ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজধানী এবং দেশটির চতুর্থ বৃহত্তম মেট্রোপলিটন শহর চেন্নাইয়ে চিকিৎসা নিতে গিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন বাংলাদেশিরা। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করেছে মোদি সরকার। ফলে চিকিৎসা নিতে পারছেন না তারা। ক্যান্সার রোগীদের কেমো দেয়াও বন্ধ রয়েছে। মরণাপন্ন এসব রোগী শেষবারের মতো দেশে আসতে চাচ্ছেন।
Advertisement
এদের কারও কারও চিকিৎসা শেষ হয়েছে। অনেকের আবার সেখানে থাকার আর্থিক সক্ষমতা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে অঘোষিত লকডাউনের কারণে দেশে আসতে পারছেন না তারা। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সাহায্য কামনা করেছেন তারা।
চেন্নাই ছাড়াও মুম্বাই, নয়াদিল্লিতে আটকা পড়া বেশ কয়েকজন রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে যোগাযোগ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতাল, শংকর নেত্রালাই, ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও গ্লোবাল হাসপাতাল বাংলাদেশিদের কাছে খুব জনপ্রিয়। প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখেরও বেশি মানুষ ভারতে চিকিৎসার জন্য যান। চেন্নাই ছাড়াও সবচেয়ে বেশি রোগী যায় ভেলোরে। এছাড়া নয়াদিল্লি, ব্যাঙ্গালুরু, মুম্বাইও যান অনেকে। তবে কলকাতা যাওয়ার হার আগের চেয়ে কমেছে।
Advertisement
আটকাপড়া দিনাজপুরের অধিবাসী ফারহানা বিলকিস কামাল তার মায়ের চিকিৎসার জন্য চেন্নাই গেছেন। সেখানকার নিউরোলজিস্ট বলেছেন, তার মায়ের মস্তিষ্কের পেছনের দিকের নার্ভ শুকিয়ে গেছে। উনি কখনও আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবেন না। কিন্তু সেখানে অচল মাকে নিয়ে আটকা ফারহানা অথৈ সাগরে পড়েছেন।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চ ভোরে চেন্নাই থেকে আমাদের দেশে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ২৪ মার্চ রাতে নরেন্দ্র মোদির ভাষণের পর ভারত লকডাউন হয়ে যায়। সেই থেকে আটকা।’
তিনি বলেন, ‘অচল মাকে সামলানো ছাড়াও রান্না-বান্না করতে হয়। বাজারে যেতে হয়। কিন্তু এই অবস্থায় দেশেও ফিরতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আকুল আবেদন, তিনি যেন আমাদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করেন।’
চিকিৎসা নেয়া শেষ হয়েছে জান্নাতুল ইসলামের (৩০)। তিনি বলেন, ‘আমিসহ আশপাশে অনেক বাংলাদেশি চেন্নাইয়ের অ্যাপোলোতে চিকিৎসার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু লকডাউনের কারণে চিকিৎসা নিতে পারছি না। চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরও আটকে আছি। বর্তমানে এখানে খাবার পানি পর্যন্ত পাচ্ছি না। বাকিটা বুঝতেই পারছেন। বাংলাদেশ থেকে টাকা আনতে পারছি না। কী করব এখন বুঝতেছি না।’
Advertisement
চিকিৎসার জন্য গত ৫ মার্চ চেন্নাই গেছেন মোস্তাকিম অলিভ। কিছুদিন আগে তার চিকিৎসা শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এসেছি সাময়িকভাবে, তবে লকডাউনে পড়ে এতদিন অবরুদ্ধ থাকতে হবে ভাবিনি। দেশ থেকে টাকাও আনতে পারছি না। এখানে দোকানপাট বন্ধ। খাবার-দাবারও তেমন নেই। হোটেল মালিক ভাড়া কমাতে চায় না। এমতাবস্থায় কী করব বুঝতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘পুলিশের কাছে গেলেও তারা কোনো সাহায্যে করতে পারছে না। বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করলে তারা বলছে অপেক্ষা করতে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আমরা বাংলাদেশের প্রশাসন থেকে সাহায্যে চাই, আমাদের দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন দয়া করে। প্রধানমন্ত্রী কিছু করুন।’
মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে বাবা নির্মল কুমারকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে গেছেন তার ছেলে। তিনি বলেন, ‘লিভার ক্যান্সারের রোগী আমার বাবা। এখন ওনাকে বাংলাদেশ আনাটা খুব জরুরি। ২৮ ফেব্রুয়ারি বাবাকে নিয়ে এসেছি। কিন্তু ডাক্তার এখন জানিয়ে দিয়েছে লিভার ক্যান্সার অনেকটা ছড়িয়ে গেছে বাবার। চিকিৎসা করে উনার খুব একটা সুফল পাওয়া যাবে না। তাই এখন দেশে নিয়ে সেবাযত্ন করাটাই শ্রেয়। বাবা চান দেশে গিয়ে সবার মুখ দেখতে। এ বিষয়ে সরকারের সাহায্য চাই।’
অমিত কুমার পান্ডে নামে আরেকজন বলেন, ‘বাবাকে নিয়ে এসেছিলাম টাটা হসপিটালে। তার কেমো দিতে হবে ইমার্জেন্সি। কিন্তু এখানে করোনার জন্য নাকি দেবে না। দেশে গিয়ে দিতে বলছে। কিন্তু এখন তো দেশে যেতে পারছি না। এদিকে তার শরীরও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আর আমি একা। বুঝতেছি না কি করব! টাকা-পয়সাও শেষের দিকে।’
দিল্লি
নয়াদিল্লির বিএলকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আসিফ ইকবাল। তার চিকিৎসা ২৩ মার্চ শেষ হয়েছে। তারপর থেকে বাংলাদেশ আসার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে আরও আটজন আটকা পড়েছেন। বাকিদের বাড়ি কুমিল্লায়। আমি কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের রোগী। চেকআপের জন্য দিল্লি এসে আটকে আছি। কিছু একটা করেন ভাই, যা টাকা-পয়সা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রোববার (২৯ মার্চ) পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম টেলিফোনে জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারতে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ। আমরা শুনতে পাচ্ছি চিকিৎসা নিতে গিয়ে সেখানে কিছু বাংলাদেশি আটকা পড়েছেন এবং তাদের থাকতে অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের দূতাবাস ইতোমধ্যে একটি প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করেছে। যারা এখনও জানাননি, আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারা একসঙ্গে কতজন, কোথায় আছেন, নাম, বয়স, পাসপোর্ট নম্বর, যোগাযোগের জন্য মোবাইল নম্বর আমাদের দিল্লিতে অবস্থিত দূতাবাসে জানান। আমাদের দূতাবাসের টেলিফোন নম্বর ৮৫৯৫৫-৫২৪৯৪। যারা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, তাদের আবার জানানোর প্রয়োজন নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ণ তালিকা পেলে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সুবিধা হবে। তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে না আনতে পারা পর্যন্ত আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যেন তাদের চাহিদার বিষয়গুলো দেখভাল করেন। যারা ফিরে আসতে চান তাদের সবাইকেই আশকোনা হজক্যাম্পে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।’
এইচএস/এসআর/এমকেএইচ