খেলাধুলা

ফুটবল মাঠই নয় রূপালী পর্দাও কাঁপিয়েছেন ওয়াসিম ইকবাল

আমার সিনেমার গল্প? বলেই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে একগাল হাসলেন খন্দকার ওয়াসিম ইকবাল। নামটি বলতেই নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছেন। সুদর্শন ও স্মার্ট হিসেবে যে ফুটবলার সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। ফুটবলের সবুজ গালিচাই নয়, তিনি কাঁপিয়েছেন রূপালী পর্দাও। ফুটবলার ওয়াসিমের সিনেমার গল্প শুনতেই বেছে নিলাম হোম কোয়ারেন্টাইনের দিনগুলো।

Advertisement

আবাহনী এবং ব্রাদার্সে খেললেও তার পরিচিত বেশি ব্রাদার্সের ওয়াসিম হিসেবে। কথায় বলে, চেহারায় নায়ক নায়ক ভাব। ওয়াসিম ইকবাল ছিলেন তার পুরোটা। যেমন চেহারা তেমন তার ফুটবল। আশির দশকে ওয়াসিম ইকবালের মতো স্টাইলিশ ফুটবলরা কমই ছিলেন বাংলাদেশে। গ্ল্যামার আর মাঠে যাদুকরী পারফরম্যান্স- এই দুটি মিলিয়েই ওয়াসিম ইকবালকে নিয়ে গিয়েছিল চিত্রজগতে, রূপালী পর্দায়।

ফুটবলার হিসেবে আপনার গল্প তো সবার মুখস্ত। যদি সিনেমার প্রসঙ্গটা বলতেন। আবার হাসি ওয়াসিম ইকবালের, ‘সেটা তো মাত্র একটি ছবি। বেশিদিন তো ছিলাম না। উপভোগ করেছিলাম; কিন্তু চালিয়ে যেতে পারিনি আর। কারণ, ফুটবলেই বেশি মনযোগ ছিল আমার’- সিনেমার গল্পের শুরুটা এভাবেই করলেন ওয়াসিম ইকবাল।

ওয়াসিম ইকবাল কলকাতা লিগে খেলেছেন ১৯৮৭ সালে ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে। ওই সময় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের এক কর্মকর্তা সিনেমার বিভিন্ন প্রোগ্রামের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ওয়াসিম ইকবালকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সিনেমা করার জন্য। কিন্তু ওয়াসিম রাজি হননি।

Advertisement

অনেক অনুরোধ, প্রস্তাব প্রত্যাখানের পর ওয়াসিম ইকবাল সিনেমা করতে রাজী হন তার ক্লাবের ব্রাদার্সের তৎকালীন ফুটবল সেক্রেটারি আজহারুল ইসলামের অনুরোধে। ‘তিনি আমাকে সব সময় বলতেন সিনেমা করতে; কিন্তু এসব আমার কখনো মাথায় ছিল না। আজহারুল ভাই একদিন খুব করে ধরলেন। বললেন একটি সিনেমা করে দাও। আমি এমনিতেই বলেছিলাম ‘করবো’। ব্যাস ধরা খেয়ে গেলাম। তার পরিচিত সিনেমার পরিচালক জহিরুল ইসলামকে গিয়ে কনফার্ম করে দিলেন যে আমি সিনেমা করবো। তারপর শুরু হলো’- বলছিলেন ওয়াসিম ইকবাল।

তো সিনেমাটা নিয়ে কিছু বলেন। ওয়াসিম ইকবাল বলেন, ‘হ্যাঁ। আমি যে ছবিতে অভিনয় করলাম তার নাম ‘জনি ওস্তাদ’। নায়ক রাজ রাজ্জাক ছিলেন ওই সিনেমায়। তখন সিনেমা বানাতে অনেক সময় লাগতো। আমার যতদুর মনে পড়ে ৫-৬ বছর লেগেছিল। ওই সময় সিনেমা হতো আংশিক রঙিন। গান আর মারপিটের দৃশ্যটা হতো রঙিন। বাকিটা সাদা-কালো। ওই ছবিটা যখন মুক্তি দেয়া হলো, তখন মাল্টিকালার করা হয়েছিল।’

আপনি কখনো নাটক বা এ জাতীয় কোনো কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কখনো? ‘না। ওসব আমার মাথায় ছিল না। আমার মাথায় ছিল শুধু ফুটবল। তবে আমি বিজ্ঞাপন করেছি তার আগে। হতে পারে বিজ্ঞাপন দেখেই সবাই আমাকে সিনেমা করার প্রস্তাব দিতেন’- বলেন ওয়াসিম ইকবাল।

কয়টা বিজ্ঞাপন করেছিলেন সিনেমায় ঢোকার আগে? ওয়াসিম ইকবালের জবাব, ‘মুম্বাইয়ের মাল্টোভা, ইউনিসেফ, শীতল ফেব্রিক্সসহ কয়েকটি বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। সব নাম মনে নেই। ওই সময় সব বিজ্ঞাপনের জন্য টাকাও দেয়া হতো না। মাল্টোভা কিছু টাকা দিয়েছে। তবে কি পরিমাণ দিয়েছে মনে নেই। অন্যরা দিতো উপহার। ইউনিসেফের বিজ্ঞাপনটা ছিল শিশুদের নিয়ে তাই আমিই টাকা নেইনি। শীতল ফেব্রিক্স কি যেন উপহার দিয়েছিলেন আমাকে।’

Advertisement

আপনি শুধু বিজ্ঞাপনই করেছিলেন। কখনো নাটক পর্যন্ত করেননি। তাহলে সিনেমার এত প্রস্তাব পেয়েছিলেন কি শুধু আমার গ্ল্যামারের কারণে? কতক্ষণ হেসে ওয়াসিম ইকবালের জবাব, ‘ওই সময় ফুটবলের জনপ্রিয়তা এতটা ছিল যে, হয়তো পরিচালকরা মনে করেছিলেন একজন ফুটবলার নিতে পারলে তাদের সিনেমা ভালো চলবে।’

একটি ছবি করেই ছেড়ে দিলেন কেন? নাকি উপভোগ করেননি? ‘আসলে দুই দিকে সময় দিতে সমস্যা হয়েছিল। একটি সিনেমা তৈরি করতে ৫-৬ বছর লাগলো। তাছাড়া দুই জগত দুই রকম। যেমন, সিনেমা করলে চেহারাটা ভালো রাখতে হয়। অনেক ঘুমোতো হয়। আর ফুটবল খেললে তো সেটা লাগে না। প্র্যাকটিস, প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস। আমরা যখন প্র্যাকটিসে থাকতাম তখন চেহারা আর চেহারার মতো থাকতো না। কেমন রুক্ষ হয়ে যেতো। তাছাড়া সিডিউল মেলানো কঠিন ছিল। মাঝেমধ্যেই জাতীয় দলের কারণে সিনেমার কাজ ড্রপ দিতে হয়েছে। ছবিটা যখন শেষের দিকে তখনও জাতীয় দলে ছিলাম। শেষ দৃশ্যটা করে দিন, শেষ দৃশ্যটা করে দিন- এভাবে পরিচালকে ঘুরতে হয়েছে আমার পেছনে। এসব কারণে নিজেকে শুধু ফুটবলেই রেখেছিলার। এটা ঠিক ওই সময় দুইটা সেক্টরই এনজয়েবল ছিল। যেমন ফুটবল, তেমন সিনেমা। এখন দুইটার কোনোটাই আগের মতো নেই’- এভাবেই আর সিনেমার দিকে পা না বাড়ানোর রহস্য বললেন ওয়াসিম।

পরে কখনো আপনার অভিনীত সেই ‘জনি ওস্তাদ’ ছবিটি দেখেছিলেন? ‘একবার দেখেছিলাম। ৬-৭ বছর আগে হবে। আমি তখন একটা কোচিংয়ে বাচ্চাদের পড়াতাম। একদিন রাতে আমার এক ছাত্র ফোন করে বললো, স্যার টিভিতে আপনার ছবি দেখাচ্ছে। সম্ভবত এটিএন বাংলা। আমি তাড়াতাড়ি করে ক্লাবে (ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে) গেলাম। ততক্ষণে ছবির অনেকটা হয়ে গেছে। শেষের অংশ দেখলাম ক্লাবের সবার সাথে। আমি সিনেমাটা দেখতে ওভাবে ছুটে গিয়েছিলাম দেখে সবাই খুব হাসাহাসি করছিল’- নিজের সিনেমা দেখার গল্প শোনালেন ওয়াসিম ইকবাল।

সিনেমা জগতের কারো সাথে এখন আর যোগাযোগ হয় না। ওয়াসিম বললেন, ‘না ।ওটাই আমার একটা সমস্যা। ফুটবল ছাড়ার পরও আমি ফুটবল নিয়ে চিন্তাও করিনি। শুনলে অবাক হবেন যে, আমি যখন খেলতাম তখনও ফুটবল খেলা দেখতাম না। এখনো দেখি না। ক্লাবের খেলা হলে সবাই যান, আমি যাই না।’

খন্দকার ওয়াসিম ইকবালের জন্ম ঢাকার নওয়াবগঞ্জে। নওয়াবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ওয়াসিম ফুটবলে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত একটানা ব্রাদার্সে খেলেছেন। এরপর ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে খেলেছেন আবাহনীতে। তারপর আবার ব্রাদার্সে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৯০ সালে। খেলেছেন দুই মৌসুম।

১৯৮৭ সালে তিনি কলকাতা লিগে খেলেছেন ইস্টবেঙ্গলে। ব্রাদার্সের অধিনায়ক ছিলেন ১৯৮৪ সালে। জাতীয় দলে খেলেছেন ১৯৮৪ সালে নেপাল সাফ গেমসে এবং ১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসে। ২০০৬ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন। তার আগে ১৯৮৫ সালে পেয়েছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির পুরস্কার।

আরআই/আইএইচএস/