এম মাহফুজুর রহমান
Advertisement
করোনাভাইরাস প্রমাণ করেছে প্রকৃতির কাছে কতো অসহায় আমরা। বিশ্বময় মানুষের সব আত্মম্ভরিতা, আমিত্ব এবং হিংসা-বিদ্বেষ মুহূর্তে শেষ করে দিতে সক্ষম এই মহামারি ভাইরাস। জীবনঘাতী এই ভাইরাস চেনে না ধনী-গরিব। না চেনে প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি। জানে শুধু ছড়াতে। শুধু জানে ভয়াবহতা বাড়াতে। জানে মৃত্যুর মিছিলকে দীর্ঘ করতে। এ ভাইরাস জানাজা পড়াতে দেয় না। দেয় না সৎকার করতে।
রহস্যময় এই ভাইরাসের হদিস খুঁজে পাচ্ছেন না বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা। সুনির্দিষ্টভাবে এখনো জানা সম্ভব হয়নি কীভাবে এ ভাইরাস ছড়ালো। কীসের মাধ্যমে ছড়ালো। না আবিষ্কার হয়েছে এর ভ্যাকসিন। সবই ধোঁয়াশায় ঘেরা। সত্যিই অনিশ্চয়তার মধ্যে মনুষ্য জীবনের ভবিষ্যৎ। বিশ্বব্যাপী জীবন-জনপদ অচল-নিস্তব্ধ-ভঙ্গুর। অর্থনীতি টালমাটাল। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে চৌচির। ইউরোপ-আমেরিকার মতো স্বাস্থ্যসেবায় উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে পারছে না। সরকারগুলো এখন দিশেহারা। কী এমন এই ভাইরাস?
ছোটবেলায় মা-বাবার কাছে অনেক গল্প শুনেছি। কলেরা-ডায়রিয়া হয়ে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়েছে এককালে। সেকালে ওলাওঠার ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেত মানুষ। বড় হয়ে ইতিহাস আর উপন্যাসের পাতায়ও সেসবের টের পেয়েছি। আর এখন। এই অত্যাধুনিক সব মেডিক্যাল সাইন্সের যুগেও সজল চোখে দেখছি করোনার ভয়াবহ ছোবল। এ যেন যাকে পাচ্ছে তার ঘাড় মটকে দিচ্ছে। স্বজন দেখছে না স্বজনকে। কিংবা স্বজন স্বজনকে সমবেদনা দিতে যাওয়ায় তার ঘাড়ও মটকাচ্ছে প্রাণঘাতী করোনা। যেনো গোগ্রাসে গিলছে।
Advertisement
এই মুহুর্তে ইওরোপের কয়েকটি দেশের অবস্থা ভয়াবহ। সংক্রমণ ঠেকাতে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে দেশগুলো। কিন্তু তারপরও মৃত্যুর মিছিল থামানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন হাজারো মানুষ মারা যাচ্ছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তের বরাত দিয়ে একটি বার্তায় ফেসবুক ও টুইটারসহ সামাজিক মাধ্যমগুলো সয়লাব এখন। বলা হয়, টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারা গেছি। আর কী করতে হবে তা আমরা জানি না। পৃথিবীর সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গেছে। এখন একমাত্র সমাধান আকাশে।’ তাকে উদ্বৃত করা এই বক্তব্যের সত্যাসত্য প্রমাণ করা যায়নি। কারণ ইতালি কর্তৃপক্ষের কোনো অফিসিয়াল বক্তব্য পাওয়া যায়নি এ ব্যাপারে। তাই আমিও বলছি না এটা তিনি বলেছেন।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা বলা ছাড়া আর উপায়ই বা কী? যেখানে সব দেশই এই ভাইরাসটি নিয়ে রহস্যে নিমজ্জিত। কোনো সমাধান কেউ দিতে পারছে না অজানা এই রোগ সম্পর্কে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা চললেও কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখবে কেউ কিছু জানে না। বাজারে প্রচলিত কোনো ওষুধে থামছে না মৃত্যু।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, করোনাভাইরাস প্রাণী ও মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সংস্পর্শে ছড়াতে পারে। এটি সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা থেকে শুরু করে শ্বাসকষ্টজনিত জটিল রোগ মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (মার্স-কোভ) ও সিভিয়ার অ্যাক্যুট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (সার্স-কোভ)-এর কারণ হতে পারে।
জানা যায়, সার্স ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল সিভেট নামের একরকমের প্রাণী থেকে আর মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে। ২০০২ সালে প্রথম সার্স আক্রান্ত রোগী মিলেছিল চীনেই। সেসময় প্রায় ২৬টি দেশ আক্রান্ত হয়েছিল ফ্লু উপসর্গের এই রোগে। তবে নতুন করোনাভাইরাসটি চীন থেকে ছড়িয়েছে ধরা হয়ে থাকলেও এর উৎস কোথায় তা এখনো অন্ধকারেই রয়ে গেছে। অবশ্য পৃথিবীতে এর আগেও এর চেয়ে ভয়াবহ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিলো।
Advertisement
চতুর্দশ শতকে প্লেগের প্রাদুর্ভাবে ইউরেশিয়ার প্রায় সাড়ে সাত কোটি থেকে ২০ কোটি মানুষ মারা গেছেন। প্লেগকে সেসময় বলা হতো ‘ব্ল্যাক ডেথ’। ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এটি বিশ্বের ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী তিনটি রোগের একটি হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। ১৯১৮ সালে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে পরিচিত ইনফ্লুয়েঞ্জা ৫ কোটি মানুষকে আক্রমণ করে এবং মৃত্যু ঘটায় কোটি কোটি মানুষের।
করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস- যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। এর আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি। এটি এক ধরনের করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি মানব দেহে সংক্রমিত হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষে ইতোমধ্যেই ‘মিউটেট করছে’ অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে। যদি এই ধারণাই সত্যি হয় তাহলে সেটি হবে মানব সভ্যতা আর জীবনের জন্য মহাবিপর্যয়। এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়।
বিজ্ঞানীরা ষাটের দশকে প্রথমবারের মতো মানুষের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পান। সায়েন্সএলার্ট-এর তথ্য অনুযায়ী এই ভাইরাসের রয়েছে চারটি জেনাস- আলফাকরোনাভাইরাস, বেটাকরোনাভাইরাস, গামাকরোনাভাইরাস এবং ডেলটাকরোনাভাইরাস। প্রথমটি বাদুড়, শুকর, বিড়াল ও মানুষে সংক্রমণ ঘটায়। আর গামাকরোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয় পাখি ও পোলট্রি প্রজাতির প্রাণি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, মহামারি ঘোষণা করা এই করোনাভাইরাসটির উৎসও কোনো প্রাণী। ধারণা করা হয়, মানুষের আক্রান্ত হবার ঘটনাটি ঘটেছে চীনের উহান শহরের সামুদ্রিক মাছ পাইকারি বিক্রি হয় এমন একটি বাজার থেকে। আর এ কারণেই চীনাদের খাদ্যাভ্যাসকে দুষছেন অধিকাংশ মানুষ। সাম্প্রতিককালের এক অনলাইন জরিপে দেখা গেছে, ব্রিটেনের প্রায় অর্ধেক মানুষ মনে করেন, এই করোনাভাইরাস ছড়ানোর দায় নিতে হবে চীনকে। ইতোমধ্যে চীনা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলাও ঠুকে দেয়া হয়েছে।
দুনিয়ার সব বিখ্যাত ল্যাবে এই ভাইরাসের কাটা-ছেড়া চলছে এখন। আর এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মৃত্যু সংখ্যা সাড়ে ত্রিশ হাজার ছাড়িয়েছে। আক্রান্ত প্রায় সাত লাখ। দেখার বিষয় এই মৃত্যুর মিছিল কতো দ্রুত ছোট করা যায়। প্রশ্ন হলো, হোম কোয়ারেন্টাইনে মানুষ কতো দিন থাকতে পারবে? কতো দিন থাকা সম্ভব একে অপরের স্পর্শ ছাড়া? কতো দিন পর্যন্ত মানুষকে রাস্তাঘাটে বের হওয়া থেকে থামানো যাবে? কাজ-কর্ম বন্ধ রেখে কতো দিন অচল জীবন বহন করা যায়? অচলাবস্থার নিরসন কীভাবে? এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো বের হয়ে আসবে এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কারের মাধ্যমে। তবে ধারণা করা যাচ্ছে, শুধু প্রাণপাত করে নয় বরং বিশ্বের অনেক কিছুরই গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন করে দিলো এই ভাইরাস। ভাইরাসের থাবায় অর্থনৈতিক পরিবর্তনও অবশ্যম্ভাবী। তবে সবার আগে বাঁচুক প্রাণ। নাচুক ধমনী। আবারো প্রমাণিত হোক সৃষ্টির সেরা মানুষই। প্রকৃতি কেবল তার সহায়ক।
লেখক : সাংবাদিক
এইচএ/বিএ