সিঙ্গাপুর লকডাউনে না গিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নির্দেশনা জারি করে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করছে৷ কেন দেশটি লকডাউনে যাচ্ছে না? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সিঙ্গাপুরের উন্নয়নমন্ত্রী লরেন্স ওয়াং বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউন গুরুত্বপূর্ণ নয়, দরকার সচেতনতা। সবাই চুপ করে ঘরে বসে থাকলেই সমাধান হবে না। এতে জনজীবনে স্বাভাবিকতা হারিয়ে যাবে। ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য কোনো জাদুকরী সমাধান নেই৷
Advertisement
তিনি বলেন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ আরও কিছু দেশ জনসাধারণের চলাচলের জন্য সীমাবদ্ধতা জারি করেছে। ইউরোপের বেশকিছু দেশ লকডাউন ঘোষণা করেছে। চারদিকে এত লকডাউন তবুও তো কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। যেটা দরকার সেটা হলো সচেতনতা। সিঙ্গাপুর শিগগিরই আরও ‘কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তবুও লকডাউনে যাবে না। আমাদের দীর্ঘ সময় এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে৷
লকডাউন না করেও সিঙ্গাপুর সরকার করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ২৩ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছে। এর ফলেই দেশটিতে এখনো পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। সিঙ্গাপুরে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৯২৬ জন৷ মারা গেছে ৩ জন। সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন ২৪০ জন। বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৬৪৮ জন।
সিঙ্গাপুরে যেদিন প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়৷ সেদিনই দেশটির সরকার নড়েচড়ে বসে৷ তারা করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কমিটি গঠন করে।
Advertisement
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তিনটি রিস্ক লেভেল ঘোষণা করা হয়৷ রিস্ক লেভেলগুলো হলো; ইয়োলা, অরেঞ্জ ও রেড৷ ইয়োলো মানে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবাই সর্বশেষ চীন ভ্রমণ করেছেন। অল্পসংখ্যক লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত৷
দ্বিতীয় রিস্ক লেভেল অরেঞ্জ মানে কিছু কিছু স্থানীয় লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যাদের কেউ চীন ভ্রমণ করেনি কিংবা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো রোগীর সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই৷
সর্বশেষ রিস্ক লেভেল রেড (লাল) অর্থাৎ সারাদেশে বিভিন্ন স্থান থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলে এবং প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেই রিস্ক লেভেল রেড (লাল) ঘোষণা করা হবে৷ এখন চলছে রিস্ক লেভেল অরেঞ্জ৷
এরপর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করা হয়। আসুন জেনে নেই কি সেই নির্দেশনা।
Advertisement
১) সদ্য চীনফেরত ব্যক্তিদের ১৪ দিনের লিভ অফ এবসেন্সে পাঠানো হয়। এই ১৪ দিন তারা বাসায় থাকবে। তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। যদি এ সময়ের মধ্যে শরীরে করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা না যায় তবেই কাজে যেতে পারবে৷
২) প্রতিটি বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি এমনকি শপিং মলের সিঁড়ি, লিফট ক্যামিকেল স্প্রে করে ভাইরাস মুক্ত করা হয়৷
৩) স্থানীয় ও অভিবাসী প্রত্যেকের দৈনিক ২ বার শরীরের তাপমাত্রা চেক করা হয়৷
৪) কোনো এক গ্রুপের একজন বা কোন বাসার একজনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে সে পরিবার বা গ্রুপের সকলকে আলাদাভাবে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়৷ যাতে করোনাভাইরাস ছড়াতে না পারে৷
৫) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সরকারি খরচে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে৷
৬) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সর্বশেষ গির্জায় ভ্রমণ করার কারণে তিনটি গির্জা বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
৭) এমপি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি একমাসের বেতন করোনা মোকাবিলার জন্য সরকারি তহবিলে অনুদান দেয়।
৮) সিঙ্গাপুর জনশক্তি মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন ভাষায় (বাংলা, তামিল, ইংরেজি ও অন্যান্য) সচেতনতামূলক বিভিন্ন লিফলেট বিতরণ করা শুরু করে৷
৯) গৃহকর্মীরা সিঙ্গাপুরে ফিরলে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক করে।
১০) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন কয়েকটি মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাওয়ার কারণে সিঙ্গাপুরের সমস্ত মসজিদ বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
১১) যেকোন দেশ থেকে সিঙ্গাপুরে এলে তাকে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে৷ এই নিয়ম সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী স্থানীয় ও অভিবাসী সকলের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য করা হয়।
১২) গৃহকর্মী যারা ছুটিতে আছে তাদের সিঙ্গাপুরে ফিরতে হলে জনশক্তি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিতে হবে৷ বর্তমান অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত তাদের ছুটিতে দেশে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
১৩) সমস্ত ওয়ার্ক পাশ হোল্ডার, এমনকি ডিপেনডেন্ট পাশ হোল্ডাদের সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করতে হলে দেশটির জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে। সিঙ্গাপুরে প্রবেশের পর বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে৷
১৪) ভ্রমণের ক্ষেত্রে কয়েকটি দেশে কড়াকড়ি নির্দেশনা জারি করে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, জাপান, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং আসিয়ান দেশসমূহ থেকে সিঙ্গাপুরে ফিরলে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক করে৷
১৫) তাছাড়া চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া ও স্পেন এই ৭টি দেশ থেকে সিঙ্গাপুরে ভ্রমণ কিংবা ট্রানজিট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়৷
১৬) সিঙ্গাপুরে ফিরলে যেকোন দেশের নাগরিককে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়।
১৭) সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করতে হলে সমস্ত ওয়ার্ক পাস হোল্ডার, এমনকি ডিপেনডেন্ট পাশ হোল্ডাদের সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে এবং সিঙ্গাপুরে প্রবেশের পর বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে৷
১৮) ট্যাক টুগেদার নামে মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়৷ এর মাধ্যমে খুব সহজেই কন্ট্রাক ট্রাক করা যাবে৷ অর্থাৎ ব্যবহারকারী কোনো করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে গেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তার সাথে যোগাযোগ করে পরিবর্তী করণীয় জানানো হবে৷
১৯) কোনো ওয়ার্ক পাশ হোল্ডার যদি দেশে যায় তবে তার নিজ দায়িত্বে যেতে হবে। এই পরিস্থিতিতে কোন ওয়ার্ক পাশ হোল্ডার দেশে গেলে পরিবর্তীতে তারা আর সিঙ্গাপুরে ফিরতে পারবে না৷
২০) সিঙ্গাপুরে যেকোন দেশের ভিজিটর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়৷
২১) সিঙ্গাপুরের সমস্ত বিনোদন কেন্দ্র, বার, অডিটোরিয়াম বন্ধ ঘোষণা করা হয়৷
২২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস এমনকি খাবার টেবিলে একসাথে দশজনের বেশি বসা যাবে না।
২৩) অফিস, রাস্তাঘাট, জায়গায় একজন থেকে আরেকজন এক মিটার দূরত্বে থাকতে হবে৷ এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে ১০ হাজার ডলার বা ৬ মাসের জেল অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সিঙ্গাপুর সরকার ৪৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা তহবিল ঘোষণা করেছে।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে প্রথমবারের মতো নতুন করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ার পর এখন বিশ্বের দুই শতাধিক দেশে তা ছড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে করোনায় আক্রন্ত মানুষের সংখ্যা ৮ লাখ ৭১ হাজার ৯৮৫ এবং মারা গেছেন ৪৩ হাজার ২৬১ জন। এছাড়া চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮২।
বিশ্বে নতুন এই ভাইরাসের তাণ্ডব মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশে ব্যাপক বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলেও প্রাণহানি ও সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। বেশ কয়েকটি দেশ প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের প্রতিষেধক এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে চীন, জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি ওষুধেরও পরীক্ষা চালানো হয়েছে। তবে প্রতিষেধক কিংবা ওষুধের জন্য আরও দেড় বছরের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে।
এমআরএম/এমকেএইচ