মতামত

নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচতে দিন

এক সর্বগ্রাসী আতঙ্কে এখন সারাবিশ্ব জবুথবু হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস নামের এক বিধ্বংসী জীবাণু আজ মানবসভ্যতাকে চরম হুমকির মধ্যে ফেলেছে। পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি হয়েছে। দুই-দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ছাড়াও অসংখ্য দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ব্যাপক প্রাণহানি এবং সম্পদ বিনাশ হয়েছে এসব যুদ্ধে। কিন্তু কোনো যুদ্ধই দুনিয়াজুড়ে ঘরে ঘরে এমন দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়নি। ওইসব যুদ্ধে সৈনিকরা রণাঙ্গনে মুখোমুখি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়েছে, কেউ কেউ মরেছে।

Advertisement

চলমান করোনা-যুদ্ধের ধরন এবং প্রকৃতি ভিন্ন। এই শত্রুকে চোখে দেখা যায় না। কখন, কীভাবে, কাকে সংক্রমিত করছে, তা আগে থেকে টের পাওয়া যায় না। ধারণা করা হচ্ছে চীনে বাদুড় জাতীয় কোনো প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস কোভিড-১৯। এর বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণ চালানোর অস্ত্র এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে বিজ্ঞানীরা বসে নেই। করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে।

সৃষ্টির সেরা জীব দাবি করা এই আমরা আজ কত অসহায় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক অণুজীবের কাছে। পুরো মানবসভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে এই মরণব্যাধি। পৃথিবীর ক্ষমতাধর সব শাসকদের শাসিয়ে, অশ্রু নির্গত করিয়েও ক্ষান্ত হচ্ছে না এই নভেল করোনাভাইরাস। ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে যখন ছড়াতে শুরু করে তখন বিন্দুমাত্র ধারণা করা যায়নি এর ভয়াবহতা। পৃথিবীর প্রায় দুইশ দেশে ছড়িয়ে আজ বৈশ্বিক মহামারি (প্যানডেমিক) উপাধি পেয়েছে কোভিড-১৯। মানেনি কোনো ধর্মীয় বিভাজন, রাষ্ট্রীয় সীমানা, সরকার ব্যবস্থার ভিন্নতা কোনো কিছুকেই পরোয়া করেনি, করছে না করোনা।

চীনে প্রথম শুরু হওয়ায় একশ্রণির ধর্মান্ধ উল্লাস করেছিল, কিন্তু অচিরেই তাদের মূঢ়তাকে ভেংচি কেড়ে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব সীমানায়, সব ঘরে হানা দিয়েছে সে। রাজকুমার, রাজকুমারী, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, ফার্স্ট লেডি থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষটি পর্যন্ত সবাইকেই ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মৃত্যুর মিছিল হচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। কত মানুষের জীবন কেড়ে, কতদিন পর থামবে করোনার বিধ্বংসী দাপট তা-ও অজানা।

Advertisement

আজ থেকে শত বছর আগে পৃথিবী আর এক মহামারির কবলে পড়েছিল। এইচওয়ানএনওয়ান ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট স্প্যানিশ ফ্লুতে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। তখন বিশ্বে জনসংখ্যা ছিল দেড়শ কোটি। আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ৫০ কোটি মানুষ। আর মারা গিয়েছিল আনুমানিক পাঁচ কোটি কিংবা তারও বেশি সংখ্যক মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৮ সালের শুরুতে ওই মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়ে সমাপ্তি ঘটেছিল ১৯২০ সালে।

ওই মহামারির সময়ের অবস্থা নিয়ে কোনো লেখা আছে কিনা আমি জানি না। কোনো গল্প-উপন্যাসে ওই মহামারির ভয়াবহতার চিত্র ফুটে উঠেছে কিনা তা-ও আমার অজানা। পৃথিবীর কতটা দেশ স্প্যানিশ ফ্লুতে ভুগেছিল, কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সারা দুনিয়ার মানুষের, কীভাবে মোকাবিলা হয়েছিল তা জানতে পারলে এখন আমরা এখনকার করণীয় ঠিক করতে কিছুটা আলো পেতাম। ওই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার মতো মানুষ হয়তো এখন আর কেউ বেঁচে নেই।

করোনা ছোবল হানার পর তিন মাসের মতো সময় চলে গেছে। বিজ্ঞানীরা, গবেষকরা হিমশিম খাচ্ছেন করোনা প্রতিরোধের উপায় উদ্ভাবনে। করোনার ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সামাজিক দূরত্বকেই এখন পর্যন্ত একমাত্র উপায় বলে মনে করা হচ্ছে। কেউ কউ অবশ্য এটাকে সামাজিক দূরত্ব না বলে শারীরিক দূরত্ব বলাকেই শ্রেয় মনে করছেন। ভাইরাসটি সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি বলে একজন মানুষের থেকে আরেকজন মানুষের নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাটাই বেশি জরুরি। এই দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে তিন ফুট। বাতাসবাহিত না হওয়ায় এবং ভারী হওয়ায় বেশি দূর যেতে পারে না বলে এখন পর্যন্ত মনে করা হচ্ছে।

তবে এই রোগ প্রতিরোধে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক সংহতি বা মানবিক নৈকট্য প্রয়োজন। কে বিপদগ্রস্ত হবেন, সেটা যেহেতু পূর্বনির্ধারিত নয়, তাই সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। আতঙ্ক না ছড়িয়ে একে অপরের ভরসা হয়ে থাকতে হবে। নিজে যেমন নিরাপদ থাকতে হবে, বাঁচতে হবে, তেমনি অন্যকেও নিরাপদ রাখতে হবে, বাঁচাতে হবে। গুজব না ছড়িয়ে, নিজে নিজে বিশেষজ্ঞ না হয়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভুলভাল পরামর্শে বিভ্রান্ত না হয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।

Advertisement

বাংলাদেশও করোনার আক্রমণমুক্ত নয়। করোনায় আক্রান্ত হয়ে কয়েকজন মারা গেছেন। করোনার উপসর্গ নিয়েও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। উদ্দেশ্য সংক্রমণ ঠেকানো, মানুষকে ঘরে রাখা। কিন্তু মানুষ এটাকে ‘উৎসব' হিসেবে গ্রহণ করেছে। লাখে লাখে মানুষ গ্রামের দিকে ছুটেছে। হাটে মাঠে ঘাটে বাজারে চা দোকানে শ্বশুরবাড়ি, বিয়ের বাড়ি সবখানেই অবাধ পদচারণায় মুখরিত তাদের জীবন। এই অবস্থাটা বড় বিপদের কারণ হতে পারে।

শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে সরকার বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী নিয়োজিত করেছে। সেনাবাহিনীর সহায়তায়ও প্রশাসন মানুষকে ঘরে থাকা কিছুটা নিশ্চিত করলেও পুরোপুরি সফল হতে পারছে না। আমাদের কারও কারও মধ্যে নিয়ম না মানার এক ধরনের ক্ষতিকর প্রবণতা আছে। লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ ছাড়া তারা নিয়ম মানতে চান না। আবার কোথাও একটু বাড়াবাড়ি হলে আমরা সবাই সমালোচনা মুখর হয়ে উঠি।

ঘনবসতিপূর্ণ আমাদের দেশে আমরা যদি শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে না পারি, জনগণকে ঘরে থাকতে বাধ্য করতে না পারি তাহলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া আটকাতে পারবো না। আর একবার ছড়িয়ে পড়লে ইতালি-স্পেন-আমেরিকায় যা হয়েছে, তা থেকেও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আগামী কয়েকটি দিন আমাদের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং। এই সময়টা আমাদের ঘরে থাকতেই হবে। নিশ্চয়ই দিনের পর দিন ঘরে থাকা যায় না। এটাতে আমরা অভ্যস্ত নই।

কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে আমরা কোনো স্বাভাবিক সময়ে নেই। যাদের কাজ নেই, খাদ্য নেই, যারা বিপন্ন তাদের কথা ভাবতে হবে। তাদের খাবারের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। কিন্তু তারা ঘরের বাইরে গিয়ে অযথা ঘোরাঘুরি করে কাজ পাবেন না, উল্টো নিজের এবং আরও অনেকের জীবন অনিরাপদ করে তুলবেন।

এভাবে সব অবরুদ্ধ থাকলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়। বৈশ্বিক সমস্যা। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি যে মারাত্মক বিপর্যয়ে পড়বে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা নিয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর, সম্পদশালী রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ভাবতে হবে। উন্নয়নশীল অনুন্নত দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয় সেদিকে এখন থেকেই নজর রাখতে হবে। সবসময় মনে রাখতে হবে মানুষের জীবন আগে। অর্থনীতির সাময়িক ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে করোনাবিরোধী যুদ্ধে সামিল হতে হবে। কারণ মানুষের জন্যই অর্থনীতি, অর্থনীতির জন্য মানুষ নয়। অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেলে সবই ধসে পড়বে।

ইতোমধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ইতালির স্বাস্থ্যব্যবস্থা। প্রতিদিন হাজারে, লক্ষে করোনা রোগী আসতে শুরু করলে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোরই সেই চাপ সামলানোর মতো পরিকাঠামো নেই। সে সময়ে হার্ট অ্যাটাকের রোগীও প্রয়োজনে ভেন্টিলেটর পাননি। এ রকম অজস্র সমান্তরাল ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে।

করোনাবিরোধী যুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কেউ কেউ সরকারের উদ্যোগগুলো অপর্যাপ্ত মনে করেন। আবার সরকারি ঘোষণায় আস্থা-বিশ্বাসে ঘাটতি আছে। সরকার বলছে, সব প্রস্তুতি আছে। অন্যদিকে মানুষ মনে করছে, সরকার সময় পেয়েও রোগ শনাক্তকরণের পর্যাপ্ত কিট ব্যবস্থা করেনি। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করতেও অযথা কালক্ষেপণ করা হয়েছে। চিকিৎসকদের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা করা হয়নি। পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট বা পিপিই সংগ্রহ ও সরবরাহ বিলম্বিত হওয়ায় চিকিৎসকদের মধ্যেও ভীতি ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। কয়েকজন চিকিৎসকদের মৃত্যু এবং করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবরে স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসকদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়েছে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে এত সময় লাগলো কেন? যে ৫০০ চিকিৎসক সেবা দিতে প্রস্তুত আছে বলে বলা হচ্ছে, তারা কি এ ব্যাপারে বিশেষ প্রশিক্ষণ পেয়েছে?

সরকারকে তার অবস্থান পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করতে হবে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার ত্রুটি-দুর্বলতাগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় করতে হবে। সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য কথা এবং কাজে মিল রাখতে হবে। গরিব মানুষদের জন্য সাহায্য বণ্টনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। যাদের মানুষ সাধারণভাবে ‘চোর' বলে মনে করে তাদের বণ্টন-বিতরণ ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখতে হবে। প্রয়োজন হলে সৎ, উদ্যোগী, দেশপ্রেমিক মানুষদের সংগঠিত করতে হবে অথবা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিতে। পরস্পর দোষারোপের পথ পরিহার করে উদারতার পথে হাঁটতে হবে।

এটাও ঠিক যে, সব দায়িত্ব সরকারের নয়। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে সবাইকে বাঁচতে হবে। সংকীর্ণতা পরিহার করতে হবে অন্য দেশের অভিজ্ঞতা নিতে হবে। করোনার বিরুদ্ধে প্রণোদনা দিতে, মানুষকে সচেতন করতে, ঘরে থাকতে উদ্বুদ্ধ করতে অনেকেই আজ যুদ্ধে নেমেছেন, এগিয়ে আসছেন। বিল গেটস থেকে জ্যাক মা, মেসি রোনালদো থেকে মাশরাফি সাকিব আল হাসান এ গ্রহের তারকারা অনেকেই এ যুদ্ধে সামিল। এ যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে, নাহলে ধ্বংস না হলেও মানবসভ্যতাকে যে চড়া মূল্য দিতে হবে, জানি না আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে কত যুগ লাগবে।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/বিএ/জেআইএম