চারজন নারী পাঁচ শিশুকে সঙ্গে নিয়ে দুই দিন ধরে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। রাজধানীর এ-গলি থেকে ও-গলি, এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় তারা ঘুরছেন। কোথাও সরকারের ঘোষণা দেয়া চাল-ডাল পাচ্ছেন না তারা। ঘুরতে ঘুরতে বুধবার (১ এপ্রিল) বেলা ১১টার দিকে ক্লান্ত অবস্থায় রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার আগোরা সুপারশপের সামনে সড়ক বিভাজকের ওপর বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তারা। উচ্চবিত্তরা আগোরা সুপারশপের পাশে গাড়ি থামিয়ে বাজার করছেন আর এদিকে অভুক্ত নয়জন।
Advertisement
একজন উচ্চবিত্ত বাজার করে গাড়িতে ওঠার সময় সেই চার নারীর একজন ছুটে গেলেন তার কাছে। তার দুই সন্তানও গেল সঙ্গে। বাজার করে যাওয়া সেই ব্যক্তি তাদেরকে ১০০ টাকা দেন। সবাইকে ভাগ করে নিতে বললেন। এ সময় আরও কয়েকজন এসে হাজির হলো সেখানে। এরপর সেই ১০০ টাকার জন্য তাদের মধ্যে এক ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ যেন দুর্ভিক্ষের চিত্র।
বাকি তিন নারী তখন বলছিলেন, না খেয়ে মরে যাবেন, কিন্তু ভিক্ষা করবেন না।
তাদের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, সবাই আগে কর্মজীবী ছিলেন। করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। জমানো যে টাকা ছিল, তাও শেষ হয়েছে। তাই সরকারের ঘোষণা দেয়া চাল-ডালের আশায় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কিছুই পাননি এখনো।
Advertisement
তাদের একজন ফরিদা বলেন, ‘আমি তরকারি-মরকারি বেঁচি। অহন তরকারি বেঁচতে হারি না। পুলিশে বসতে দেয় না। মানুষও নাই। হেই কারণে এইহানে বইছি, দেহি সাহায্য-মাহায্য পাইনি। জি-পুত নিয়া কষ্টে আছি।’
দুই শিশু সঙ্গে নিয়ে ফরিদা বলেন, ‘কালকা রে বাবা দুনিয়াডা ঘুরছি। সারাডা রাইত এডি (পায়ে) ব্যথা। আজকা আবার বাইর অইছি।’
সেখানকার আরেক নারী বলেন, ‘তরকারি বেঁচি। কতদিন মানুষ নাই, সবাই গেছেগা বেড়াইতে। বেঁচতে হারি না। চাইর হাজার টেকা আছিল, এগুলা শেষ। এই কারণে রাস্তায় নামছি। আমগো ঘরে তিনজন মানুষ বওয়া (বেকার)।’
তিনি বলেন, ‘যে টেকা দিয়ে ব্যবসা করতাম, হেই টেকা তো বইয়াই খাইয়া হালাইছি আইজকা ১০ দিনে। ওই টেকা দিয়া চলতাম, ঘরভাড়া দিতাম।’
Advertisement
দুই ছেলে, এক মেয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছে উদিপার। তিনি নিজেও অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। করোনার কারণে সেটাও বন্ধ হয়েছে। উদিপা বলেন, ‘গত ২০ মার্চ থেকে বাসায় কাম বন্ধ। এ মাসের টেহা পাই নাই। আমার সাড়ে ৮ হাজার টেহা ভাড়া। চারজন মানুষ যদি এক ঘরে বসা থাহি, তাইলে কীভাবে চলব?’
উদিপা বলেন, ‘হুনতাছি, হাসিনা চাইল দেয়, ডাইল দেয়। কই? আমরা তো পাই না। আবার হুনি জাগায় জাগায় (জায়গায়) দিতাছে। দুই দিন ধইরা ঘুরতাছি। কোনো মানুষ পাই নাই।’
এমন সময় আগোরাতে বাজার করতে আসা এক উচ্চবিত্তের গাড়িচালক বলেন, চাল-ডাল পেতে হলে কাউন্সিলরের কাছে যেতে হবে।
ভোটার কার্ড দেখিয়ে উদিপা বলেন, ‘এই যে ঢাকার বুডার (ভোটার)। কমিশনার কয় যাও যাও, নাম ন্যাওয়া শেষ। কী কন, ঢাকার বুডার।’
ফরিদা বলেন, ‘কয় দ্যাওয়া শেষ। কাইল থেইকা ঘুরতাছি।’
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, করোনায় ফুটপাতে অনেক মানুষ শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছেন। তাদের এখন কাজও নাই, খাওয়াও নাই, থাকার ঘরও নাই।
দেশে করোনা রোগী আক্রান্ত হওয়ার পর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় লাখো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অতি দরিদ্রদের খাবার ফুরিয়েছে। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন, যাদের কিছুই করার নেই তারা নিরুপায় ভিক্ষা করছেন।
পিডি/এমএফ/জেআইএম