বাদশা মিয়া ঢাকায় রিকশা চালান। গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম, সেখানেই থাকে পরিবার। প্রতি মাসেই গ্রামে যান পরিবারের খরচ দিয়ে আসেন। গত শুক্রবার গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। করোনাভাইরাসের কারণে সব যানবাহন বন্ধ হওয়ায় বাড়ি যেতে পারেননি। কিন্তু পরিবারের চলার জন্যতো টাকা পাঠাতে হবে। তাই দুর্যোগের এ সময়ে মোবাইলে টাকা পাঠালেন বাদশা মিয়া।
Advertisement
তিনি জাগো নিউজকে জানান, সবই বন্ধ হয়ে গেছে। এক ছেলে, এক মেয়ে, মা ও বউসহ ৪ জন গ্রামে আছে। তাদের খাওয়া-পড়ার টাকাতো লাগে। শুক্রবার যাবো বলে টাকা দেই নাই। কিন্তু তার আগেই তো সব বন্ধ হয়ে গেছে। তাই পরিবারের খরচের জন্য মোবাইলে টাকা দিলাম।
রিকশাচালক বাদশা মিয়ার মতো অনেকেরই করোনাভাইরাসের এ মহামারীর সময়ে অর্থ লেনদেনের প্রধান ভরসা মোবাইল ব্যাংকিং। মানুষ বিশেষ প্রয়োজনে লেনদেন সারছে মোবাইলে। তাৎক্ষণিকভাবে দ্রুত শহর কিংবা গ্রামে, গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
এদিকে করোনাভাইরাসের এ দুর্যোগকালীন সময়ে গ্রাহকের কাছে মোবাইলের লেনদেন আরোও জনপ্রিয় করতে বিশেষ ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
Advertisement
মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও ওষুধ ক্রয়ে কোনো ধরনের চার্জ না কাটার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি হতে ব্যক্তি (পি-টু-পি) লেনদেনে (যেকোনো চ্যানেলে) এ নির্দেশনা মানতে হবে। একইসঙ্গে লেনদেন সীমা ৭৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া দৈনিক এক হাজার টাকা ক্যাশ আউট সম্পূর্ণ চার্জবিহীন রাখতে বলা হয়েছে।
সাজ্জাদ নামের মোবাইলে ব্যাংকিংয়ের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট জানান, আগে মোবাইলে এক হাজার টাকা পাঠালে খরচ হিসাবে ২০ টাকা বেশি দিত। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে ১০০০ টাকা পাঠালে খরচ দিতে হয় না। কোম্পানিও চার্জ কাটে না।
লেনদেন বাড়ছে কিনা জানতে চাইলে সাজ্জাদ জানান, মানুষ কমে গেছে। সবসময় দোকান খোলা রাখতে দেয় না। তবে যতটুকু সময় খোলা থাকে লেনদেন ভালোই হচ্ছে।
করোনাভাইরাসের প্রদুর্ভাবকালীন সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে এমএফএস সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশের হেড অব কর্পোরেট কমিউনিকেশন অ্যান্ড পিআর শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম জাগো নিউজকে বলেন, শপিংমল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ। ব্যাংকের লেনদেনও সীমিত করা হয়েছে। এ সময়ে যখন দেশের বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। তখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকরা আমাদের উপর আস্থা রাখছেন। শুধু বিকাশে দৈনিক গড়ে ৫৭ থেকে ৫৮ লাখ বার লেনদেন হচ্ছে। স্বাভাবিক সময় ৬৫ থেকে ৭০ লাখ বার লেনদেন হয়। এতে বোঝা যাচ্ছে সব কিছু বন্ধ থাকার পরও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন ভালো হচ্ছে। অর্থাৎ বলা যায় অর্থনৈতিক লেনদেনের বড় একটা অংশ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সম্পূর্ণ হচ্ছে। গ্রাহক আমাদের প্রতি আস্থা রেখেছেন এটাই তার প্রমাণ।
Advertisement
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব ধরনের নির্দেশনা বিকাশ পরিপালন করছে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির এ কর্মকর্তা জানান, দৈনিক এক হাজার টাকা ক্যাশ আউটে কোনো চার্জ কাটা হচ্ছে না। কল সেন্টারের সার্ভিস চালু আছে। এজেন্টদের নিয়মিত নগদ ও ইলেক্ট্রনিক মানি সরবারহ করা হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য সুবিধাসহ সব ধরনের সেবা চালু রয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) সর্বশেষ তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি এনসিসি ব্যাংক তাদের এমএফএস সেবা বন্ধ করেছে। ফলে বর্তমানে দেশে মোট ১৫টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত আছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার। যা তার আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ৮ কোটি ৯ লাখ ১৬ হাজার। অর্থাৎ এক মাসে গ্রাহক বেড়েছে ১ দশমিক ১৬ শতাংশ।
জানা গেছে, টানা তিন মাস একবারও লেনদেন করেনি এমন হিসাবকে নিষ্ক্রিয় হিসাব বলে গণ্য করে থাকে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
এমএফএস তথ্য বলছে, আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন ও গ্রহক সংখ্যা বাড়লেও সেবায় সক্রিয় গ্রাহক সংখ্যা কমেছে। ফেব্রুয়ারি শেষে এমএফএস সক্রিয় গ্রাহক এক মাসের ব্যবধানে ১৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ ৮৭ হাজার। যা আগের মাস জানুয়ারিতে ছিল ৩ কোটি ৩২ লাখ ৯৪ হাজার। আর আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৮৫ হাজার ৯১৪ জন।
এমএফএস এ গত ফেব্রুয়ারিতে মোট ২২ কোটি ৬১ লাখ ৯ হাজার ৪০৫টি লেনদেনের মাধ্যমে ৪১ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ৪৭ লাখ টাকা লেনদেন হযেছে। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৪২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে শুধু লেনদেন নয়, যুক্ত হচ্ছে অনেক নতুন নতুন সেবাও। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল অর্থাৎ সেবা মূল্য পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ রেমিট্যান্স প্রেরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা দেয়া হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আলোচিত মাসজুড়ে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবগুলোতে ফেব্রুয়ারিতে টাকা জমা পড়েছে ১৪ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। উত্তোলন করেছে ১৩ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা।
আলোচিত সময়ে এমএফএসে রেমিট্যান্স এসেছে ২৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ব্যক্তি হিসাব থেকে ব্যক্তি হিসাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে ৯ হাজার ৭৯৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা বিতরণ হয়েছে এক হাজার ৮৭ কোটি টাকা। বিভিন্ন সেবার বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৪৪১ কোটি টাকা। কেনাকাটার বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৫৮১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। সরকারি পরিশোধ ২৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া অন্যান্য হিসাবে লেনদেন হয়েছে ৭৮০ কোটি টাকা।
২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেসের যাত্রা শুরু হয়। এর পরপরই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার বাজারের সিংহভাগই বিকাশের দখলে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমএফএস লেনদেনের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন গ্রাহক তার অ্যাকাউন্টে দিনে পাঁচ বারে ৩০ হাজার টাকা ক্যাশ ইন বা জমা করতে পারবেন। আর মাসে ২৫ বারে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা ক্যাশ ইন করা যায়। আগে প্রতিদিন দুই বারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা জমা করতে পারতো একজন গ্রাহক। আর মাসে ২০ বারে এক লাখ টাকা ক্যাশ ইন করতে পারতো গ্রহক।
এসআই/এসএইচএস/এমকেএইচ