মতামত

করোনা পরবর্তী দেশপ্রেম ও আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকারের ব্যবস্থাপনা এবং নাগরিকের সুরক্ষার ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যেভাবে সামনে নিয়ে এসেছে তাতে করোনা পরবর্তী বিশ্বে দেশপ্রেম নামক শব্দটি সম্পর্কিত ধারণাগুলো ও ব্যবহার পুরোপুরি বদলে যাবে। দেশপ্রেম শুধু জাতীয়তাবাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত একটি শব্দ নয়, একে ‘জাতীয় অহংকার’ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশে 'দেশপ্রেম' নামক অস্ত্রটি প্রায়শ এমনভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যেন এটা একটা বিষয়বস্তু মাপার নিক্তি, যার মাধ্যমে নাগরিকদের স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, নিষ্ঠা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মাপা যাবে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নাগরিকের দেশপ্রেমের লেভেল বা অবস্থান মাপার দায়িত্ব শুধুমাত্র ওই দেশের সরকার একেবারে নিজের মধ্যেই রেখে দিয়েছে, শুধু তারাই তা নির্ধারণ করতে পারবে, অন্য কেউ নয়।

Advertisement

বর্তমানে বিদ্যমান ধারায় দেশপ্রেমের পরিমাণ মাপার ক্ষেত্রে প্রাধন্য পায় সামরিক শক্তি বৃদ্ধির প্রতি সমর্থন ও উচ্ছ্বাস এবং জাতীয়তাবাদী ক্ষমতার প্রতি নিরবচ্ছিন্ন ভালোবাসা ও আস্থা। প্রচলিত সংজ্ঞায় ভালো দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য অবশ্যই ‘নিজের ভূখণ্ডের জনগণ ব্যতীত মানবজাতির শত্রু হতে হবে’। অর্থাৎ আমিত্বই বড় বিষয় হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের কঠিন পরীক্ষায় পাস করার জন্য। এই আমিত্ব এবং আমার দেশই সেরা, দেশপ্রেমের এই গ্ৰহণযোগ্যতার জন্য সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ঐকমত্য হওয়াটাই এখনকার দেশপ্রেমের সবচেয়ে বড় সূচক। এতে করে সত্যটা গোপন করার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়। এই বিষয়টি এত বেশি গুরুত্ব পায় যে, দেশপ্রেমের এই পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য দেশের মানুষ, তার সুরক্ষা, নিরাপদে থাকার বিষয়টি শুধু সামরিক শক্তির বিপরীতে নিরাপত্তা বিধানের প্রচেষ্টা যেকোনো গুরুতর সংকটে সমাধান দিতে পারে না।

যাদের জন্য দেশ ও রাষ্ট্রযন্ত্র যেকোনো সংকট মুহূর্তে তাদের জীবন বিপন্ন হওয়া থেকে রক্ষা করার অতীব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যুগযুগ ধরে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। দেশপ্রেমের প্রথাগত ধারণা যেমন, শক্তিশালী সামরিক ব্যবস্থা, জনগণের মধ্যে উগ্ৰ জাতীয়তাবাদ ধারণার প্রসার, নিজেদের নাগরিকরাই সবার আগে, জনকল্যাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো গোপন রাখা এবং অন্য দেশের সঙ্গে বিনিময় না করা ইত্যাদি প্রচলিত ধারণার বিষয়গুলো যে দেশপ্রেম মাপার সূচক হতে পারে না, করোনাভাইরাস তা সকল দেশ ও তার জনগণকে নিষ্ঠুরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে ৭.৭ বিলিয়ন জনগণ জীবনের বিনিময়ে বুঝতে পেরেছে দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে আমিত্বের এবং সংকটকালীন একাকী চলার কোনো সুযোগ নেই।

করোনাভাইরাসের মহামারিতে দুইশতের অধিক দেশ/এলাকায় আক্রান্ত প্রায় ১১ লক্ষ মানুষ যখন আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে তখন সবচেয়ে বড় বিতর্ক হবে দেশপ্রেম সম্পর্কিত ধারণাগুলোর ব্যাখ্য এবং এ কাজে ব্যবহ্নিত ধারণাসমূহ যেমন ভূখণ্ড, পতাকা, জনগণ, জাতীয়তাবাদ, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, সামরিকশক্তি, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়গুলো। কোন দেশ এবং বিশ্বের জনগণের সুরক্ষার প্রদানের ব্যর্থতার কারণে মানুষ নতুনভাবে চাইবে দেশপ্রেমকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে। সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমকে কোনোভাবেই ছোট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না।

Advertisement

এতদিনের প্রচলিত ধারণাগুলো থেকে অবশ্যই দেশ ও জনগণকে বেরিয়ে আসতে হবে। মঙ্গলময় একটি সার্বজনীন ধারণা তৈরি করতে হবে। আর এতে করেই তৈরি হবে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক মানুষ এবং তাদের জন্য তৈরি ব্যবস্থা। দেশপ্রেমের নতুন ধারণার মাধ্যমে সুরক্ষা পাবে সমগ্র বিশ্বের মানুষ এবং তাদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল এই পৃথিবী। কোনো রাষ্ট্র নিজেদের নাগরিকের জন্য দেশপ্রেমের ধারণাপত্র তৈরি করলে যে ভয়াবহ পরিণাম সৃষ্টি হয়, করোনাভাইরাস আক্রান্ত এই পৃথিবী তা আমাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। করোনাভাইরাস যুদ্ধে জয়ী বদলে যাওয়া এ বিশ্বে দেশপ্রেম হবে সার্বজনীন তা কোনো দেশ বা গোষ্ঠীর স্বার্থে তৈরি করা কোনো ভঙ্গুর ও সংকটকালীন অকার্যকর ব্যবস্থাপত্র নয়।

বদলে যাবে আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক

চীনের উহানে আবির্ভূত করোনাভাইরাস মাত্র চার মাসের মধ্যে মহামারি রূপ ধারণ করে পুরো বিশ্বকে তছনছ করে দিয়েছে। করোনাভাইরাস মানেনি কোনো সীমানা, কোনো কাঁটাতারের বেড়া বা দেয়াল। কোনো পাহাড় বা জলরাশিও তাকে আটকাতে পারেনি। ইতোমধ্যে ২০৪টি দেশ/অঞ্চলের ১১ লক্ষাধিক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে পুরো বিশ্ব থেকে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেঁড়ে নিয়েছে। আক্রান্ত দেশগুলো সর্বশক্তি দিয়ে শতচেষ্টা করেও কোনোভাবেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট মহামারি ঠেকাতে পারছে না।

আশা করছি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব অচিরেই কমে যাবে। পুরো বিশ্ব আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে সচেষ্ট হবে। কিন্তু করোনাভাইরাসের ভয়াবহতায় মানুষের মনে, জীবন ও জীবিকায় যে তীব্র ক্ষত ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে এবং যে তীব্র মানুষিক সংকট তৈরি হয়েছে তার রেশ যে দীর্ঘদিন ধরে থাকবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

Advertisement

করোনার প্রাদুর্ভাব এবং প্রভাব আমাদের নিষ্ঠুরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে কোনো দেশ একা চলতে পারে না এবং এককভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তা যতই অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগভাবে শক্তিশালী হোক না কেন। করোনা সংকট আমাদের আর একটি কঠিন সত্যের মুখামুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যে দেয়া-নেয়া, লাভ-ক্ষতি, সামরিক কূটকৌশল, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার সূত্র ধরে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা যে কতটা ঠুনকো, অকার্যকর এবং অপরিণামদর্শী তা বিপদের মাঝে বুঝতে পারা। দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হওয়া সম্পর্কও কোনো দেশের জনগণকে সংকট কাটিয়ে উঠতে খুব একটা সহায়তা করতে পারেনি। নিশ্চিতভাবে এ ধারণা করা যায় যে করোনা উত্তর বিশ্বে এই ধরনের বন্ধুত্বের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা নিয়ে জনগণের মধ্যে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হবে।

যে রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে সবসময়ে গর্ব করে তারাও দেখেছে আন্তঃদেশীয় সম্পর্কে বিদ্যমান ধারণা এবং বৈশিষ্ট্য যুদ্ধময় পরিস্থিতিতে সীমিত কার্যকর হলেও, করোনার মতো মহামারি সামাল দিতে খুব একটা কার্যকর নয়, সবাই নিজের সুরক্ষা নিয়েই ব্যস্ত। তাই করোনা পরবর্তী বিশ্বে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবতে হবে আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের সূচক কী হবে? এলাকা, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি, আর্থিক সক্ষমতা, সামরিক শক্তি বৃদ্ধির যৌক্তিকতা, আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক বা ফোরাম গঠনের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নাকি অন্যকিছু? সবচেয়ে বড় বিতর্ক হবে কার্যকর সম্পর্ক তৈরির ভিত্তিগুলো আসলে কী হবে? কোন কোন বিষয়বস্তুকে সামনে রেখে আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক তৈরি করা হলে তা সবসময় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করবে। কোন ধরনের বৈষয়িক লাভক্ষতির বিষয়গুলো প্রথমে সামনে আসবে না। সবার আগে অগ্ৰাধিকার পাবে সমগ্ৰ বিশ্বের মানুষের এবং তাদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল এই পৃথিবীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা।

এই দুটি বিষয় যখন সামনে আসবে তখন নিশ্চিতভাবেই বদলে যাবে আন্তঃদেশীয় সম্পর্কগুলো। মঙ্গলময় সম্পর্ক তৈরির জন্য করোনা পরবর্তী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে নতুন করে মেরুকরণ শুরু হবে। নতুন ধারার এই মেরুকরণে সবার আগে স্থান পাবে মানবিকতা এবং পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য শর্তহীনভাবে কাজ করার অঙ্গীকার। যদি আমরা তা বাস্তবতার নিরিখে প্রবর্তন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে পরবর্তীতে করোনাভাইরাসের চেয়েও ভয়াবহ কোনো দুর্যোগের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি আমরা কোনোভাবেই মোকাবিলা করতে পারব না।

এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আন্তঃদেশীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বাস ও অবিশ্বাস দোলাচল থেকেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অগ্ৰাধিকার নির্দিষ্ট হয়েছিল, এর ফলে সবসময় উপেক্ষিত হয়েছিল এই বিশ্বের স্থিতিশীলতা এবং এর জনগোষ্ঠীর সত্যিকারের সুরক্ষার বিষয়টি। সামরিক শক্তির আধিক্য এবং জোট করোনাভাইরাসের এই কঠিন সময়ে কোনোভাবে জনগণকে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে পারে না, চরম মূল্যের বিনিময়ে আজ তা সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছে।

তাই করোনা পরবর্তী বিশ্বে প্রয়োজন একটি টেকসই ও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক। যার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের দেশগুলো আগামী দিনে তাদের অগ্ৰাধিকার নির্ধারণ করতে পারবে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব যত বিভীষিকাময় হোক না কেন, এই নিষ্ঠুর সময়ে মানুষ নিদারুণভাবে অনুভব করেছে, ক্ষুদ্রগোষ্ঠীভুক্ত দেশীয় সম্পর্কের চাইতে প্রয়োজন শর্তহীনভাবে সত্যিকারের ভালোবাসা এবং সকল দেশের মানুষে মানুষে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।

বর্তমান করোনা সংকট আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর যে প্রান্তেই অবস্থান করি না কেন এবং আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক অবস্থান যাহাই হোক না কেন আমারা মানবজাতি আসলে এক ও অভিন্ন। আমাদের মূল সংকট হচ্ছে সত্যিকারের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যা বিচ্ছিন্নভাবে কোনো দেশ, জাতি বা গোষ্ঠীর পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয় যদি সেখানে পারস্পরিক স্বার্থ মুখ্য হয়। এটি অর্জন করতে হবে সম্মিলিত ও নিঃশর্তভাবে এবং এই পৃথিবী ও সকলের মঙ্গলের জন্য।

এইচআর/বিএ/এমকেএইচ