সকালে আধাপেট খেয়ে কাজের সন্ধানে ভ্যান নিয়ে বেরিয়েছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সেলিম মিয়া। খাওয়ার সময় স্ত্রী বলেছেন- দুপুরে চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যেতে। না নিলে চুলো জ্বলবে না।
Advertisement
ইদানিং বাজারের সব দোকানপাট বন্ধ থাকে। নেই জনসমাগম। করোনার ভয়ে কেউ জিনিসপত্র পরিবহন করছে না। এখন রোজগারও নেই আগের মতো। তাই সাত সকালেই কপালে দুঃচিন্তার ভাজ ভ্যানচালক সেলিম মিয়ার। তবু কিছু একটাতো করতেই হবে! চুলো না জ্বললে পরিবারের চার সদস্যের পেটে পড়বে না কিছুই। এ কারণে সকালে ভ্যান নিয়ে বরগুনা বাজারে আসেন তিনি।
এরপর সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। তবু সেলিম মিয়ার উপার্জন নেই একটি টাকাও। এতে দুশ্চিন্তায় কপালের ভাজ বাড়তে থাকে আরও। ক্ষুধা আর অলস সময় কাটানোয় ক্লান্তি চেপে ধরে তাকে। এরপর দুপুরের তপ্ত রোদে ক্লান্ত শরীরে ভ্যানের উপরেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন, তা বলতে পারেন না ভ্যানচালক সেলিম। নির্জন রাস্তায় হঠাৎ তার ঘুম ভাঙে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহর ডাকে। এরপর ডিসি মোস্তাইন বিল্লাহ ভ্যানচালক সেলিম মিয়ার অসহায়ত্বের কথা জানতে পেরেই খাদ্যদ্রব্যের একটি প্যাকেট তুলে দেন তার হাতে।
Advertisement
১০ কেজি চাল আর আলু ডালসহ বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভর্তি ওই প্যাকেটটি পেয়ে হতভম্ভ সেলিম মিয়া। ভেবেছিলেন হয়তো ঘুমের ঘোরে স্বপ্নই দেখছেন তিনি। এরপর আপ্লুত হন তিনি। মেঘ না চাইতেই জল! জেলা প্রশাসকের দেয়া প্যাকেটি আগলে ধরে কেঁদে ফেলেন দরিদ্র সেলিম মিয়া। ততক্ষণে ব্যস্ত ডিসি উপার্জনহীন অন্য ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে ওই স্থান ত্যাগ করেন।
এ বিষয়ে সেলিম মিয়া বলেন, ডিসি সাহেবের থেকে প্যাকেটটি নেয়ার পরপরই আমার চোখে ভাসছে অনাহারে থাকা স্ত্রী-সন্তানদের কথা ভেবে। দু’চারদিন হয়তো ভালোই চলে যাবে এই সহায়তায়। কিন্তু তারপর? হে আল্লাহ আমাদের রহম কর। এভাবেই সংকটের এই সময়ে দুশ্চিন্তার কথা জানালেন সেলিম মিয়া’।
শুধু সেলিম মিয়া নয়, দুপুরের তপ্ত রোদে ঘুরে ঘুরে সেলিম মিয়ার মতো অসহায় উপার্জনহীন অর্ধশতাধিক পুরুষ ও নারীকে খাদ্যদ্রব্য সহায়তা দিয়েছেন বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ। আকস্মিক এমন সহায়তা পেয়ে আপ্লুত হয়েছেন অনেকেই।
ডিসির কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার পর ভ্রাম্যমাণ পান বিক্রেতা বজলু গাজী (৬০) বলেন, ‘করোনার ভয়ে আমার পান বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। সারাদিন বাজারে ঘুরি বলে আমার কাছ থেকে পান কেউ কেনে না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৫০ টাকাও বিক্রি করতে পারিনি। বাড়িতে বাজার সদায় নেই। স্যারে আমার জন্য এভাবে খাবার নিয়ে আসবেন, তা আমি কল্পনাও করিনি। তার দেয়া খাবার না পেলে আমাদের আজ না খেয়ে থাকতে হতো’।
Advertisement
এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বরগুনার একজন হতদরিদ্রও যাতে অভুক্ত না থাকে, সেজন্য আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। আমদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা খুঁজে খুঁজে অসহায় ও হতদরিদ্রদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সহায়তা আমরা তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি এবং সচেতন করার পাশাপাশি আশ্বস্ত করছি।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা আর প্রশাসনের কড়াকড়িতে একপ্রকার অঘোষিত লকডাউনে বরগুনা। আর এতে সব থেকে অসহায় হতদরিদ্ররা। তাই জেলার সব হতদরিদ্রদের তালিকা তৈরি করেছে বরগুনা জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন। এরপর তালিকা অনুযায়ী দেয়া হচ্ছে সহায়তা। এই তালিকার বাইরে থাকা অসহায় বেঁদে জনগোষ্ঠীকেও দেয়া হচ্ছে এই সরকারি সহায়তা। এ ছাড়াও জেলার ৪০ হাজার জেলেকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে করোনার এই দুর্যোগকালীন সরকারি সহায়তায়।
বরগুনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জেলার ছয়টি উপজেলার তালিকাভুক্ত মোট ৮শ ৯৯ জনের মাঝে প্রায় ১০ মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি নগদ অর্থ প্রদান করা হয়েছে তিন লাখ টাকা। এছাড়াও খাদ্য সহায়তা ও অর্থ সহায়তার জন্য পর্যাপ্ত মজুদ আছে বলে জানা গেছে। করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষতে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মটিটরিং করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রভাবে উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়া হতদরিদ্রদের মাঝে আমরা সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছি। প্রতিটি ইউনিয়নে গিয়ে আমরা অসহায়দের হাতে সহায়তা তুলে দিচ্ছি। আমাদের এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে হত দরিদ্রদের চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। খাদ্যদ্রব্যসহ নগদ অর্থের আমাদের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
এমআরএম