মতামত

করোনাকালে সাংবাদিকদের পেশাগত ঝুঁকি

করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারে যেসব পেশাজীবীর নাম বড় ঝুঁকির তালিকায় উঠে আসছে, তাদের মধ্যে সবার আগে আছেন ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিন্তু যাদের নাম কেউ বলছে না, তারা হলেন এই ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে মানুষকে তথ্যসেবা দিয়ে যাওয়া সাংবাদিকরা। বাংলাদেশে সবচেয়ে বিপদে থাকাদের দলে সাংবাদিকরাও যে আছেন, তার বড় প্রমাণ উঠে এলো গতকাল শুক্রবার।

Advertisement

জানা গেল, করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক কর্মী। ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে তাকে। এছাড়া ওই কর্মীর সংস্পর্শে আসা আরও ৪৭ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। চ্যানেলটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পাদক নিজের ফেসবুকে এক পোস্টে এ তথ্য জানান। আক্রান্ত কর্মী দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন বলেও জানান তিনি।

আমরা জানি মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের কোনো অ্যান্টিবডি তৈরি হয়নি, তাই যে কেউই আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে রোগাক্রান্ত হয়ে উঠতে পারেন। সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্র মানুষের মাঝেই। তাই তাদের ঝুঁকিটা আসলে ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীদের চেয়েও বেশি।

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নামের এক বিপর্যয়ে বাংলাদেশের মানুষ আজ বিপন্ন। দ্রুত ধাবমান ভাইরাসের গতিতে শিল্প-বাণিজ্যের উদ্দাম গতি থমকে দাঁড়িয়েছে। এমনটা চললে অনেক প্রতিষ্ঠান বড় সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

Advertisement

আমরা দেখতে পাচ্ছি সংবাদমাধ্যমেও একই কালোমেঘ। করোনা-উত্তর সময়ে মানুষ কবে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে কাজে ফিরবে, তার উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু অন্যসব জরুরি সেবার মতো গণমাধ্যমকর্মীরা ঘরে বসে নেই, মানুষকে সঠিক তথ্য দিতে তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।

এমন এক কঠিন সময়ে মূলধারার গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও বেতার এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে চলা অনলাইনগুলো শুধু মানুষকে তথ্য সেবাই দিচ্ছে না, অনেক সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত গুজব ও অসত্য তথ্যপ্রচারকেও মোকাবিলা করে চলেছে। মহামারির সংকটে প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা যেমন জরুরি, তেমনি সত্যনিষ্ঠ তথ্যসেবাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের নিবেদিতপ্রাণ গণমাধ্যম উদ্যোক্তা ও সাংবাদিকরা দৃঢ় মনোবল ও দায়িত্ববোধ থেকে সাধারণ নাগরিকদের খবর পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম অতীতে অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। তবে এবারের মতো বৈরী পরিস্থিতি সাম্প্রতিককালে আর আসেনি।

মানুষ ঘরে আছে। এমন এক জটিল সময়ে, এমন এক অনিশ্চিত সময়ে মানুষের সবচয়ে বেশি প্রয়োজন তথ্য। ঠিক এই সময়টায় তথ্যের এই বিপুল চাহিদা মেটাতেই কাজ করছেন সাংবাদিকরা। খবরের খোঁজে প্রতিনিয়তই রিপোর্টার আর ক্যামেরা পারসনরা চষে বেড়াচ্ছেন সংক্রমণের শিকার হওয়া অঞ্চল; ঘুরছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে; কথা বলছেন বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক থেকে শুরু করে নানা ধরনের মানুষের সাথে। এতে মাঠের সেই রিপোর্টার বা ক্যামেরা পারসন শুধু নয়- তাদের পরিবারের সদস্য, বার্তাকক্ষে থাকা সহকর্মী এবং রিপোর্টের প্রয়োজনে যাদের কাছে যাচ্ছেন- সবাই কমবেশি ঝুঁকিতে পড়ছেন।

Advertisement

এটা বলতে গেলে এক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি। যুদ্ধের ময়দানে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে যে ধরনের নীতিমালা মানতে হয়, এখানে তার চেয়েও কঠিন বিধিবিধান মানতে হবে সাংবাদিকদের। কারণ যুদ্ধের ময়দানে সবাই জানে শত্রু আর মিত্র কারা। এখানে পুরো লড়াইটাই হচ্ছে এক অজানা শত্রুর সাথে।

সাধারণ নাগরিকদের জন্য যা প্রযোজ্য তা কি পারবেন সাংবাদিকরা? পারবেন যদি হাঁচি-কাশি হয় তাহলে নিজের নাক-মুখ চাপা দিয়ে রাখা, কিছুক্ষণ পরপর ২০ সেকেন্ড ধরে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত রগড়ে ধুয়ে ফেলা। সাবান বা জল না থাকলে ৬০ শতাংশ অ্যালকোহল আছে এমন হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা এবং মাস্ক পরা।

কিন্তু সাংবাদিকের পক্ষে কি সম্ভব ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে চলা। যে পরিবহনই ব্যবহার করা হোক না কেন, সাংবাদিকের উচিত সেটা থেকে নামার পরপরই হাত অ্যালকোহল-সমৃদ্ধ হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা। হাসপাতাল বা কোয়ারেন্টাইন জোনে প্রবেশের আগে জেনে নিতে হবে সেখানকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বা সংক্রমণরোধী ব্যবস্থা কেমন। সবচেয়ে ভালো নিজের ব্যবস্থা নিজে করা।

হাসপাতালে, গণজমায়েতে যারা যাচ্ছেন তারা হাতে অবশ্যই গ্লাভস এবং পরনে পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট রাখবেন এবং সেটা করতে হবে যে সমালোচনাই থাকুক না কেন। সাংবাদিকদেরও সবসময় মাস্ক ব্যবহার করা দরকার যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন।

এগুলো সবই সাংবাদিকদের নিজস্ব দায়িত্ব বা ঝুঁকি মোকাবিলার নিয়ম। কিন্তু সাংবাদিকরা যেখানে কাজ করেন, সেইসব প্রতিষ্ঠানেরও বড় দায়িত্ব আছে তার কর্মীদের নিরাপত্তা দেয়া। তাই তারা অফিসে বা গাড়িতে জীবাণুনাশক রাখবেন পর্যাপ্ত সেটাই প্রত্যাশা। এমন কোনো রিপোর্টার বা ক্যামেরা পারসনকে হাসপাতাল, কোয়ারেন্টাইন জোন অথবা সংক্রমণ আছে এমন জায়গায় পাঠানো ঠিক না যাদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস বা শ্বাসকষ্টজনিত অসুখ আছে।

অর্থাৎ কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় পাঠানোর আগে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। রোগের হটস্পট, অর্থাৎ যেখানে বিস্তার বেশি- যেমন প্রার্থনাস্থল, ত্রাণবিতরণ কেন্দ্র, বাজার বা সমাবেশে গেলে অবশ্যই পিপিইসহ সব সরঞ্জাম নিয়ে সেখানে যেতে হবে।

রিপোর্টিং করতে গেলে মানুষের সাথে কথা বলতেই হয়। তাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সাক্ষাৎকার নিতে হবে। প্রতিটি ইকুইপমেন্ট সাক্ষাৎকার শেষে অ্যালকোহল ওয়াইপ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা প্রয়োজন।

এমন অনেক কথাই আলোচনা করা যাবে। কিন্তু প্রয়োজনটি অনুভব করতে হবে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠাগুলোকে। স্ব স্ব গণমাধ্যমকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে এবং সেগুলো মেনে মেনে চলার বাধ্যবাধকতা ঠিক করতে হবে। এককথা সবার মনে রাখা দরকার, বিশেষ করে গণমাধ্যম মালিকদের যে, সাংবাদিকরা পেশার প্রতি অনুগত, কিন্তু জীবনের মায়া ছেড়ে নিশ্চয়ই নয়।

এইচআর/বিএ/এমএস