কর্কশ কালচে ছোপ নিয়ে মানুষের জীবনে হাজির হচ্ছে এক-একটা দিন! যা গুনতে শেখাচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যা! বাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রণা,দীর্ঘশ্বাস আর গন্তব্যের অনিশ্চয়তা। এখনও হয়তো জীবন আর মৃত্যু চলছে প্রায় একই সমান্তরালে। কিন্তু কেউ জানে না; জীবন আর মৃত্যুর এই পাশাপাশি চলা মিছিল কখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে! কারণ করোনাভাইরাস কাউকেই করছে না করুণা। মানছে না সে কোনো দেশের সীমান্ত। চিনছে না কে বৃদ্ধ, কে তরুণ, কে যুবক, কে নারী, কে পুরুষ! কার ধর্ম কী, কার উপাসনালয় কোথায়, এসব নিয়ে নেই তার কোনো মাথাব্যথা! সে যেন সাম্যবাদী, ধর্মনিরেপক্ষ এক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মৃত্যুদূত! তার আগমনী বার্তা পৌঁছে গেছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।
Advertisement
করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষ এখনও অস্ত্রহীন। অসহায় রাষ্ট্রনায়করা। শুধু অফুরান প্রাণশক্তি, মানসিক দৃঢ়তা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সচেতনতা, সাবধানতা- এই সব শব্দাস্ত্র ছাড়া কারও হাতে তেমন কিছু নেই। তাই লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, সাধারণ ছুটি, জনতার কারফিউ- বলে যাচ্ছে জীবনের জন্য আমি আপনি আপাতত একটু দূরে থাকি। আমি+আপনি=আমরা।
হ্যাঁ, আমরা। আমাদেরই লড়তে হচ্ছে জীবনের জন্য সর্বগ্রাসী এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে। যার নাম করোনা। এই ভাইরাস এক মরণখেলায় নেমেছে মানুষের সঙ্গে! ভাইরাস শব্দটা ইংরেজিতে লিখলে চেহারাটা দাঁড়ায় ভি-আই-আর-ইউ-এস। এই শব্দটা থেকে ‘আই’ এবং ‘ইউ’ অক্ষর দুটিকে সরিয়ে নিলে অর্থহীন এক শব্দে পরিণত হচ্ছে। ‘আই’ এর শব্দার্থ - আমি। ‘ইউ’ এর শব্দার্থ - আপনি। এই আমি এবং আপনি একটু দূরে দূরে থাকলেই বাঁচা যেতে পারে সংক্রমণের হাত থেকে।
তা হলে সাময়িকভাবে জীবনের জন্য কেন নয় সামাজিক দূরত্ব? এই দূরত্ব দৈর্ঘ্য-প্রস্থের। মানসিক দূরত্ব নয়। মনের দিক থেকে কাছাকাছি থাকার সুযোগও থাকছে। প্রযুক্তি একজনকে আরেকজনের কাছাকাছিও এনে দিচ্ছে। তাই থাকি না ক’টা দিন, ‘অসামাজিক’ লেভেল বুকে এঁটে বাহ্যিকভাবে দূরে দূরে। সেটা নিজের জন্য। পরিবারের জন্য। সমাজের জন্য। চাইলেই আমরা পারি। হয়তো বাধা হয়ে সামনে আসে নিম্নবিত্ত, দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলোর ক্ষুধার জ্বালা।
Advertisement
রোজ আনা রোজ খাওয়া মানুষগুলো কতদিন কর্মহীন হয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন। তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকার নিচ্ছে। পাশাপাশি এগিয়ে আসছেন বিত্তবানরাও। হয়তো এগিয়ে আসতে হবে আরও অনেককে। তা না হলে ক্লান্তিতে, অবসাদে, অনাহারে মানুষ লুটিয়ে পড়বে মাটিতে। বিপন্ন মানবতার সেই চেহারাই বা বেঁচে থাকা মানুষগুলো দেখবেন কীভাবে!
গোটা পৃথিবীজুড়ে আজ একই চেহারা। মানবতার হাহাকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ রকম বিপর্যয় পৃথিবী দেখেনি। এই বিপর্যয়ের মুখে মানবতাকে বাঁচানোর জন্য সামনের সারির যোদ্ধা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিন্তু তারাও রেহাই পাচ্ছেন না। মৃত্যুর মিছিলে তাদের সংখ্যাটাও কম নয়। আজ গোটা মানবজাতি তাকিয়ে তাদের দিকে। তারাই জেতাতে পারেন এই যুদ্ধে মানুষকে। ওষুধ নেই, ভ্যাকসিন অনাবিষ্কৃত। অথচ তাদের যুদ্ধ অব্যাহত। সেই যুদ্ধ মানুষকে বাঁচানোর যুদ্ধ। কিন্তু মানুষকেও বাঁচতে চাইতে হবে। বাঁচতে চাইলে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
সরকার জোর করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে আপনাকে ঘরবন্দি করে রাখতে চায় না। পৃথিবীর কেনো সরকারই চায় না। তাতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি রাষ্ট্রের। সেটা আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক। মোটাদাগে ক্ষতিটা বহুমাত্রিক। কিন্তু তারপরও আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের মানুষকে ঘরে রাখার জন্য সরকারকে জোর করতে হচ্ছে! কারণ, আমরা ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারছি না কী ভয়াবহ সংক্রমণ মহামারির মুখোমুখি আজ সবাই!
ধরে নিচ্ছি, সব ঠিক হয়ে যাবে। হ্যাঁ, যাবে। কিন্তু কবে? তা কেউ জানেন না! উন্নত বিশ্বে মৃত্যুর মিছিল খুব দ্রুুত বড় হচ্ছে। তারচেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেই মিছিল। আমরা হয়তো এখনও নামতার মতো সংখ্যাটা পড়তে হাতের কর গুনছি। কিন্তু সেটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে শুরু করলে হাতের কর গুনে সংখ্যাটা শেষ করা যাবে না। ক্যালকুলেটরে হাত দিতে হতে পারে। তার আগে সাবধানতার জন্য বারবার হাতে স্যানিটাইজার লাগানো ভালো। বারবার ২০ সেকেন্ড করে হাত ধোয়া ভালো।
Advertisement
না কোনো সাবানের বিজ্ঞাপন দেখে আপনার অনুপ্রাণিত হওয়ার দরকার নেই। শুধু নিজে, নিজের পরিবার, নিজের আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, আপনার চারপাশের সমাজের জন্য এটুকু কি আপনি, আমি, আমরা করতে পারি না? পারি। হাজার অভাব-অনাটনের মধ্যেও পারি। তার জন্য দরকার মানসিক শক্তি, সদিচ্ছা। সচেতনতা। অন্যের দিকে দূর থেকে সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া।
আমি, আপনি, আমরা সবাই মিলে যদি লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারি; তাহলে প্রতিপক্ষ ‘করোনা’ দিশেহারা হয়ে বিপর্যস্ত হবেই। সেটা আজ না হয় কাল।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/বিএ/পিআর