ফিচার

জীবাণু রোধে কোন মাস্কটি কেন পরবেন

নাক ও মুখ ঢেকে রাখার এক বিশেষ আবরণী হলো মাস্ক। বাজারে বিভিন্ন ধরনের মাস্ক পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু মাস্ক হলো- এন৯৫ রেস্পিরেটর, সার্জিক্যাল ফেস মাস্ক, এফএফপি১, এফএফপি২, এফএফপি৩, অ্যাক্টিভেটেড কার্বন মাস্ক, পিএম২.৫, স্পঞ্জ মাস্ক, সাধারণ কাপড়ের মাস্ক, পেপার মাস্ক ইত্যাদি।

Advertisement

মাস্কের প্রধান কাজই হলো ধুলাবালি, ফুলের রেণু, ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি যেন আমাদের শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। তবে সব ধরনের মাস্কই সমানভাবে সব ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ধুলাবালি প্রভৃতি থেকে রক্ষা করতে পারে না। সবচেয়ে ভালো সুরক্ষা দেয় এন৯৫ রেস্পিরেটর মাস্ক। সব ধুলাবালি, ফুলের রেণু, ব্যাক্টেরিয়া থেকে এটি শতভাগ এবং ভাইরাস থেকে ৯৫ ভাগ সুরক্ষা দেয়।

অন্যদিকে সার্জিক্যাল ফেস মাস্ক প্রধানত মেডিক্যাল প্রয়োজনে এবং এফএফপি১ মাস্ক সাসপেন্ডেড পার্টিকেল আলাদা করে। এ দুই ধরনের মাস্কই ব্যাক্টেরিয়া, ধুলাবালি, ফুলের রেণু থেকে ৮০ ভাগ এবং ভাইরাস থেকে প্রায় ৯৫ ভাগ সুরক্ষা দিতে পারে। আবার অ্যাক্টিভেটেড কার্বন মাস্ক প্রধানত দুর্গন্ধ ফিল্টার করে, পাশাপাশি ব্যাক্টেরিয়া ও ফুলের রেণু থেকে প্রায় ৫০ ভাগ এবং ভাইরাস, ধুলাবালি থেকে ১০ ভাগ সুরক্ষা দেয়।

সাধারণ কাপড়ের মাস্কগুলো ভাইরাস ও ধুলাবালি থেকে কোনরকম সুরক্ষা না দিলেও ব্যাক্টেরিয়া ও ফুলের রেণু থেকে প্রায় ৫০ ভাগ সুরক্ষা দেয়। এগুলো সাধারণত ঠান্ডা পরিবেশ থেকে নাক-মুখকে সুরক্ষিত রেখে উষ্ণতা দেয়। আর স্পঞ্জ মাস্কগুলো প্রধানত ফ্যাশনে ব্যবহৃত হয়, যেটা ব্যাক্টেরিয়া ও ফুলের রেণু থেকে মাত্র ৫ ভাগ সুরক্ষা দিলেও কোনো ভাইরাস বা ধুলাবালি প্রতিরোধ করতে পারে না।

Advertisement

সম্প্রতি করোনা প্রাদুর্ভাবের জন্য বিভিন্ন মাস্কের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। কিন্তু সব মাস্ক করোনাভাইরাস প্রবেশ করা থেকে সুরক্ষিত করতে পারে না। এন৯৫ ৩এম রেস্পিরেটর ৯৫ ভাগ সুরক্ষা দিতে পারে এবং সার্জিক্যাল মাস্ক ও এফএফপি১ ৮০ ভাগ বাধা দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের তৈরি মাস্ক পরছেন। এগুলোর ভিত্তি কী?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। তারা কেবল এন৯৫ ৩এম মাস্ককে বিশেষভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবুও এর ৫ ভাগ ঝুঁকি আছে। আরও কিছু মাস্ক তাদের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অন্য সাধারণ মাস্কের তেমন বিজ্ঞানভিত্তিক রেফারেন্স নেই। এগুলো পরলেও যা, না পরলেও তা। একটি এন৯৫ বা সার্জিক্যাল মাস্ক একটানা অনেকক্ষণ ব্যবহার করাও অনুচিত। এ মাস্ক করোনা আক্রান্তর মনিটরিং সেলে প্রতিবার পরিদর্শনের পর পরিবর্তন করতে হবে।

এছাড়া করোনার লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে তার মাস্ক অকার্যকর হতে পারে। তখনো মাস্ক পরিবর্তন করে নতুন মাস্ক পরতে হবে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, একজন সুস্থ ব্যক্তি মাস্ক পরার পর নোংরা হলে যদি তা সুরক্ষিতভাবে পরিষ্কার করা যায়, তবে মাস্কের ফিল্টারটি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে একজনের ব্যবহার করা মাস্ক কখনোই অন্য জনের ব্যবহার করা উচিত নয়।

বাংলাদেশের মানুষের জন্য বাইরে বের হলে সব সময় মাস্ক পরা প্রয়োজন, কারণ-* করোনাভাইরাসের জন্য তো অবশ্যই পরতে হবে। তাছাড়া অন্য কারণেও পরিধান করা জরুরি। * যক্ষ্মা জাতীয় বিভিন্ন ড্রপলেট ও বায়ুবাহিত রোগ থেকে দূরে থাকতে মাস্ক প্রয়োজন।* আমাদের দেশের শহরাঞ্চলের বায়ুদূষণ মাত্রাতিরিক্ত, যা জনজীবন ও পরিবেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক! এ থেকে সুরক্ষা পেতে মাস্ক পরতে হবে!* বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাটে বা বাতাসে যে পরিমাণ ধুলাবালি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে, তার জন্য অ্যাজমা ও ফুসফুসের অন্য রোগ হতে পারে। এ থেকে রক্ষা পেতেও মাস্ক পরা আবশ্যক।

Advertisement

বর্তমানে একটি উদ্বেগজনক সত্য হচ্ছে, দেশে বর্তমানে প্রচলিত মাস্কগুলোর বেশিরভাগই চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দেশে মোট আমদানি করা ও উৎপাদিত মাস্কের সিংহভাগ হলো প্রচলিত নন-উভেন থার্মোপ্লাস্টিক শপিং ব্যাগের কাপড় দিয়ে। নন-উভেন থার্মোপ্লাস্টিক কাপড় হচ্ছে বর্তমান বাজারের সবচেয়ে সস্তা প্লাস্টিক। এ জাতীয় কাপড়কে বলা হয় পিপি-ফেব্রিক্স, অর্থাৎ এটি প্রোপিলিনের পলিমার দিয়ে তৈরি। ফলে নন-উভেন কাপড় তৈরিতে কোনো সুতা ব্যবহার করা হয় না; এটি সরাসরি তাপ-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয়।

এ জাতীয় কাপড়ের তৈরি মাস্কে সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে কাপড়টির উভয় পাশে (ওপরে ও নিচে) প্রচুর পরিমাণ আলগা তন্তু (আঁশ) থাকে; এই আলগা তন্তুগুলোকে বলা হয় মাইক্রো-প্লাস্টিক। এ ধরনের কাপড়ে তৈরি একটি মাস্ক মাত্র কয়েক মিনিট নাকেমুখে রাখা মানে অসংখ্য মাইক্রো-প্লাস্টিক ফুসফুসে পুরে নেওয়া। অতিক্ষুদ্র এসব পার্টিক্যালের কিছু ফুসফুসের অত্যন্ত গভীরের কোষকলায় আটকে যেতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। সবচেয়ে ছোট কিছু উপাদান সরাসরি রক্তনালিতে চলে যেতে পারে, যা পরিণতিতে স্নায়ুরোগ, ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ অন্যান্য রোগের অতি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। মানব শরীরে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই, যার মাধ্যমে শরীর এসব উপাদান বের করে দিতে পারে অথবা নিঃশেষ করে দিতে পারে। ফলে এ জাতীয় মাস্ক পরিহার ও বর্জন করাই শ্রেয়।

মাস্ক যদি শপিং ব্যাগের কাপড়ের বদলে ভালো মানের নন-উভেন কাপড়েও বানানো হয়, তবুও তা দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার করা অনুচিত। প্লাস্টিক নিজে মানবস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর আর প্লাস্টিক প্রসেসিংয়ে যুক্ত থাকা অন্যান্য রাসায়নিক, যেমন- থ্যালেট, বিপিএ সমমাত্রায় ক্ষতিকর। সরাসরি নাকে সংযুক্ত থাকায় এ জাতীয় কাপড়ে তৈরি মাস্ক থেকে উচ্চমাত্রায় থ্যালেট, লিড, মারকারি, ক্যাডমিয়ামের মতো ভারি ধাতব এবং বিপিএ উপাদান মানব শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এসব রাসায়নিক উপাদান মানব শরীরে ক্যান্সার, জন্মগত ত্রুটি, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, লিভার ও চর্মরোগ, স্থূলতা, শ্বসনতন্ত্রের রোগ, হরমোনের তারতম্য, স্তন ক্যান্সার, হাঁপানি, নারী-পুরুষের উর্বরতা হ্রাস, পুরুষের যৌনাকাঙ্ক্ষা হ্রাস, শুক্রাণুর মান ও সংখ্যা হ্রাসসহ বহুবিধ রোগের সঙ্গে যুক্ত।

নিতান্ত প্রয়োজনে তাই উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন স্থানে পিপি মাস্ক অল্প সময়ের জন্য পরিধান করা যেতে পারে। তিন স্তরের সার্জিক্যাল মাস্ক ভালো বিকল্প হতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো- থার্মোপ্লাস্টিক এসব মাস্কে প্রতারক মাস্ক ব্যবসায়ীরা কোনো এয়ার ফিল্টার বা বায়ু ছাঁকনি ব্যবহার না করেও শুধু একটি প্লাস্টিক চাকতি দিয়ে জনসাধারণকে প্রতারিত করে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছে। কিছু অতিচালাক ব্যবসায়ী ফিল্টার চাকতির নিচে বসিয়ে দিয়েছে লাল-নীল নমনীয় প্লাস্টিক, যাতে সাধারণ কেউ তাদের এ প্রতারণা ধরতে না পারে।

এ ক্ষেত্রে হয় প্লাস্টিক চাকতিটি শুধু দু’পাশ থেকে চাপ দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া (মাঝখানে কোনো ফিল্টার উপাদান নেই), না হয় মাস্কটির নির্দিষ্ট জায়গাটি কেটে তাতে ফিল্টার কাপড় বা উপাদান না বসিয়ে মাঝখানে একটি নমনীয় প্লাস্টিক বসিয়ে দুই পাশ থেকে আটকে দিয়েছে। সত্যিকারের ফিল্টার না থাকার কারণে শ্বাস নেওয়ার সময় ফুসফুসের নেগেটিভ প্রেসারে তুলনামূলক অতিমাত্রায় মাইক্রো-প্লাস্টিক ব্যবহারকারীদের ফুসফুসে ঢুকে পড়ছে।

সাধারণ অর্থে পিপি কাপড় কিন্তু ধোয়ার যোগ্য নয়, অজ্ঞতাবশত অনেকে এটি ধুয়ে আবার ব্যবহার করছেন; ধোয়ার ফলে আরও উচ্চমাত্রায় আলগা সুতা, থ্যালেট ও বিপিএ উপাদান মানব শরীরে প্রবেশ করছে। করোনার ঝুঁকি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে জাতিগতভাবে আমরা হয়তো ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে চলে যাচ্ছি। তাই নিরাপদ ও ‘হু’ অনুমোদিত মাস্ক ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।

এসইউ/জেআইএম