মতামত

গণমাধ্যমকর্মীদের ঝুঁকি এবং প্রণোদনা পদ্ধতি

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ বা নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট সংকট থেকে মুক্তির জন্য বেসরকারি বিভিন্ন সেক্টর সরকারের কাছে প্রণোদনার দাবি জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জানা যায়, প্রণোদনা পদ্ধতি ঠিক করতে এবং এর জন্য কী পরিমাণ অর্থ লাগবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।

Advertisement

অন্যান্য সেক্টরের মতো গণমাধ্যমের জন্য প্রণোদনার দাবি তুলেছেন মালিকদের বিভিন্ন সংগঠন। সাংবাদিক সংগঠনগুলোও সাংবাদিকদের জন্য প্রণোদনার দাবি তুলেছে। যেহেতু করোনা পরিস্থিতি কতদিন থাকবে বা এর গতিপ্রকৃতি কী হবে সেটা আমরা এখনো নিশ্চিত নই, সেহেতু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকদের প্রণোদনার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু এই প্রণোদনা কীভাবে দেয়া যেতে পারে সেটি নিয়ে কিছু আলোচনা প্রয়োজন।

এ কথা কে-না জানে যে, সাংবাদিকতা বিশ্বব্যাপী একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও জরুরি দৈনন্দিন পেশা। বাংলাদেশে সাংবাদিক বা গণমাধ্যমকর্মীরা অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। বিনিময়ে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যা পান তা খুবই সামান্য। রাষ্ট্র বা সরকার এক্ষেত্রে খুব যে উদার সেটাও বলা যাবে না। অথচ দেশের যেকোনো সংকটকালে সংবাদকর্মীরা দেশ এবং মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকেন। এর সুফল কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্র বা সরকারের ঘরেই যায়।

এই যে করোনা সংকট- এই মুহূর্তে মূলধারার গণমাধ্যম যদি বন্ধ থাকত, তাহলে নিশ্চিতভাবে গুজবের ডালপালা ছড়াত। একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ইউটিউবে বা ব্যক্তিগত চ্যানেলে অনেকে দেশে বা বিদেশে বসে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে যে গুজব ছড়িয়েছে বা ছড়াচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যম সেগুলো মোকাবিলা করে রাষ্ট্র ও সরকারকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেছে। সুরক্ষিত না থেকেও সংবাদকর্মীরা তাদের কাজটি করে চলেছেন। বিনিময়ে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রাপ্তির কথা বিবেচনা করা হলে হতাশাই জাগবে।

Advertisement

দেশজুড়ে করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যেও অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। কোথাও কোথাও একাধিক মাসের বেতন বাকি। প্রাতিষ্ঠানিক পরিবহন সুবিধা নেই বহু প্রতিষ্ঠানে। দোকানপাট বন্ধ থাকার কারণে কর্মীদের বৈকালীন বা সান্ধ্য নাস্তা অথবা প্রয়োজনীয় খাবারের ন্যূনতম ব্যবস্থা নেই অনেক প্রথিষ্ঠানে। অথচ এই কর্মীদের অহোরাত্রি পরিশ্রমের ফসল পাচ্ছেন গণমাধ্যম মালিকরা। রাষ্ট্রও কমবেশি লাভবান হচ্ছে তথ্যবহুল সাংবাদিকতার কারণে।

ভয়াবহ করোনা সংক্রমণকালে হাতেগোনা ক’টি প্রতিষ্ঠান সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের শারীরিক সুরক্ষা বা আর্থিক সুরক্ষার বিষয়টি ভাবলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের চিত্রই উদ্বেগজনক। সেটা সরকার সংশ্লিষ্টরা কমবেশি জানলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। সরকার বা তথ্য মন্ত্রণালয় চাইলে এ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের আরও সুরক্ষিত করার উদ্যোগ নিতে পারত। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সুরক্ষা পদ্ধতি নিশ্চিত করা হয়েছে কিনা বা এই সংকটকালে সংবাদকর্মীরা তাদের বেতন-ভাতা পাচ্ছেন কিনা সেটা মনিটরিং হওয়া খুব জরুরি ছিল।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে শুধুমাত্র হাতধোয়ার ব্যবস্থা ছাড়া সুরক্ষার আর কোনো পদ্ধতি নেই। আর্থিক বা মানসিক সুরক্ষাও তথৈবচ। করোনাভাইরাস ঠেকাতে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নিরাপদ দূরত্ব বা সামাজিক দূরত্বের কথা বললেও অনেক নামকরা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেই নির্দেশিত আসন বিন্যাস এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। বেতন বা সুবিধাদির নিশ্চয়তা তো আরও পরের কথা।

দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম মালিক নানাভাবে সরকার পক্ষ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা পেলেও গণমাধ্যমকর্মীরা বাস্তবে তার অনেককিছু থেকে বঞ্চিত। অথচ দেশে সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, অনলাইনসহ হাজার হাজার গণমাধ্যম এখন। এর সবগুলোকেই প্রকৃত গণমাধ্যম বলা যাবে কি-না তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে।

Advertisement

সংবাদপত্রের জন্য সরকার ওয়েজবোর্ড ঘোষণা করলেও টেলিভিশন চ্যানেল বা অনলাইন কর্মীরা এখন পর্যন্ত কোনো আইনি বেতন কাঠামো পাননি। সংবাদপত্রের জন্য ওয়েজবোর্ড সুবিধা দিলেও হাতেগোনা কিছু সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থায় সে সুযোগ-সুবিধা পান সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীরা। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মালিকের পেটে যায় সরকারের দেয়া আর্থিক সুবিধাদির বড় অংশটি। মালিক সম্পদশালী হন, আর কর্মীটির বেতন বাকি থাকে। চাকরি ছেড়ে দিলে বা চাকরি থেকে ইস্তফা নিলে সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের অধিকাংশই তার ন্যায্য সুবিধাদি থেকেও বঞ্চিত হন। এই পরিস্থিতিতে প্রণোদনার অর্থ শুধুমাত্র মালিক বরাবরে দিলে তার সদ্ব্যবহার হবে না সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

সে কারণে প্রণোদনাটি দেয়া দরকার দুই স্তরে। এই দুটি স্তর হলো মালিক এবং গণমাধ্যমকর্মী অর্থাৎ সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারী। একইসঙ্গে প্রণোদনার ক্ষেত্রে দেখতে হবে তা প্রকৃত সাংবাদিকরা সঠিকভাবে পাচ্ছেন কিনা। এ জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় এবং কঠোর হতে হবে। প্রতিষ্ঠান চালু রাখার জন্য মালিকদের প্রণোদনা হিসেবে থোক বরাদ্দ সরকার দিতেই পারে। একইসঙ্গে সরকারের কাছে পাওনা বিভিন্ন সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বিল এখনই পরিপূর্ণ পরিশোধ করে দেয়াও একটি বড় রকমের প্রণোদনা হতে পারে।

আর বিভিন্ন সংবাদপত্রে কর্মরত সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বচ্ছ তালিকা সংগ্রহ এবং এটি যাচাই-বাছাই করে তাদের হাতে সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রণোদনার অর্থ তুলে দিতে পারে তথ্য মন্ত্রণালয়। এ জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যেতে হবে। টেলিভিশন চ্যানেল বা অনলাইনের ক্ষেত্রেও একইরকম পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এছাড়া যে সাংবাদিকগণ বেকার রয়েছেন, তাদের তালিকা তৈরি করে দেয়ার জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনকে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুথবদ্ধ হয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলো এই সংকটকালে কাজ করতে পারে। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য প্রণোদনার অর্থ যেন সম্মানজনক হয় সেটিও সরকারকে মনে রাখতে হবে।

এভাবে গণমাধ্যমকর্মীদের মাঝে সরাসরি প্রণোদনা দেয়া হলে তার ব্যবহার যথাযথভাবে হবে বা সংশ্লিষ্টরা তার জন্য বরাদ্দের পুরোটাই পাবেন। প্রণোদনার পুরোটা বা আংশিক মালিকপক্ষ (সবাই নয়) আত্মসাৎ করতে পারবেন না। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি প্রকৃত চিত্র সরকার জানতে পারবে। এই চিত্র গণমাধ্যমে সরকারের করণীয় নির্ধারণে কাজে লাগানো যাবে। তৈরি হবে গণমাধ্যকর্মীদের সঙ্গে সরকারের আন্তঃসম্পর্ক। আর অসৎ মালিকদের কাছে সংকেত যাবে যে, সরকারের টাকা যেভাবে-সেভাবে আত্মসাৎ সম্ভব নয়।

একইসঙ্গে আরেকটি বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি রাখা দরকার। দেশে অনেক সংবাদপত্র ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলোর কোনো জনবল বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীহীন এসব প্রতিষ্ঠানে হাতেগোনা কয়েকজন মিলে কাটপেস্ট করে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন সুবিধা নেয়ার জন্য পত্রিকা বের করেন। কেউ কেউ সেলফোনে অনলাইন চালান। বিভিন্ন নামকরা অনলাইন নিউজ পোর্টাল থেকে সংবাদ কাটপেস্ট করে নামসর্বস্ব অনলাইনটি টিকিয়ে রেখেছেন।

একই ধরনের নিউজ এবং একই ধরনের মেকাপ-গেটাপে শতাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় খোদ রাজধানী থেকে। অনেক পত্রিকা আছে নিয়মিত প্রকাশিতই হয় না। বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে ‘পরিবার কোম্পানি’। সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থাকুক বা না থাকুক পরিবারের সদস্যরা মিলে পত্রিকা বের করেন এখান-ওখান থেকে নতুন ও পুরোনো নিউজ দিয়ে। শুধুমাত্র সরকারি ক্রোড়পত্র পেলে ছাপানো হয় শতাাধিক পত্রিকা। এসব পত্রিকার সংবাদ ই-পেপারে দেখা গেলেও মুদ্রণ সংস্করণ পাওয়া যায় না অধিকাংশ সময়। তবে তাদের জন্য নিয়মিত বরাদ্দ হচ্ছে অষ্টম ওয়েজবোর্ডের সুবিধাদি এবং ক্রোড়পত্র।

এর ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। মালিক নামক একশ্রেণির ব্যক্তি লাভবান হচ্ছেন। এর মাধ্যমে একদিকে এই মালিকেরা নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন রাষ্ট্রের টাকায়, অন্যদিকে গণমাধ্যমকর্মীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বিকশিত হচ্ছে না। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রণোদনা পেলে পুরোটাই মালিকের পেটে যাবে। এর বদলে নিয়মিত প্রকাশিত এবং জনবল কাঠামোভিত্তিক প্রকৃত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে প্রণোদনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া যায় কিনা সেটিও সরকার ভেবে দেখতে পারে।

লেখক : বিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক যায়যায়দিনও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।

এইচআর/বিএ/পিআর