মতামত

শ্রমিকেরা না বাঁচলে আপনারা কেউ নন

বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিক কি সঙ্গনিরোধ বিষয়টি বোঝে? ভাইরাসের ভয়াবহতার কথা জানে? নাহ! হয়তো একশো ভাগে দশ ভাগও জানেও না,বোঝেও না। যতো বুঝবে ততোই তারা চাকরিহারা হবে। ততোই তারা না খেয়ে মরবে। তাই না বোঝাই ওদের জন্য সবচেয়ে মঙ্গলজনক, সবচেয়ে নিরাপদ। ওদের মহামারি বুঝতে দিলেই তো জিডিপির হারে লস। এই লস যতোটা না দেশের, ততোটাই মালিকপক্ষের স্বার্থের। তাই পৃথিবীতে সবচেয়ে কম মূল্য দিয়ে এদেশে শ্রম কিনে নেয়া ওরা শ্রমিকের ঘামে অর্জিত মুনাফার হিসাবটাও সুচতুরভাবে ঢেকে ফেলে। ওরা জানে, যতোই দুর্যোগ-মহামারি হোক, যতোই ওদের ঠকানো হোক, ওরা নুন আনতে পান্তা ফুরানো শ্রমিক। ওদের কোনো উপায় নেই। ওরা পায়ে হেঁটে জঙ্গল-নদী পার হয়ে ঠিকই কাজে পৌঁছে যাবে।

Advertisement

করোনার সংক্রমণে মৃত্যুভয়কে ওরা পরোয়া না করলেও চাকরি হারানোর ভয়ে কোনো যানবাহন ছাড়াই ১৮-২০ ঘণ্টার যাত্রায় ওরা ময়মনসিংহ থেকে পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছে। সময়মতো না পৌঁছালে চাকরি থাকবে না। সন্তান না খেয়ে মরবে। তাই ওদের করোনা বোঝার দরকার নেই। তাই করোনার চেয়ে ক্ষুধা ওদের জন্য বেশি বিপদজনক। ওদের ক্ষুধার রাজ্যে পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি মনে হয়।

তাই সমগ্র পৃথিবী যখন করোনা আতঙ্কে লকডাউন। এদেশের গার্মেন্টস আর চা শ্রমিকেরা তখন লকআউট। আবার ওরা যখন সঙ্গনিরোধ উপেক্ষা করে সংঘবদ্ধভাবে বানভাসির মতো ভেসে ভেসে হাজির হলো, তখন সরকারের পক্ষ থেকে আবার তাদের রুখে দেয়ার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হলো। ভাবতে অবাক লাগে, এই সিদ্ধান্তটি আগে নিলে হয়তো অনেক সংক্রমণ রোধ করা যেতো। এরকম ভুলের মাশুল দিতে কত-শত মরদেহ যে গুনতে হবে, এখন সেটির অপেক্ষায়ই থাকতে হবে। তাছাড়া প্রথম থেকেই ইতালিফেরত প্রবাসীদের যথাযথভাবে লকডাউন করলে আমাদের হয়তো এতগুলো মানুষ হারাতে হতো না।

ওরা না হয় অবুঝ, কিন্তু মালিক তো বোঝে যে, গার্মেন্টসের পরিবেশ সবচেয়ে ঘন এবং সংক্রমণ সম্ভাব্য। উন্নত দেশের মতো চার মিটার দূরত্ব রেখে এখানে কাজ করা অসম্ভব! শ্রমিকদের মধ্যে সঙ্গনিরোধ করা এখানে সবচেয়ে বেশি কঠিন? ওরা কি জানে না দূরত্ব না মানলে এক একজন কর্মীই পরস্পরের জন্য ঘাতকে বা মারণাস্ত্রে পরিণত হবে? তাহলে মালিকপক্ষ সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এই কাজ কিভাবে করে?

Advertisement

ওরা কারা, তা একটু স্মরণ করি। এই ওরা একজন রানা প্লাজার রানা, আরেকজন তাজরীনের দেলোয়ার, এই ওরাই স্পেকট্রামের মালিক, এই ওরাই নগরপিতা আতিকুল, ওরাই নগরমাতা রুবানা। ওরা কতো সুন্দর পোশাক পরেন, কবিতা পড়েন, আমজনতাকে কতো সুন্দর সুন্দর উপদেশ দেন। থলের মধ্য থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি বের করে দেখান। হাস্যকর কথা হলো, এই যে নারী দিবসের ইতিহাস, যে নারী দিবস শ্রমিকদের শ্রমঘণ্টার বৈষম্যের প্রতিবাদে উদ্ভূত হয়েছিল, সেটি কি তিনি জানেন না!

এই ওরা শ্রমিকদের বোকা বানিয়ে ওদের ভোটেই এই পিতা-মাতা বনে যাওয়ার পদ আদায় করেন। কিন্তু পদের দায়িত্ব পালন করেন না। এই শ্রমিকদের জীবনবীমা নেই। স্বাস্থ্যবীমা নেই। মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। যানবাহন নেই। দুর্যোগে সবেতন ছুটি নেই। কোলের শিশুকে দুধ খাওয়ানোর জায়গা নেই। শ্রমিকদের এসব না থাকা নিয়ে এদের কোনো দায়িত্ব নেই।

অথচ এই ওরা পদ আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমে ভোটের আগে ভোট চেয়ে চেয়ে চেয়ে গান বানান, ‘এমন একটা মা দে না’ গানের আদলে ‘আমারে একটা ভোট দেন না, আমারে একটা ভোট দেন না’ শোনান। এই আতিকুল সাহেব রাস্তায় নেমে ডুগডুগি বাজান, শো অফ করে চা দোকানে গিয়ে চা বানান। শুধু তাই নয়, সেদিন একটি ভিডিওতে দেখলাম, তিনি কোনো এক অনুষ্ঠানে নিজের মেয়েকে স্টেজে তুলে দিয়ে নিজের প্রশংসাপত্র পাঠ করাচ্ছেন।

মেয়েও বাবার কথা বলতে গিয়ে দাবি করে, তিনি যেমন তার বাবা, তেমনি আবার নগরপিতা। ইংরেজিতে মেয়ের ভাষ্য, তার বাবা বিড়াল নিয়ে খেলা করেন। এইসব কাণ্ডকারখানা ভয়ানক হাস্যকর। গা জ্বালাকর। আসলে দেশের সকল মানুষকে কি এরা হাবাগোবা মূর্খ ভাবেন। কেউ ওদের ধূর্ত চেহারা চেনে না! আজকে করোনার এই করুণ পরিস্থিতিতে কেন বিজিএমইএ’র সভাপতি বায়ারদের কাছে করুণা ভিক্ষা করছেন? যে সেক্টর থেকে জিডিপির হার বাড়ে সেই দেশে জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য শ্রমিক কল্যাণ তহবিল নেই কেন? কেনো শ্রমিকের জন্য জীবনবীমা নেই?

Advertisement

এই আপনারা তো তাজরীন ফ্যাশনসে জীবন্ত ১১১ জন শ্রমিকের বের হওয়ার পথ বন্ধ করে তাদের পুড়িয়ে মেরেছিলেন, রানা প্লাজার ভবন ধসিয়ে ধংসস্তূপের নিচে চাপা দিয়ে নিরীহ শত শত মানুষকে হত্যা করেছিলেন। এই তুবা গার্মেন্টসের মালিক আপনারাই চাঁদরাতে শ্রমিকদের অনশনে লাঠিপেটা করেছিলেন। ওদের জীবন তো আপনারা ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। টাকা দিয়ে সাহায্য হয়তো হয়, কিন্তু জীবনের ক্ষতিপূরণ তো কখনো হয় না।

করোনার এই সময়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার ঢল দেখে মনে ভীষণ ভয় হলো। না জানি সংক্রমণ কতোটা বেগবান হয়েছে!

মনে পড়ে গেলো ২০১৩ সালের ২৭ এপ্রিল, রানা প্লাজা ধসের তৃতীয় দিনের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া শ্রমিক শাহীনা আর উদ্ধারকর্মীর সেই লাইভ ভিডিওটির কথা—‘শাহীনা ম্যাডাম আপনি ঠিক আছেন?’‘আমিতো ঠিক আছি কিন্তু বের হতে পারছি না। আপনার লাইটআমার চেহারা দেখতে পারতেসে? আমি অধৈর্য হই নাই। আমাকে সাদা পানি দেন।’‘আপনি চিন্তা করবেন না, আমাদের জীবন থাকতে আমরা আপনাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবো।’‘ভাই আমাকে এখান থেকে বের করেন, আমার একটা ছেলে আছে। ওর জন্য আমাকে বাঁচান, ওরে দুধ খাওয়াতে হবে।’‘আপনার ছেলের নাম যেনো কী?’‘রবিন।’‘বয়স যেনো কতো?’‘দেড় বছর।’এই দেড় বছরের ছেলের জন্য শাহীনা বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু সে তো শেষমেশ বাঁচতে পারেনি। ধ্বংসস্তূপের নিচে আগুন ধরে গিয়েছিল। কিন্তু ওর ছেলে রবিন এখন অনেক বড় হয়েছে। খালার সাথে স্কুলে যায়। এক সাংবাদিককে কবিতা শোনাচ্ছে-‘আমাদের দেশটাকে কতো ভালোবাসিসবুজ ঘাসের বুকে শেফালীর হাসি।’

খুব ভালো লাগলো শাহীনার ছেলের কবিতা শুনে। মনে হলো পরিণত হয়ে সে যদি অনেক বড় কিছু হয়ে যায়, আর মায়ের মৃত্যুর কারণ যদি জানতে চায়, তখন নগরের পিতারা কী জবাব দেবেন?

যা হবার তা তো হয়েই গেছে, এখন না হয় গালভারী কথা না বলে নগরের পিতা দাবি না করে ওদের কল্যাণে নিজ নিজ দায়িত্বটি আগে পালন করুন। অন্যথায় ওরা না বাঁচলে আপনারা কেউ নন।

লেখকসাবিনা শারমিনসাবেক ব্যবস্থাপক, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ইমেইল : sharminakhand007@yahoo.com

এইচএ/এমকেএইচ