বৈশ্বিক প্রাণঘাতী মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব পুরো বিশ্বকে যেন উলট-পালট করে দিয়েছে। যারফল সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে আমাদের সবার মৌলিক দায়িত্ব প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া। ইসলামের দিকনির্দেশনাও এটি।
Advertisement
ইসলাম এমন এক পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম। এতে প্রতিবেশি এবং আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও খোঁজ-খবর রাখার ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। প্রতিবেশি যে ধর্ম-বর্ণ-জাতিগোষ্ঠীর হোক না কেন সুখে-দুঃখে তার পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষাই দেয় ইসলাম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-ذَلِكَ الَّذِي يُبَشِّرُ اللَّهُ عِبَادَهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ قُل لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى وَمَن يَقْتَرِفْ حَسَنَةً نَّزِدْ لَهُ فِيهَا حُسْنًا إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ شَكُورٌআল্লাহ তার ওইসব বান্দাকে এ সুসংবাদ দেন যে, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে। বলুন, আমি আমার দাওয়াতের জন্যে তোমাদের কাছে কেবল নিকটাত্মীয়সুলভ ভালোবাসা, সৌহার্দ চাই। যে কেউ উত্তম কাজ করে, আমি তার জন্য তাতে পুণ্য বাড়িয়ে দেই। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকারী, গুণগ্রাহী।' (সুরা শুরা : আয়াত ২৩)
এ আয়াতে বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা হলো সবাই যেন আত্মীয়তার ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। যারা ঈমানদার এবং সৎকাজ করে তারা কখনই আত্মীয়স্বজনের বন্ধনকে ছিন্ন করে না। মুমিন মুসলমান ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত রাখে, আত্মীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখে এবং প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে। এটি ইসলামের নির্দেশ। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-وَاعْبُدُواْ اللّهَ وَلاَ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالاً فَخُورًا
‘আর উপাসনা কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্নীয়, এতীম-মিসকীন , প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্ বিতজনকে।' (সুরা নিসা : আয়াত ৩৬)
Advertisement
আমরা যদি কুরআনের শিক্ষার ওপর আমল করি তাহলে একটি চমৎকার ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যে সমাজে পাড়া প্রতিবেশির সঙ্গে ঝগড়া হবে না। প্রতষ্ঠিত হবে প্রতিবেশির সুসম্পর্কপূর্ণ অধিকর। বাড়বে পরস্পরের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। ইসলামের নির্দেশনা মনে একে অন্যের উপকার করার চেষ্টা করবে, প্রত্যেকের অধিকার প্রত্যেকে আদায় করতে চেষ্টা করবে। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশিকে কষ্ট না দেয়।’ (মিশকাত)
ইসলাম প্রতিবেশির অধিকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাই করোনার এ দুর্যোগপূর্ণ সময়ে অসহায় গরিব প্রতিবেশি ও আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখা জরুরি। হাদিসে প্রিয় নবি ঘোষণা করেন-
‘জিবরিল আলাইহিস সালাম এসে আমাকে প্রতিবেশির ব্যাপারে অবিরত উপদেশ দিতে থাকেন। আমার মনে হল হয়তো তিনি প্রতিবেশিকে সম্পদের ওয়ারিশ বানিয়ে দেবেন।’ (মুসলিম)
Advertisement
ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার প্রতিও বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, অবিশ্বাসীদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক এবং অমুসলিম (আত্মীয়দের) হলেও তার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছে। হাদিসে এসেছে-
হজরত আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় আমার আম্মা মুশরিক থাকতে একবার আমার কাছে আগমন করলেন। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী। আমি কি আমার আম্মার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানালেন, ‘হ্যাঁ', তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সুতরাং বৈশ্বিক মহামারি করোনার এ প্রাদুর্ভাবের এ দুঃসময়ে অসহায়-গরিব প্রতিবেশির প্রতি যথাযথ দৃষ্টি দেয়া যেমন জরুরি তেমনি তা কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনাও বটে। আর তা পালনে রয়েছে মহা প্রতিদান ও উপকারিতা।
মনে রাখতে হবেইসলামের অসংখ্য অনুশাসন মেনে চলা সত্বেও ওই সব লোক মুমিনদের অন্তর্ভূক্ত হতে পারবে না, যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং প্রতিবেশিদের সঙ্গে উত্তম আচরণ না করে। ইসলামের সুমহান শিক্ষা হচ্ছে- প্রত্যেক মুমিন পরস্পর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বজায় রাখবে। প্রতিবেশির ক্ষতি করা থেকে নিজেদের বিরত রাখবে। তবেই পরিপূর্ণ মুমিন হওয়া সম্ভব। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! সে মুমিন নয়। জিজ্ঞাসা করা হলো- কে মুমিন নয় ইয়া রাসুলুল্লাহ? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে উত্তরে বললেন, যার অনিষ্ঠ থেকে তার প্রতিবেশি নিরাপদ নয়।’ (বুখারি, মুসলিম)
তাই সব সময় প্রতিবেশির অধিকারের দিকে লক্ষ্য রাখা যেমন জরুরি। আবার করোনার এ প্রাদুর্ভাবের সময় গরিব অসহায়দের দিকে দৃষ্টি দেয়া আর বেশি জরুরি। তাদের প্রতি মুমিন মুসলমানের কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো-
- ভ্রতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় রাখা।- প্রতিবেশির সুবিধ- অসুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখা। - প্রতিবেশির যেন কোন ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে দৃষ্টি রাখা।- প্রতিবেশির অভাব-অনটন দূর করার চেষ্টা করা।- প্রতিবেশির সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া।- প্রতিবেশি অসুস্থ হলে তার সেবা-যত্ন করা। - প্রতিবেশির মৃত্যুতে জানাজায় অংশগ্রহণ করা।
বিশেষ করে প্রতিবেশির সুসংবাদে তাকে যেমন উৎসাহিত করা তেমনি তার বিপদ-আপদে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়া এবং সহানুভূতি প্রকাশ করাও সবার নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। তাই জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব প্রতিবেশি সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার তাদের প্রতি সম্মান দেখানো উত্তম আচরণ ও ভাব বিনিময় অব্যাহত রাখা জরুরি।
আসুন, বৈশ্বিক মহামারি করোনার এ কঠিন পরিস্থিতিতে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, অসহায় ও গরিব প্রতিবেশিদের পাশে দাঁড়াই। তাদের খোঁজ-খবর নেই।
মহান আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককেই নিজ নিজ এলাকায় গরিবদের প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মোতাবেক শান্তিপূর্ণ নিরাপদ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সচষ্টে হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম