আমি আমার জীবনে বিশেষ কোনো মহামারি ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব দেখিনি। ঋতুবদলের সময় সাধারণ ঠান্ডা-কাশি অনেকের হয়। বসন্ত ঋতুতে জলবসন্তটাও এখন বেশ সাধারণ বিষয়। এছাড়া ক’বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে দেখছি ডেঙ্গু জ্বরের আক্রমণ। গতবছর গ্রীষ্মে ডেঙ্গুর আক্রমণ ছিল ভয়াবহ। কিন্তু স্বভাবতই এবার করোনাভাইরাসের আক্রমণ আমাদের দেখা জাগতিক সকল অভিজ্ঞতাকে একেবারেই তুচ্ছ করে দেয়।
Advertisement
পরিবার-পরিজন তার প্রিয়জনের কাছে থেকেও হয়ে আছে দূর। ছোট শিশুরাও এখন নিজের পানি খাওয়ার মগটা আলাদা করে রাখে। কেউ ব্যবহার করে না অন্য কারও গোসলের তোয়ালেটা।
এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেছে আমরা মারণব্যাধি করোনাভাইরাসের বিস্তাররোধে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছি। ‘গৃহ’ শব্দটি উচ্চারিত হলে সাধারণ অর্থে অবধারিতভাবে ‘নারী’ শব্দটি মনে এসে উঁকি দেয়। আমাদের সমাজের গঠন অনুযায়ী আমরা ধরেই নেই ঘরের সমস্ত দায়দায়িত্ব এককভাবে নারীর দু’বাহুতে অর্পিত। ঘরের যাবতীয় গৃহস্থালি কাজকর্ম এবং ঘরের মানুষগুলোর দেখভালের অলিখিত একটা দায়ভার নারীকে দিয়ে রাখা হয়। চারজনের একটা পরিবারে একজন নারী প্রতিটি মানুষের পাতে ভাত বেড়ে দেবে, প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে, স্বামী-সন্তান এবং অন্যদের মানসিকভাবে ভালো রাখবে। এতসব অর্পিত দায়ভারের ভার নিতে গিয়ে নারীর দিনগুলো হয়ে ওঠে বিপর্যস্ত।
করোনাভাইরাসের বিস্তার এবং সংক্রমণ ঠেকাতে গৃহস্থালি কাজে সাহায্যকারী গৃহকর্মীদের কিছুদিন গৃহকাজে যোগদান থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এমন না যে, এই সকল গৃহকাজ এখন আর করতে হচ্ছে না। আর ঠিক সে কারণে হোম কোয়ারেন্টাইনের সময় একজন নারীর ওপর নেমে এসেছে অতিরিক্ত কাজের বোঝা। আকার-প্রকারে আমরা বলছি যে, ঘরের সকলে মিলেমিশে গৃহস্থালির কাজ করছি। কিন্তু প্রকৃত চিত্র আসলে ভিন্ন।
Advertisement
নারীকে আমরা সাধারণ হিসেবে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলি। যারা শুধু গৃহকর্ম করে থাকেন এবং যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করে থাকেন। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুই ধরনের নারীই ঘরে আছেন। যারা প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করেন তারা ঘরে বসেই করছেন অফিসের কাজকর্ম। আবার পরিবারের দেখভালও করছেন। গৃহকর্মীহীন ঘরেও জীবন থেমে থাকে না। নারী এখন ডাবল-ট্রিপল দায়িত্ব পালন করছেন। ঘরের সমস্ত কাজ করছেন আবার অফিসের ডেলিভারেবলগুলোও নিশ্চিত করছেন। এতকিছু করতে গিয়ে নারী তার নিজের জীবনকে করে তুলছেন অসহনীয়। এই অবস্থা চলতে থাকলে ধারণক্ষমতার অত্যধিক কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
নগরজীবনে আমাদের বেশির ভাগেরই দীর্ঘদিন ধরে ঘরে বসে থাকার অভ্যাস নেই। গৃহবাসের ক’দিন গেলেই মানুষ হয়ে উঠেছে অস্থির। সময় কাটাতে খাওয়া-দাওয়া একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। ‘আজ ভুনা খিচুড়ি খেতে চাই’-আপনি হয়তো অর্ডার দিয়েই খালাস হয়ে যাচ্ছেন। পরিবারের এক একজনের আলাদা আলাদা চাহিদা মেটাতে নারীর যে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে সে খেয়ালটাওতো রাখা চাই।
টিনএজ ছেলেমেয়েদের ঘরে আটকে রাখা আরেক মুশকিলের কাজ। তাদের উচ্ছল-চঞ্চল উড়ুক্কু মন ঘরের মধ্যে আটকে রাখার দায়িত্বটাও নিতে হচ্ছে কোনো একজন মাকে। ফলে তিনি তার কিশোর-কিশোরীটির কাছে হয়ে উঠছেন অ-জনপ্রিয়। তাছাড়া শিক্ষায়তনগুলো বন্ধ থাকলেও স্কুল-কলেজের পাঠগুলো ঘরে করে নিতে হচ্ছে। একজন মা এই কাজগুলো করে করে হচ্ছেন সন্তানের বিরাগভাজন। আবার সন্তানের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের কথা ভেবে তাদের কিছু বলাও যাচ্ছে না।
করোনাভাইরাসের বিস্তাররোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই। স্বল্প বিরতিতে ঘর-দোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টাও অবধারিতভাবে নারীর কাঁধে এসে পড়েছে। অন্যরা হয়তো এটা সেটা পরামর্শ, সাবান, স্যানিটাইজার কিনে এনেই নিজের দায়িত্ব সেরেছেন। কিন্তু ঘরের মানুষগুলোর সাথে সাথে ঘরটাকেও জীবাণুমুক্ত রাখার কাজটা কাজটা করে যাচ্ছেন নারী।
Advertisement
বিশ্বের অনেক দেশেই সাংসারিক কাজে সাহায্য করার জন্য গৃহকর্মী সুবিধার প্রচলন নেই। সেসকল দেশে সাংসারিক কাজগুলো নারী-পুরুষ উভয় মিলেই করে থাকেন। আমাদের দেশে গৃহকর্মী সুবিধা থাকায় গৃহস্থালি কাজে আমরা অনেকটাই তাদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই সময়ে তাদের অনুপস্থিতির অভাবটা শুধু নারীই পূরণ করবে-বিষয়টা যেন এমন না হয়।
আমাদের দেশের মানুষের একটা মাইন্ডসেট করা আছে-ঘরের কাজ, রান্না, ঘর পরিষ্কারের কাজগুলো নারীর জন্যই নির্ধারিত। এগুলো নারীরাই করবে। আদতে কাজের কোনো জেন্ডার নেই। ঘর গৃহস্থলির কাজগুলো নারী-পুরুষ সবার জীবনে একেবারে প্রাথমিক চাহিদা। এখন সুযোগ এসেছে এই আদিমকালের মাইন্ডসেট থেকে বের হয়ে আসার। ঘরের কাজগুলো পরিবারের সবাই মিলেমিশে করে ফেলা যায় অনায়াসে। শিশুরা শিশুর উপযোগী কোনো কাজ করতে পারে- শুধু তাদের একটু উৎসাহ দিতে হবে বাবা-মা দুজনকেই। রান্না আর পরিষ্কারের কাজগুলো নারী-পুরুষ ভাগাভাগি করে সেরে ফেললে নারীর ওপর নেমে আসবে না বাড়তি চাপ।
যিনি গৃহিণী-গৃহকর্মীর অবর্তমানে তিনি দ্বিগুণ কাজ করছেন। যিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনিও দ্বিগুণ-তিনগুণ কাজ করছেন। মনে রাখা দরকার, পুরুষরা যেমন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছেন- নারীও তাই করছেন। তাকেও অফিসের কাজগুলো সঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে হচ্ছে।
আজকাল কোনো কোনো পুরুষ পুরোনো মাইন্ডসেট থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তাদের আন্তরিক সাধুবাদ। যারা এখনো পুরোনো ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি তারা নারীর প্রতি অর্পিত অন্যায্য দায়িত্বের ভার নিজে আধা-আধি নিয়ে নিতে পারেন এখনই।
বলা হয়, দশের লাঠি একের বোঝা। আর মিলেমিশে কাজ করলে দিনশেষে বলা যায়-জীবন সুন্দর!!
এইচআর/বিএ/এমএস