‘নভেল করোনাভাইরাস’ নিঃসন্দেহে এ শতাব্দীর গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম। কোনো ধরনের সামরিক যুদ্ধ নয়, নয় কোনো পারমাণবিক অস্ত্র কিংবা কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ; সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের ক্ষুদ্র এক মাইক্রোঅর্গানিজমের কাছে আজ গোটা পৃথিবী অসহায়। খালি চোখে দেখা যায় না। অথচ কোনো এক অদৃশ্য শক্তি রূপেই গোটা পৃথিবীকে সে অচল করে দিচ্ছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশ এক হয়েও রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে এ ক্ষুদ্র অণুজীবটির কাছে। সমগ্র পৃথিবী যেন আজ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে শুধু একটি ভাইরাসের কারণে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া ভাইরাসটি আজ অ্যান্টার্টিকা ছাড়া গোটা পৃথিবীতেই বিস্তার লাভ করেছে এবং প্রতিনিয়ত মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
Advertisement
কী সেই নভেল করোনাভাইরাস; যা আসলে মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে? করোনা শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ ‘ক্রনিক’ থেকে। যার সরল বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘দীর্ঘস্থায়ী’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাস্টিকসের পরিভাষায়, ক্রনিক বলতে সেই সব রোগকে বোঝায় যার প্রভাবে কোনো একজন রোগী দীর্ঘ মেয়াদে (ন্যূনতম) কোনো ধরনের শারীরিক জটিলতা ভোগ করে থাকেন। কিন্তু আদৌতে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় না। ক্রনিক ডিজিস প্রতিরোধে কোনো ধরনের ভ্যাকসিনও নেই। উদাহরণস্বরূপ আর্থ্রাইটিসকে আমরা ক্রনিক ডিজিসের সাথে তুলনা করতে পারি। কেননা আর্থ্রাইটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা এবং এখন পর্যন্ত সে অর্থে আর্থ্রাইটিসের সে রকম কার্যকরী চিকিৎসাও নেই।
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। করোনাভাইরাস মানুষের শরীরে সংক্রমণের সাথে সাথে খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং মানুষের ফুসফুস এবং অনেক সময় পাকস্থলিতেও বিশেষ ধরনের প্রদাহ সৃষ্টি করে। করোনাভাইরাসে সংক্রমণে সৃষ্ট রোগের নাম কোভিড-১৯, যার সঠিক চিকিৎসা হয়তো বা এখন পর্যন্ত বের করা সম্ভব হয়নি। এমনকি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোনো ভ্যাকসিনও আবিষ্কৃত হয়নি। তাই কোভিড-১৯ কে আমরা বিশেষ ধরনের করোনিক ডিজিস বলতে পারি। যা খুব দ্রুত সংক্রমিত হয়।
যেহেতু এ ভাইরাস টাইপটি আমাদের কাছে নতুন, তাই একে ‘নভেল করোনাভাইরাস’ বলে অভিহিত করা হয়। আবার যেহেতু ভাইরাসটি মানুষের শরীরের শ্বাসতন্ত্রে তীব্রভাবে প্রদাহের সৃষ্টি করে, তাই অনেকে একে ‘সার্স-২ ভাইরাস’ নামে অভিহিত করে থাকেন। অন্যভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, করোনাভাইরাসের নামকরণ করা হয়েছে ইংরেজি শব্দ ‘ক্রাউন’ থেকে। যার বাংলা প্রতিশব্দ ‘মুকুট’। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে ভাইরাসটি অনেকটা মুকুটের মতো দেখায় বলে এরকম নামকরণ করা হয়েছে বলে অনেকে দাবি করে থাকেন।
Advertisement
আমাদের শরীরে যখন জ্বর আসে; তখনই আমরা ধরে নেই যে, আমাদের শরীরে কোনো একটি ইনফেকশন ধরা পড়েছে। তাই সাধারণভাবে এ ভাইরাসও যখন মানুষের শরীরে আক্রমণ করে; তখন জ্বর আসাটা স্বাভাবিক এবং একই সাথে সর্দি ও কাশির উপসর্গও দেখা যায়। এ কারণে অনেকে এ ভাইরাসকে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সাথে তুলনা করেন। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাধারণ কোনো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস যদি সর্বোচ্চ মানের ছোঁয়াচেও হয়, তা একজন থেকে সর্বোচ্চ বারো জনকে সংক্রমিত করতে পারে। কিন্তু এ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি একসাথে ২৭ কিংবা ২৮, এমনকি একসাথে ৫৭ জনকেও সংক্রমিত করতে পারে।
জার্মানির একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত ভিডিও অনুযায়ী, করোনাভাইরাস মূলত ছড়ায় হাঁচি-কাশি অথবা পারস্পরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে। কোনো পৃষ্ঠতলে এ ভাইরাস কতোক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে না পারলেও কিংবা বায়ুবাহিত কোনো মাধ্যমে এ ভাইরাসের জীবনকাল সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা সঠিকভাবে কোনো তথ্য না দিলেও ধারণা করা হয় যে, আমাদের নাসিকা রন্ধ্রের ভেতর দিয়ে এ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারে। পাশাপাশি এ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত কোনো রোগীর সংস্পর্শে আসার পর যদি আমরা আমাদের শরীরের কোনো অংশ- বিশেষ করে চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করি। করোনাভাইরাস মূলত আমাদের শ্বাসতন্ত্র- বিশেষ করে অন্ত্র, প্লীহা কিংবা ফুসফুসের ওপর বিশেষভাবে সংবেদনশীল।
সম্প্রতি অস্ট্রিয়ার গ্রাজে এক মেডিকেল ইনস্টিটিউশনের গবেষণায় দেখা গেছে, এ ভাইরাস পাকস্থলিকে সংক্রমিত করতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে জ্বর কিংবা সর্দি-কাশি এ ধরনের কোনো উপসর্গ ছাড়াই আক্রান্ত ব্যক্তি সরাসরি পেটে ব্যথা এবং পরিপাকজনিত জটিলতার শিকার হতে পারেন। নির্দিষ্ট পোষকদেহের বাইরে ভাইরাস জড় এবং নিষ্ক্রিয়। তাই কেবল একটি জীবিত কোষে প্রবেশ করলেই ভাইরাস সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। আমাদের ফুসফুস কয়েক মিলিয়ন অ্যাপিথিলিয়াল কোষ দ্বারা গঠিত। অ্যাপিথিলিয়াল কোষ মূলত শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ ও মিউকাসের বহিরাবরণ হিসেবে কাজ করে। করোনাভাইরাস এ আবরণের একটি নির্দিষ্ট গ্রাহক কোষের সাথে যুক্ত হয় এবং অন্যান্য ভাইরাসের মতো গতানুগতিক ধারায় তার জেনেটিক উপাদান প্রবেশ করায়। যার প্রভাবে কোষটির অভ্যন্তরে এ জেনেটিক উপাদানের অনুলিপি সৃষ্টি হয় এবং তা পূর্নবিন্যাসিত হতে থাকে। অচিরেই কোষটি মূল ভাইরাসের অসংখ্য অনুলিপিতে ভরে ওঠে এবং অচিরেই তা একটি ক্রান্তি পর্যায়ে এসে মূল কোষকে বিদীর্ণ করে বাহিরে বের হয়ে আসে। এমনকি আশেপাশের কোষগুলোকে একইভাবে আক্রান্ত করে। এ প্রক্রিয়াকে রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়া বলা হয়।
আক্রান্ত কোষের সংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে। দেখা যায়, এক সপ্তাহ কিংবা দশ দিনেই এ ভাইরাস ফুসফুসের কয়েক মিলিয়ন কোষকে আক্রান্ত করতে পারে। যার প্রভাবে ফুসফুস কয়েক কোটি ভাইরাসে পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যদিও অনেক সময় এ মুহূর্তে এসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তা তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। যখন শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোষগুলো কিংবা রক্তে থাকা লিম্ফোসাইট শরীরের ফুসফুসে এসে পৌঁছায়; তখন করোনাভাইরাস এ সব কোষকে সংক্রমিত করতে পারে। গোটা পৃথিবী যেমনিভাবে ইন্টারনেট দ্বারা একে-অপরের সাথে সংযুক্ত; ঠিক তেমনি শরীরের বিভিন্ন কোষ সাইটোকাইনস নামক এক ক্ষুদ্র প্রোটিনের মাধ্যমে একে-অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। তাই প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়াই এর প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে এ রোগ প্রতিরোধ কোষগুলো অতিপ্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকে। ফলে কোষগুলোর মাঝে অতিরিক্ত উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ কোষগুলোকে লড়াইয়ের উন্মাদনায় ফেলে দেয়।
Advertisement
বিজ্ঞানীদের মতে, এ উন্মাদনার ফলে মানব মস্তিষ্কের তাপ নিয়ন্ত্রণকারী অংশটি অর্থাৎ হাইপোথ্যালামাস অংশটি উদ্দীপ্ত হয় যার প্রভাবে জ্বর আসে। দুই ধরনের কোষ এ ধরনের প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যথা- নিউট্রোফিলস, যারা মূলত একই সাথে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আক্রান্ত কোষের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং এক ধরনের এনজাইম নিঃসরণ করে। এ এনজাইমের প্রভাবে আক্রান্ত কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও কিছু সুস্থ কোষও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরেক ধরনের প্রতিরক্ষা কোষ হচ্ছে কিলার টি-সেল, যারা মূলত অটোফেগি প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রিতভাবে আক্রান্ত কোষগুলোকে ধ্বংস হওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে এরা এতো বেশি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়ায়, তারা আশেপাশের সুস্থ কোষগুলোকেও আত্মহত্যার জন্য নির্দেশ দেয়। যতো বেশি প্রতিরোধক কোষ ছুটে আসে, ক্ষতির পরিমাণ ততোই বৃদ্ধি পায় আর ততো বেশি সুস্থ ফুসফুস টিস্যু তারা মেরে ফেলে। প্রক্রিয়াটি এতোটাই গুরুতর হতে পারে যে, মাঝে-মধ্যে ফুসফুসে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। যা ফাইব্রোসিস নামে পরিচিত।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ আবার তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ফিরে পেতে আরম্ভ করে। যার প্রভাবে সংক্রমিত কোষগুলো মারা যেতে থাকে এবং ভাইরাসের নতুন করে সংক্রমণের সম্ভাবনা নস্যাৎ হতে শুরু করে। যাদের ইমিউন সিস্টেম অত্যন্ত শক্তিশালী তাদের অনেকে এ পর্যায়ে এসে সুস্থ হয়ে গেলেও যাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম- বিশেষ করে কারও যদি ডায়াবেটিসের সমস্যা থাকে অথবা কারও যদি শ্বাসজনিত কোনো সমস্যা থাকে, তাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করে। তখন লাখ লাখ অ্যাপিথেলিয়াল কোষ মারা যায় এবং একই সাথে ফুসফুসের সুরক্ষাকারী আস্তরণটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে অ্যালভিওলাই অর্থাৎ বাতাসের যে থলির মাধ্যমে আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে থাকি, তা বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়। এতে রোগী নিউমোনিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং তাদের শ্বাসকার্যে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় শ্বাসকার্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং তখন কৃত্ৰিম শ্বাস-প্রশ্বাস বা ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। ইতোমধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর হাজার হাজার ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত, এমন সময় লাখো ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ও বংশ বিস্তার তার শরীরে নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি করে। অনেক সময় এসব ব্যাকটেরিয়া ফুসফুসের প্রাচীরকে ছিন্ন করে রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে। এমনটি ঘটলে মৃত্যু অনেকটাই অনিবার্য।
অস্ট্রিয়ার গ্রাজে অবস্থিত এক মেডিকেল ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, কোনো কোনো সময় ফুসফুসের কোষে ভাইরাসটি কাঙ্ক্ষিতভাবে বংশ-বিস্তার ঘটাতে না পারলে তারা পাকস্থলিতে চলে আসে এবং পাকস্থলি কোষে একইভাবে সংক্রমণ ঘটায়, যার প্রভাবে ডায়রিয়া কিংবা পাকস্থলিতে বড় কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই অনেক সময় কোনো ধরনের জ্বর, গলাব্যথা কিংবা সর্দি-কাশি ছাড়াই সরাসরি ডায়ারিয়া কিংবা পাকস্থলির কোনো জটিলতাও হতে পারে করোনা সংক্রমণের লক্ষণ। সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ক্ষেত্রে জ্বর, সর্দি-কাশি কিংবা গলাব্যথার পাশাপাশি অন্য কোনো উপসর্গ তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না।
করোনাভাইরাস যেহেতু একটি আরএনএ ভাইরাস, তাই এর মিউটেশনের হারও অনেক বেশি। এ কারণে ভাইরাসটি দ্রুত তার টাইপ পরিবর্তন করতে পারে। যদিও সব সময়ই যে মিউটেশন অর্থাৎ আরএনএ এর জিনোমের সিক্যুয়েন্সের পরিবর্তন আমাদের জন্য ক্ষতিকারক হবে, তেমনটি নয়। আর যেহেতু ভাইরাসটি আমাদের সবার কাছে নতুন, তাই এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোনো ওষুধ তৈরি করা যায়নি। যদিও অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসের দেহে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে না। তবুও অনেকে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় অ্যাজিথ্রোমাইসিনের কথা বললেও সুনির্দিষ্টভাবে এক্ষেত্রে এর কার্যকরিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যেহেতু কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের সাথে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত নিউমোনিয়া তাই সেকেন্ডারি হিসেবে অ্যাজিথ্রোমাইসিন ব্যবহার করা গেলেও একটা ঝুঁকি থেকেই যায়। কেননা অ্যাজিথ্রোমাইসিন অত্যন্ত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক এবং অনেকের শরীরই এ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে সক্ষম নয়। ক্লোরোকুইনিনের কার্যকারিতা নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা দ্বিধা-বিভক্ত।
করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের সমাজে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। যেমন- অনেকেই বলে থাকেন যে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম কয়েক দিন এ ভাইরাস কেবল কণ্ঠনালী কিংবা গলায় আক্রমণ করে। এ সময় লেবুর রস, ভিনেগারসহ অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার এ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করতে পারে। ধারণাটি ভুল। এটি ঠিক যে, লেবুর রস কিংবা ভিনেগারের জীবাণুনাশক ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু ভাইরাসের লক্ষ্য হলো বংশবৃদ্ধি করা, আর সে কারণে সে চাইবে তার বংশবিস্তারের জন্য উপযুক্ত মাধ্যম অর্থাৎ করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যদি বলি তাহলে ফুসফুস, প্লীহা কিংবা অন্ত্রে যতোটা দ্রুত সম্ভব সংক্রমণ ঘটানো। আবার অনেকে ধারণা করে থাকেন যে, ৮০.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরে এ ভাইরাসটি জীবিত থাকতে পারেনি। ধারণাটি ভুল। মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। যদি তাদের এ দাবি সত্য হতো, তাহলে কোনো মানুষই করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতো না।
আরও একটি ধারণা আমাদের অনেকের মাঝে প্রচলিত রয়েছে, কেবল ষাট কিংবা সত্তরোর্ধ্বদেরই এ ভাইরাসে সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ভাইরাসের সংক্রমণে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের একটি অংশের মানুষ মাঝবয়সী। কারও শরীরে কোভিড-১৯ ধরা পড়লে তাকে নিয়মিত পরীক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে যেটি করা যেতে পারে, সেটি হলো নির্দিষ্ট সময় অন্তর তার শরীরে লিম্ফোসাইট এবং ইএসআর পরীক্ষা করা। কেননা কোনো ব্যক্তি কোনো ধরনের ইনফেকশন দ্বারা আক্রান্ত হলে তার শরীরে এমনিতে লিম্ফোসাইট এবং ইএসআর অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এরপর যখন আবার তার শরীরে লিম্ফোসাইট এবং ইএসআরের মাত্রা স্বাভাবিক রেঞ্জে নেমে আসবে, সে সময় হয়তো বা আবারও তাকে কোভিড-১৯ এর জন্য পরীক্ষা করা যেতে পারে।
কোভিড-১৯ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে শুরু করে একজন রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে কমপক্ষে দুই-তিন সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণা দাবি করছে। এ দীর্ঘ সময় যেহেতু শরীরের অ্যান্টিবডি ভাইরাস এবং সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়ার সাথে লড়াই করার ফলে শরীর অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ মনে হওয়ার পরও একটি লম্বা সময় পর্যন্ত তাকে অন্য কোনো ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ কিংবা দ্বিতীয়বার করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
আমরা জানি, কোনো ভাইরাসের বহিরাবরণ ক্যাপসিড লিপিড এবং প্রোটিনের সমন্বয়ে গঠিত যৌগ লিপোপ্রোটিন দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে। যা মূলত একটি অ্যাসিডিক যৌগ। তাই এ ধরনের ভাইরাসের মোকাবেলায় সাবান দিয়ে নিয়মিত হাত পরিষ্কার করা একটি কার্যকরী সমাধান হতে পারে। সাবান হচ্ছে উচ্চতর ফ্যাটি অ্যাসিডের সোডিয়াম বা পটাশিয়াম লবণ, যা সহজে ভাইরাসের বহিরাবরণকে ধ্বংস করে দিতে পারে। পাশাপাশি কোনো ব্যক্তি যদি মনে করেন যে, তিনি করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত। তাকে তৎক্ষণাৎ যতো দ্রুত সম্ভব অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে এবং বেশি করে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার ও ভিনেগার গ্রহণ করতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ এ সময় সবাইকে সঙ্গে রাখতে হবে। যেমন- প্যারাসিটামল অথবা কারও যদি শ্বাস-প্রশ্বাসে কোনো সমস্যা থাকে। তাহলে সব সময় তার সাথে নেবুলাইজার রাখতে হবে।
জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের না হওয়া উত্তম। যেহেতু এ ভাইরাস হাঁচি-কাশি কিংবা বায়ুর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ছড়ায়। তাই বাইরে গেলেও সব সময় মাস্ক পরতে হবে। পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। পরিস্থিতি যদি খারাপের দিকে যায়, তখন নিকটস্থ হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত হ্যান্ড গ্লাভস পরার অভ্যাস করতে হবে। অনেক সময় কোনো বস্তুর পৃষ্ঠতল স্পর্শ করলে তার মাধ্যমেও ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা যখন গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায় এবং রোগী নিজের থেকে নিঃশ্বাস গ্রহণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন কৃত্রিম শ্বাস অথবা ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যে হারে এ ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পরে; সে হারে কোনো দেশে আইসিইউ বা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকে না।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, জার্মানির মতো দেশ যেখানে প্রায় আট কোটির মতো লোক বসবাস করে। সেখানে সব মিলিয়ে ভ্যান্টিলেশনের ব্যবস্থা রয়েছে ৪৮ হাজারের মতো। অস্ট্রিয়ায় সংখ্যাটি ৮ হাজারের কাছাকাছি। অর্থাৎ প্রয়োজন অনুপাতে আইসিইউ কিংবা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা কোনো দেশে নেই। এ কারণে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ্পে কন্তে বাধ্য হয়ে বলেছেন, সব রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সামর্থ তার দেশের নেই। তাই একমাত্র সচেতনতাই পারে এ রোগের বিস্তার থেকে রক্ষা করতে। পাশাপাশি সবাইকে সব সময় সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।
এসইউ/এমএস