অর্থনীতি

করোনা প্রণোদনায় উপেক্ষিত স্থানীয় উদ্যোক্তারা

করোনা ভাইরাসের হানায় থমকে গেছে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। পুরো বিশ্ব পতিত হয়েছে আর্থিক মন্দার কিনারে। এর প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতিতেও। পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে কর্মসংস্থান, রফতানি, প্রবাসী আয়সহ অভ্যন্তরীণ বাজারে সৃষ্টি হবে বড় সঙ্কট। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা নীতি-নির্ধারকদের সামনের দিনগুলোতে ঘুরে দাঁড়াতে করণীয় ঠিক করতে বলছেন।

Advertisement

তারা বলছেন, আর্থিক এ ক্ষতি মোকাবিলায় সুপরিকল্পিত এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতোমধ্যে এ সংকটকালীন সময়ের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন, ঋণের কিস্তি পরিশোধে শিথিলতাসহ বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে সরকার। এসব পদক্ষেপের সুবিধার বেশিরভাগই পাচ্ছেন রফতানি সংশ্লিষ্ঠ তথা বড় ব্যবাসয়ীরা। বিশেষ করে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে যেসব প্রতিষ্ঠানের মোট উৎপাদিত পণ্যের ৮০ শতাংশ রফতানি হয় তারা মাত্র দুই শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিয়েই কর্মীদের তিন মাসের বেতন দেয়ার জন্য ঋণ নিতে পারবে। কিন্তু এ তহবিলের আওতায় রাখা হয়নি অর্থনীতির প্রাণ বলে খ্যাত স্থানীয় অতি ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের।

তাই প্রণোদনার ক্ষেত্রে এ ধরনের উদ্যোক্তারা এখন পর্যন্ত উপেক্ষিতই রয়ে গেছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে চলমান করোনা পরিস্থিতিতে আর্থিক প্রণোদনা নিয়ে আগামী রোববার সংবাদ সম্মেলন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে এ ধরনের উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু প্যাকেজ ঘোষণা করার কথা রয়েছে। আর সে জন্যই রোববারের সংবাদ সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন স্থানীয় অতি ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।

রোববারের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে বৃহস্পতিবার (২ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব উত্তরণের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার বিষয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব ড. আহমেদ কায়কাউস, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া।

Advertisement

তিনি বলেন, আগামী রোববার (৫ এপ্রিল) সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন।

এদিকে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে হেলিয়ে দেয়া করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবিকায় এরই মধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা না করলে এবং সে অনুসারে কাজ না করলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, মানুষকে রক্ষা করতে হলে চলতি ও আগামী বাজেটকে সাধারণভাবে চিন্তা করলে চলবে না। বর্তমানে জরুরি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এটা অনিশ্চিত যে কতদিন এভাবে চলবে।

তিনি আরও বলেন, প্রতিবছরই কিছু অলংকারধর্মী কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। যেমন ট্রেনিং প্রোগ্রাম, যেগুলো এ বছর না হলেও চলবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ, বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান যেগুলোর প্রয়োজন নেই, সেগুলো বাদ দিয়ে জরুরি প্রয়োজনে খাদ্য নিরাপত্তা ঠিক রাখতে হবে। একই সঙ্গে বেশি বেশি অর্থ স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা নিরাপত্তায় ব্যয় করতে হবে।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, আমাদের এ মুহূর্তে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের ব্যবসায়ীদের দিকে নজর দেয়া দরকার। বড় ব্যবসায়ীরা নিজস্ব সঞ্চয় থেকে হয়তো টিকে থাকতে পারবে। তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সেটা পারবে না। সেক্ষেত্রে শিল্প ক্ষেত্রে প্রণোদনা বা সহজ শর্তে ঋণ ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের জন্যেই করতে হবে। সর্বোপরি দেশের মনুষের হাতে যদি টাকা থাকে এবং সে টাকা যদি মানুষ খরচ করে তাহলেই অর্থনীতির চাকা ঘুরবে।

এদিকে মহামারি করোনা ভাইরাস উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অতি ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য জরুরি তহবিল গঠনের আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।

শুক্রবার (৩ এপ্রিল) প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তহবিল গঠনে সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি।

ডিসিসিআই বলছে, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ব্যবসা বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে। দেশের অর্থনীতি, রফতানিমুখী শিল্প কলকারখানা, স্থানীয় বাজার নির্ভর উৎপাদন খাত, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পখাত, সেবা খাত, অতি ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসা, ট্রেডিং নির্ভর ব্যবসা, পরিবহন ব্যবসা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, মুদি দোকান, অপ্রচলিত খাত যেমন ভাসমান অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দোকান-পাট উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর এমনকি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের উপর যাতে করোনার প্রভাব না পড়ে সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। রফতানিমুখী শিল্প সুরক্ষায় শ্রমিকদের বেতনাদি পরিশোধের সুবিধার্থে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করেছে। এসব উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছে ডিসিসিআই।

ফরমাল (প্রচলিত) ও ইনফরমাল (অপ্রচলিত) খাতে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহ (এমএসএমই) অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে এমএসএমইদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতির সব স্তরে এমএসএমইর অন্তর্ভুক্ত সব খাত করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এখন অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত। অনেক এমএসএমই সীমিত বেচা-কেনা ও পুঁজি সংকটের কারণে খুব খারাপ সময় পার করছে। তাদের অনেকেই সময়মত শ্রমিক এবং কর্মচারীদের বেতনাদি পরিশোধ করতে পারছে না যা বেকারত্ব বৃদ্ধির আশংকা তৈরি করেছে। এ দুঃসময়ে ঢাকা চেম্বার সরকারকে স্থানীয় এমএসএমইর ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবে পরিচালনা ও এমএসএমই সুরক্ষায় স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদি আর্থিক, অনার্থিক নীতি পরিকল্পনানির্ভর সহায়তা প্রদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে ডিসিসিআই।

আর্থিকভাবে ক্ষতিতে পড়া এমএসএমই এবং অপ্রচলিত খাতের সুরক্ষায় বেতনাদি পরিশোধের সুযোগ করে দিতে ডিসিসিআই সরকারকে এক শতাংশ সুদে তিন বছর মেয়াদি একটি জরুরি তহবিল গঠন করতে বিশেষভাবে আহ্বান জানায়।

এছাড়া দোকানপাট, বিপণি বিতান ও শপিংমল বন্ধ থাকায় তাদের দোকানগুলোর দিনে ক্ষতি হচ্ছে এক হাজার ৭৪ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। তারা এ হিসাব করেছে একেকটি দোকানে গড়ে ২০ হাজার টাকা বিক্রি এবং ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ধরে।

এ হিসাব দিয়ে দোকান মালিক সমিতি কর্মচারীদের বেতন দিতে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠনের দাবি জানিয়েছে।

এক বিবৃতিতে সমিতি বলেছে, রফতানিখাতে মজুরি ও বেতন দিতে যে তহবিল গঠন করা হয়েছে, তারাও আংশিক সহায়তা হিসেবে একই ধরনের তহবিল চায়।

এমইউএইচ/এএইচ/জেআইএম