৭৪টি দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানো শুরু করেছে। সেই সঙ্গে আরও ৬০টি দেশে পাঠানো প্রক্রিয়াধীন। মহামারীর ভয়াবহতা পুরো বিশ্বকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। যেসব দেশ ৭-১০ দিনের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছিল, তারা সময় বাড়িয়েছে। করোনা শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশেই নয়, এর ভয়ানক রূপ মহাশক্তিধর রাষ্টগুলোকেও লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা।

বাংলাদেশে আসন্ন বোরো ধান মৌসুমকে সামনে রেখে, কৃষি উপকরণের দোকানগুলো ছুটি বা লকডাউনের আওতার বাইরে রাখার ঘোষণা করা হয়েছে। গ্রাহকদের লেনদেনের সুবিধার্থে সীমিত সময়ের জন্য ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। কারণ অধিকাংশ সেবা ও বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান কোন না কোনভাবে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে চলমান সাধারণ ছুটি বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে। সামনে যে আরও বাড়াতে হবে না, এরকম কোনো নিশ্চয়তাও নেই। সুতরাং এভাবেই সমাজের বিভিন্ন প্রয়োজনে একে একে খুলে দিতে হবে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলাফল লোক সমাগম। করোনা বিস্তার রোধের অন্যতম মাধ্যম সামাজিক দূরত্ব আমাদের মত দেশে মেনে চলা বড় কঠিন।

‘যদি থাকেন সচেতন, ঠেকানো যাবে করোনা’। এরকম স্লোগানেও অনেক রাষ্ট্রে জনগণকে ঘরবন্দি করে রাখা যাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই কিছু কিছু রাষ্ট্র কারফিউ জারি করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশেও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী মাঠে নেমেছে। তারা যথাসম্ভব চেষ্টা করছে জনগণকে সচেতন করে ঘরে ফেরাতে। কিন্তু কতদিন? কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নিম্ন আয়ের। তাদের ভরণ-পোষণের যথাযথ ব্যবস্থা করতে না পারলে হয়তো আর তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা সম্ভব হবে না। তখন করোনার ভয়াল ছোবল কেড়ে নিতে পারে অসচেতন বাংলাদেশি লাখো প্রাণ।

Advertisement

শুধু বাংলাদেশিদের দোষারোপ করে লাভ নেই। কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডোর ঘোষণা, আপনারা ঘর থেকে বের হবেন না। আমরা আপনাদের খাদ্য-পানীয়সহ প্রয়োজনীয় সব কিছু ঘরে ঘরে পৌঁছে দেব।’ এরকম নিশ্চয়তা দেওয়ার পরেও জনগণকে ঘরবন্দি রাখা যাচ্ছে না। আর আমাদের বেশিরভাগেরই তো রাত কাটে পরের দিনের রুটি-রুজির ভাবনা নিয়ে। এরকম অভাবি জনগণকে দীর্ঘমেয়াদী হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখতে গেলে শুরু হতে পারে সামাজিক অস্থিরতা। প্রশাসন ও জনগণ মুখোমুখী অবস্থানে চলে যেতে পারে। ইতালির মত খাদ্যের অভাবে এ দেশেও শুরু হয়ে যেতে পারে লুটতরাজ।

তাই এখনই প্রয়োজন সরকারের দূরদর্শী মহাপরিকল্পনা। করোনা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সংক্রমণ ব্যাধি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে করোনা ঝুঁকিতে বাংলাদেশ প্রথমে। সংখ্যায় আক্রান্তের দিক থেকে ইতালির পরই বাংলাদেশ। সুতরাং এর থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইলে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। যা বাংলাদেশের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও বিশ্ব ব্যাংক করোনা পরিস্থিতির কারণে এশিয়া অঞ্চলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য মহা অশনি সঙ্কেত। তাই সরকার প্রধান এখন থেকে না ভাবলে চরম মাশুল দিতে হবে জনগণ তথা পুরো রাষ্ট্রকে। করোনা বাংলাদেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন খাত পর্যটন শিল্পকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। এ খাতে বিনিয়োগসহ হাজার হাজার বেকারের কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এসব নিয়েও ভাবতে হবে সংশ্লিষ্টদের। যেন অঙ্কুরেই পর্যটন শিল্প ধ্বংস না হয়।

এত এত প্রাণহানি আর অথনৈতিক ক্ষতি সাধনের পরেও সম্প্রতি একটি বিষয় চাউর হয়েছে। অনেক প্রকৃতিপ্রেমিক বোদ্ধাদের উচ্ছ্বাস, করোনার কবলে পড়ে পৃথিবী আবারো ফিরে পেতে যাচ্ছে তার আগের রূপ। বায়ু দূষণের মাত্রা কমে এসেছে। হিমবাহে বরফ গলার মাত্রা কমতে শুরু করেছে। সামুদ্রিক প্রাণী সমুদ্র জলে অবাধে বিচরণ করতে পারছে। সারাবছর পর্যটকদের পদভারে পিষ্ট কক্সবাজার সৈকতের বালিয়াড়িতে আবারো ফুটতে শুরু করেছে হারিয়ে যাওয়া সাগরলতা ফুল। খুব কাছ থেকেই দেখা যাচ্ছে ঝাকবাঁধা ডলফিনের দল। কুয়াকাটা সৈকতজুড়ে হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার বিচরণ। ঘর থেকেই ঝকঝকে নীল আকাশ আর রাতে দেখা যায় উজ্জ্বল তারার মেলা। সমাজ নিয়ে ভাবা মানুষদের দাবি, ফিরে আসছে পারিবারিক বন্ধন। নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে আত্মীয়-স্বজনদের। কমে এসেছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।

আবারো লিখতে হয়, কিন্তু কতদিন! মানুষের চিরাচরিত স্বভাবজাত অভ্যাসমুক্ত বিচরণ। ঘরবন্দি মানে এক গুমোট পরিস্থিতি। আর এর থেকে মানুষ বের হয়ে আসার জন্য থাকবে ব্যাকুল। অন্তত বাংলাদেশে তা সম্ভব নয়। যা আপনি সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা সচেতনতার অভাব, যা-ই বলুন না কেন। চীনে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পরপর আমাদের দূরদর্শী পরিকল্পনা নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তা না করে যে ভুল হয়েছে, তা যেন আর না হয়। সেদিকে এখন থেকেই দায়িত্বশীলদের কড়া নজরদারী রাখা প্রয়োজন। নতুবা ধ্বংস হবে দেশের অর্থনীতি, হতে পারে চরম মানবিক বিপর্যয়। সুতরাং অতিদ্রুত সরকারকে করোনাভাইরাস বিস্তার রোধ ও পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি সামলানোর মত যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া আজ বড় প্রয়োজন।

সেই সঙ্গে সব দায়-দায়িত্ব সরকারের ঘাড়ে না চাপিয়ে জনগণকেও সচেতন হতে হবে। গুজবে কান না দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত করোনা রোধের সঠিক নিয়মাবলী নিজ, পরিবার ও দেশের স্বার্থে যথাসম্ভব মেনে চলা প্রয়োজন। আইইডিসিআর কর্তৃক করোনা ব্রিফিং শুনে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই। নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরেও দেশে এ পর্যন্ত ১১৭ জন আক্রান্ত ও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং কঠোরতার সঙ্গে কোয়ারেন্টাইন মানার বিকল্প নেই। সামান্য অসতর্কতাই মহামারীর জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দুস্থদের ত্রাণ বিতরণের সময় নিরাপদ দূরত্ব মানা হচ্ছে না। তাই মানুষ জড়ো করে বিতরণের চাইতে অসহায় পরিবারগুলোর বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া উচিত। তা না হলে করোনার বিস্তার বেড়েই চলবে।

পাশাপাশি দেশের ইতিহাসে যেন কোনো কালো অধ্যায় যোগ না হয়, সে জন্য প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐক্যের আহ্বানও জানানো যেতে পারে। মানুষের জন্যই এ ভূমণ্ডল আর রাজনীতি। তাই মানুষকেই তার নিজ প্রয়োজনে প্রকৃতির উপর সদয় হওয়ার পাশাপাশি একে অপরের প্রতি মানবিকতার চর্চা বাড়াতে হবে। কারণ প্রকৃতি যেমনি কোমল, ঠিক তেমনি আবার কঠোর। করোনাভাইরাস আশির্বাদ না-কি অভিশাপ হয়ে এসেছে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এ মূহুর্তে বলা যায়, মানুষের জন্য মহামারী করোনা- প্রকৃতির চরম শিক্ষা। মহা পরাক্রমশালী স্রষ্টার একক আধিপত্য মানুষের অনুভূতিতে ফিরিয়ে আনার জন্যই হয়তো এ অপ্রতিরোধ্য অণুজীবের আবির্ভাব।

তাই আস্থা রাখতে হবে এক আল্লাহর উপর, যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতিতে ব্যক্তি সচেতনতা, সরকার ও চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলা খুবই জরুরি। কারণ এক্ষেত্রে সচেতনতা ও ধৈর্যই হতে পারে মুক্তির মূলমন্ত্র। পরিশেষে বলতে হয়, দীর্ঘ হোক পৃথিবী, সুস্থ থাকুক মানবজাতি। পরম করুণাময় প্রভুর কাছে এ কামনাই করি।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সংগঠক, দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ।

এসইউ/পিআর