করোনাভাইরাস জনিত বৈশ্বিক মহামারির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য মহাদুর্যোগ মোকাবিলায় ৮৭ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্যাকেজ প্রস্তাবনা দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি।
Advertisement
এই প্রণোদনা প্যাকেজের ৬১ হাজার কোটি টাকা স্বল্প মেয়াদি খাতে, ১৮ হাজার কোটি টাকা মধ্য মেয়াদি খাতে এবং ৮ হাজার কোটি টাকা অদৃশ্য ও অন্যান্য খাতে ব্যয় করার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।
শনিবার (০৪ এপ্রিল) সকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব এ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস নিয়ে দলের বক্তব্য তুলে ধরেছি। এখন আমরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের জন্য কতগুলো পদক্ষেপের প্রস্তাব রাখছি। তারমধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে স্বল্প মেয়াদে অনতিবিলম্বে, আর সময়ক্ষেপণ না করে। কিছু মধ্য মেয়াদে এবং কিছু দীর্ঘ-মেয়াদে।
Advertisement
‘আমাদের প্রদত্ত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য জিডিপির তিন শতাংশ অর্থ সমন্বয়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল ঘোষণা করতে হবে। শাটডাউন প্রত্যাহার হলে নতুন করে একটি সংশোধিত আর্থিক প্যাকেজ প্রদান করতে হবে যেন সব সেক্টরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সাধারণ ছুটি-পূর্ব স্তরে ফিরে আসতে সক্ষম হয়’ বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস গোটা মানবজাতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৮০ টি দেশে এই প্রাণঘাতী মহামারি ছড়িয়েছে। সরকারি সোর্স অনুযায়ী বাংলাদেশে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৬১ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ছয় জন। যদিও আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সঠিক তথ্য নিয়ে অনেকেই সন্দেহ করছেন।’
ফখরুল বলেন, ‘বিশ্বের মহাশক্তিধর রাষ্ট্র থেকে শুরু করে পার্শ্ববর্তী ভারতেও কোথাও পূর্ণ বা আংশিক লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। দেরিতে হলেও বাংলাদেশেও প্রাথমিকভাবে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত এবং পরে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত আংশিক শাটডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ করোনার তৃতীয় স্তরে পৌঁছেছে। অর্থাৎ করোনা এখন কমিউনিটি পর্যায়ে সংক্রমিত হওয়া শুরু হয়েছে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত নীতিমালা অনুযায়ী সবাইকে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দিন এনে দিন খায়’ এই ক্যাটাগরির সব শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা-ভ্যানচালক, হকার, ভাসমান শ্রমিক, ছিন্নমূল, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, সিএনজি ড্রাইভার, ভাড়াভিত্তিক গাড়ি চালক (উবার, পাঠাও ইত্যাদি), পরিবহন শ্রমিক, বস্তিবাসী ইত্যাদি শ্রেণির জনগোষ্ঠি মহামারির কারণে ঘোষিত লকডাউনে কর্মহীন হয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনতিবিলম্বে এদের মুখে খাবার তুলে দেয়া অপরিহার্য।
Advertisement
তিনি বলেন, ‘এদের কারও কারও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকলেও অনেকেরই নেই। স্থানীয় প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে এদের চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে চাল-ডাল-লবণ-তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। দ্রব্য সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতি ও জটিলতা এড়াতে পণ্যসামগ্রীর পরিবর্তে নগদ অর্থ দিতে হবে। কোনো প্রকারেই রাজনৈতিক বা দলীয় লোকজনকে এ কাজে সম্পৃক্ত করা যাবে না। প্রাথমিকভাবে এপ্রিল-মে-জুন এই তিন মাসের জন্য জনপ্রতি ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করে অনতিবিলম্বে ঘরে ঘরে গিয়ে অর্থ নগদ পরিশোধ করতে হবে।’
প্রয়োজনে সামরিক বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিকভাবে তিন মাসের জন্য আশ্রয়হীনদের অস্থায়ী আবাসন ও প্রয়োজনে তৈরি খাবার সরবরাহ করে তাদের দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এ জন্য ন্যূনতম আট হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, ‘সব শ্রমিক শ্রেণিকে (গার্মেন্ট, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় শিল্প ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত) সেবার জন্য অর্থ এবং জীবন যাত্রায় সমর্থন দিতে হবে। ৮০ লক্ষের অধিক শ্রমিক বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করছে। তাদেরকে নগদ সাহায্য দিতে হবে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে আগামী ছয় মাসব্যাপী সব অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরে কর্মরত শ্রমিকদের নগদ অর্থ সাহায্য দিয়ে জীবনযাত্রায় সমর্থন দিতে হবে। এই খাতে ছয় মাসের জন্য দুই কিস্তিতে প্রথম তিন মাসের এবং পরবর্তী কিস্তিতে অবশিষ্ট টাকা নগদ প্রদান করা যেতে পারে। খাদ্য যোগান দিতে দুর্নীতি ও জটিলতা এড়ানোর লক্ষ্যে খাদ্যসামগ্রী না দিয়ে নগদ অর্থ প্রদানই শ্রেয়।’
‘এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় সামরিক বাহিনী অর্থ বিতরণ করবে। এ খাতে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে কিস্তির নগদ টাকা পরিশোধ করতে হবে। জাতীয় পরিচয় পত্র এবং নিয়োগপত্র দেখে এদের চিহ্নিত করতে হবে’ বলেন বিএনপির মহাসচিব।
তিনি বলেন, ‘খাদ্য উৎপাদন যেন ব্যাহত না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে এবং বীজ, সার, কীটনাশক সেচসহ অন্যান্য সহযোগিতায় এর কাজ চালিয়ে যেতে হবে এবং প্রয়োজনীয় অর্থ এখনই বরাদ্দ করতে হবে। এ অর্থ ব্যাংকিং এবং প্রশাসনিক চ্যানেলে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকসহ কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।’
আগামী এক বছরের জন্য পোল্ট্রিসহ সব ধরনের কৃষি ঋণের কিস্তি ও সুদ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত সব ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মওকুফ করার প্রস্তাব দেন মির্জা ফখরুল।
তিনি বলেন, ‘যেসব প্রবাসী শ্রমিক খালি হাতে দেশে ফিরেছেন তাদের চিহ্নিত করে প্রত্যেক প্রবাসীকে তিন মাসের জন্য মাসিক ১৫ হাজার টাকা আপদকালীন আর্থিক সাপোর্ট প্রদান এবং যথাসময়ে পুনরায় বিদেশে স্বীয় কর্মস্থলে ফেরত যেতে পারেন সে জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য এ খাতে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাত এবং যারা করোনা মোকাবিলার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত সেসব হাসপাতাল এবং সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করতে হবে। ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন ঝুঁকির বিবেচনায় জরুরি ভিত্তিতে তাদের স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী তিন মাসের জন্য প্রত্যেক চিকিৎসকদের জন্য এক কোটি, নার্সদের জন্য ৭৫ লক্ষ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বীমার বিপরীতে প্রিমিয়াম সরকার বহন করবে।
দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা পরিবারকে আগামী তিন মাসের জন্য বিনামূল্যে রান্নার গ্যাস/গ্যাস ভর্তি সিলিন্ডার সরবরাহ করার প্রস্তাব দেন বিএনপির মহাসচিব।
কেএইচ/এমএফ/এমএস/এমএস
কেএইচ/এমএফ/এমএস