করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের প্রতি বিশেষভাবে নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. সেলিনা সুলতানা। ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিকস ডিপার্টমেন্টের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত তিনি। জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি বিশেষ শিশুদের বাবা-মাসহ সবার প্রতি এই পরামর্শ দিয়েছেন।
Advertisement
ডা. সেলিনা সুলতানা বলেন, ‘২ এপ্রিল ১৩তম বিশ্ব অটিজম অ্যাওয়ারনেস ডে। এ উপলক্ষে প্রতিটা অর্গানাইজেশন অথবা মেডিকেল কলেজ সেমিনার, কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। কোভিড-১৯ নিয়ে বিশ্বের সবাই অস্থিরতার মধ্যে আছি। সেক্ষেত্রে বিশেষ শিশুদের নিয়ে এত বড় একটি গ্যাদারিং বা অনেক লোক সমাগম আমরা এভয়েড করেছি।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজে আমরা একটা চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট ক্লিনিক স্থাপন করেছি। আমাদের শ্রদ্ধেয় চেয়ারম্যান প্রফেসর কাজী কামরুজ্জামান স্যারের তত্ত্বাবধানে আছে ডিপার্টমেন্টটা এবং এখানে আমি চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্যারেন্টস কাউন্সিলিং সাইডটা মেইনলি ডিল করছি। আমাদের ক্লিনিক্যাল সাইকলজিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট, নিউট্রিশনিস্ট, সাইক্রিয়াটিস্ট, পেডিয়াট্রিক, নিউরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টগুলো ইনক্লুড আছে।’
করোনাভাইরাস সম্পর্কে অটিজম শিশুকে যেভাবে বোঝাবেন
Advertisement
ডা. সেলিনা সুলতানা বলেন, এবার আমাদের ম্যাসেজটা মেইনলি থাকবে বিশেষ শিশুদের বাবা মাদের প্রতি যে, সন্তানদের একটু স্পেশাল কেয়ার নেবেন করোনাভাইরাসের এই অবস্থায়। বিশ্বের এই ভাইরাস আউট ব্রেকটায় আমরা যেন অস্থির না হয়ে যাই। আমরা যেন, আমাদের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে স্পেশাল যত্ন নেয়ার চেষ্টা করি। তাদের খাদ্যতালিকার দিকে একটু যত্ন নিতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি অর্থাৎ তরলজাতীয় খাবার, ভিটামিন সি জাতীয় খাবার, হেলদি ফুড এবং ফ্রুটস- এগুলো যেন আমরা তাদের খাদ্যতালিকায় রাখি।’
‘রেগুলার এক্সারসাইজটাকে আমরা বলি, এটা একটু ভালো হয় যদি আমরা তাদের প্র্যাকটিসটা রাখি। তাদের খেলাধুলার মাধ্যমে চেষ্টা করা যায়, তাদের ঘুম, তাদের চলাফেরা, তাদের মনোরঞ্জনের জন্য বা মনের বিকাশের জন্য খেলাধুলার প্রতি একটু যত্নবান হই। যেহেতু সাধারণ শিশু তাকে আমরা বোঝালেই বুঝে যাবে যে, করোনাভাইরাস কতটুকু মারাত্মক বা বিস্তার ব্যাপকতা কতটুকু। কিন্তু এসব বিশেষ শিশুকে বোঝানোর জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থা আছে। তাদের সেভাবে গাইড করে আস্তে আস্তে বোঝাতে হবে এবং এই ইনফেকশনগুলো যেন এসব বাচ্চার মধ্যে না ছড়াতে পারে সেটি আমাদের গুরুত্বসহকারে নজর দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। আমরা ফোনের মাধ্যমে এসব বিশেষ শিশুর পিতা-মাতার সঙ্গে কমিউনিকেশনের খুব ভালো একটা ব্যবস্থা রেখেছি। তারা আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এবং তাদের বাচ্চাদের কী করতে হবে সে জিনিসগুলো আমাদের কাছ থেকে জানছেন। এ বছরটাকে আমরা এভাবেই পালন করার চেষ্টা করছি।’
তিনি বলেন, ‘অটিজম বা যেকোনো ডিসঅ্যাবিলিটির ক্ষেত্রে আমার এটা বলার থাকবে যে, একটা সাধারণ শিশুকে করোনাভাইরাসের মডেল দেখালে যে, এর দ্বারা ইনফেকশনে আমাদের ঠান্ডা, কাশি, জ্বর হতে পারে, গায়ে ব্যথা হতে পারে, মাথা ব্যথা হতে পারে, অনেকাংশে খাবারের রুচি থাকে না। এভাবে বললে সাধারণ শিশু একটাপর্যায়ে বিষয়টা বুঝে যায়। কিন্তু একটা স্পেশাল বাচ্চা অর্থাৎ অটিজম বা যে কোনো ডিসঅ্যাবিলিটির বাচ্চাকে এটা বোঝাতে একটু অন্য ধরনের ব্যবস্থা নিতে হয়। যেমন :- এসব বাচ্চা দেখা যায় ভিজুয়াল লার্নার হয়। দেখে তারা শিখতে খুব পছন্দ করে। সেক্ষেত্রে আমাদের প্ল্যানটা থাকবে যে, আমরা ভিজুয়াল কিছু কার্ড, ফ্ল্যাশ কার্ড, কিছু ছবি, এগুলো ড্র করে তাদের বোঝাব। একটা স্টোরি আমরা বলতে পারি। যেমন :- রেগুলার স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের বোঝাতে হবে স্কুলটা কেন বন্ধ। আমি একটি স্কুলের ছবি এঁকে দেখিয়ে বলব, আমরা আগামী কয়দিন এই স্কুলে যাব না। কেন যাব না? কারণ, ভয়ের ছবি একে দেখাতে পারি যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে আমাদের জ্বর হবে, মাথা ব্যথা হবে, এই এই ব্যাপারগুলো হবে। তো এই ভাইরাসটাকে এভয়েড করার জন্য আমরা স্কুলে যাব না। আমরা খেলার মাঠে যাব না। আমরা পাবলিক প্লেসে যাব না। আমরা মলে যাব না। ফুড শপগুলোতে যাব না। এভাবে যদি ছবি এঁকে আমরা বাচ্চাদের বোঝাই তারা বুঝতে পারবে যে, আগামী কয়দিন তারা যেতে পারবে না। বাচ্চাদের একটা প্রশ্ন থাকতে পারে যে, আমরা কয় দিন যেতে পারব না। সেক্ষেত্রে আমরা ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতে পারি বাচ্চাদের বোঝানোর জন্য। কালার পেন ব্যবহার করে, যে আগামী সাত দিন আমি যাব না অথবা আগামী এক মাস আমি ঘর থেকে বের হব না।’
ছবি এঁকে এঁকে অটিজম শিশুকে বোঝান
Advertisement
‘একটা ঘরের ছবি এঁকে আমরা বলব যে, এই ঘরটার ভেতরেই আমরা নিরাপদ। সেখানে তার একটা ছবি দেখিয়ে বলব যে, এখানে এটা হচ্ছে তুমি, এটা বাবা, এটা মা, এটা আমরা সবাই। বাবা এখান থেকে অফিসে যাচ্ছে না। মা অফিসে যাচ্ছে না। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব। আমরা এখান থেকে বাইরে বের হলেই যা হবে তা বোঝাতে আরেকটা বাচ্চার ছবি আঁকব। দেখাব যে, এই বাচ্চাটা তোমার কাছ থেকে আক্রান্ত হতে পারে বা ওই বাচ্চা থেকে তুমি আক্রান্ত হতে পার। এভাবে যখনই আমরা বাচ্চাটাকে বুঝিয়ে দেব সে সুন্দর মতো বুঝে যাবে এবং তারপরে যে প্ল্যানটা হবে তাকে আমাদের একটা ভালো জিনিস বলতে হয়, মানে একটা পজিটিভ ব্যাপারও বলতে হয় নেগেটিভ সাইটটার পাশে। তাকে বলে দেব যে, আগামী এতদিন পর আমরা অবশ্যই আবার ফুড কোর্টে যাব, মলে যাব, স্কুলে যাব, আমাদের এই ভাইরাল ইনফেকশনটা বা এই জীবাণুটা আমাদের কাছে থাকবে না তখনই। আমরা একটা গ্রুপ ফ্রেম ভাই বোন সবাইকে এঁকে বোঝাতে পারি। আবার আমরা একত্রে সবার সঙ্গে খেলতে পারব, মিশতে পারব, বেড়াতে যেতে পারব। ঠিক এভাবে করে বিশেষ শিশুকে বোঝাতে হবে। খাদ্যতালিকা প্রস্তুত করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়া, তরলজাতীয় খাবার খাওয়া, সেটা খেলে তার জ্বর হবে না। এগুলো ছবি এঁকে এঁকে তাকে বোঝাতে হবে এবং এসব বাচ্চা সাধারণত এগুলোতেই ভালো রেসপন্স করে। ছবিটা তাদের মনে একদম গেঁথে যায়,’ -বলেন ডা. সেলিনা সুলতানা।
অটিজম নিয়ে সচেতনতা
এ প্রসঙ্গে ডা. সেলিনা সুলতানা বলেন, ‘আগে এটা নিয়ে সচেতনতা বলতে গেলে একদমই কম ছিল। আমাদের মধ্যে একটা জিনিস ছিল, ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে, প্রতিটা বিশেষ শিশুর জন্মগ্রহণের পেছনে তার বাবা মার কোনো পাপ থাকতে পারে, কোনো ফ্যামিলির অভিশাপ থাকতে পারে, এ ধরনের কিছু ব্যাপার ছিল। কিন্তু ইদানীং এগুলো থেকে আসলে আমরা বের হতে পেরেছি। এ জন্য এপ্রিল মাসটাকে সচেতনতার মাস বলা হচ্ছে এবং এপ্রিলের ২ তারিখটাকে আমরা বিশেষভাবে মানার চেষ্টা করছি। বাবা-মা সবার কাছে একটাই ম্যাসেজ থাকবে এসব বাচ্চাকে আমাদের সমাজের সব সাধারণ শিশুর মতো গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের সেভাবে তৈরি করে যদি গ্রহণ করি, তাদের সেভাবে সামাজিকতা বোঝাতে পারি, তারা অবশ্যই আমাদের সঙ্গে মিশে যেতে পারবে এবং এই সচেতনতার প্রচারগুলো আমাদেরই করতে হচ্ছে। আমরা করছি এবং আগের চাইতে এই সচেতনতা আমাদের সাধারণ জনগণের মধ্যে অনেক ভালো রেসপন্স করছে। তারা এসব বাচ্চাকে আমাদের সঙ্গে সমাজে একসেপ্ট করছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের বর্তমান সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন সর্বক্ষেত্রেই প্রশংসনীয়। বিশেষ করে তাদের একটা বৃত্তি চালু করেছেন। তাদের জন্য কিছু রুলস তৈরি করেছেন। তাদের জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অনেক কিছু পরিবর্তন করেছেন। যেটা অন্যান্য গভর্মেন্টের কাছে ছিল না। এখনকার একটাই ল্যাক আছে সেটার জন্য আমাদের গভর্মেন্ট প্লান করছেন। সেটা হচ্ছে বিশেষ শিশুদের জন্য একটা খেলাধুলার মাঠ। খেলাধুলার পরিবেশ। যেখানে উন্মুক্ত পরিবেশ তাদের জন্য দরকার। যেখানে সব বাচ্চাও খেলবে তাদের সঙ্গে বিশেষ শিশুরাও খেলবে। আমরা ঠিক সেভাবেই একটা উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করছি। বর্তমান সরকারও সে ব্যাপারে কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘এই মাঠগুলো হবে আমাদের শহরভিত্তিক। গ্রামে তো কোনো প্রশ্নই নেই। গ্রামে তো খুব সুন্দর খেলার মাঠ। সুন্দর ব্যবস্থা আছে। সেখানে সেসব বাচ্চার এসব লিমিটেশন নেই। কিন্তু আমাদের ঢাকা শহরের অবস্থায়, শহরকেন্দ্রিক অর্থাৎ সারাদেশের শহরগুলোতে এ ব্যবস্থা করলে বিশেষ বাচ্চাদের জন্য ভালো হয়। প্রকৃতি থেকে তারা যেটা শেখবে সেটা আসলে বলে শেখানো খুব কষ্টকর হয়ে যায়। প্রকৃতি থেকে যেটা শেখবে সেটা হচ্ছে আদর্শ শিক্ষা।’
কেএইচ/জেডএ/পিআর