ধর্ম

লকডাউন আইসোলেশন কোয়ারেন্টাইন নিয়ে ইসলামের দিকনির্দেশনা

লকডাউন আইসোলেশন কোয়ারেন্টাইন নিয়ে ইসলামের দিকনির্দেশনা

প্রাণঘাতী মহামারি করোনাভাইরাস ব্যাধিতে পুড়ছে সারাবিশ্ব। ২৭ হাজার ৩৭১ জন মানুষ মারা যাওয়ার এ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনার প্রভাব কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৬০৭ জন ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৭৭ জন ইতিমধ্যে সুস্থ হয়েছেন।

Advertisement

মহামারি কোভিড-১৯ এর তাণ্ডবে বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে চলছে লকডাউন। অনেকেই মেনে চলছে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি। যাতে প্রাণঘাতী এ ব্যাধিতে নতুন করে আর কেউ আক্রান্ত না হয়। কিন্তু মহামারিতে গ্রহণ করা পদ্ধতি লকডাউন, আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টাইন সম্পর্কে ইসলামের দিকনির্দেশনা কী?

লকডাউন, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইনকে অনেকেই আল্লাহর ভয় ও ভরসার প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের আলোকে এগুলোকে আল্লাহর সঙ্গে প্রতিবন্ধকতার হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

কেননা আল্লাহ তাআলার হুকুম ও ইচ্ছা ছাড়া যেমন কিছু হয় না। আবার প্রতিটি ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সুন্দর ব্যবস্থাপনা মেনে নিজেদের পরিচালিত হওয়াও জরুরি। কেননা আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির মধ্যে সবকিছুই সুন্দর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে পরিচালিত।

Advertisement

তাই সে কারণেই মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস রেখে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মেনে অসুস্থতায় চিকিৎসা গ্রহণের ওপর আমল করে লকডাউন, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতিগুলোর অনুসরণ করা খুবই জরুরি।

এ গুলো পালনে ইসলামি শরিয়তে কোনো বিধি-নিষেধ নেই। কেননা আল্লাহ তাআলা মানুষকে রোগের প্রতিকার গ্রহণের নির্দেশমূলক আয়াত নাজিল করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আপনার পালনকর্তা মৌমাছিকে আদেশ দিলেন পাহাড়, গাছ ও উঁচু চালে আবাসস্থল তৈরি কর, তারপর সব ধরনের ফল থেকে খাও আর আপন পালনকর্তার উম্মুক্ত পথসমূহে চলাচল কর। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নাহল : আয়াত ৬৮-৬৯)

কুরআনুল কারিমের এ আয়াতেই মানুষকে রোগের প্রতিকারের ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছে। সুতরাং রোগ প্রতিরোধে পদ্ধতি গ্রহণ তথা লকডাউন, আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি গ্রহণ করা কোনোভাবেই নিষেধ নয়। বরং হাদিসের নির্দেশনায় তা সতর্কতামূলকভাবে পালন করা ইসলামের নির্দেশনাও বটে।

তাহলে জেনে নেয়া যাক এ পদ্ধতিগুলোর অর্থ কী এবং এ সম্পর্কে ইসলাম কী বলে->> আইসোলেশন পদ্ধতিকরো সংস্পর্শে না যাওয়াই হলো আইসোলেশন। অর্থাৎ বিদেশ থেকে এসেছে কিংবা বাড়ি বা ঘরের বাইরে এমন কোনো স্থান থেকে আসা ব্যক্তি যে, সে যেখান থেকে এসেছে সেখানে এ ভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে। তাই পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে আলাদা কোনো ঘরে অবস্থান করাই হলো আইসোলেশন পদ্ধতি। আর এটি পালনে ইসলামের কোনো বিধি-নিষেধ নেই। কেননা এতে নিজে যেমন নিরাপদ থাকা যায় তেমনি পরিবারের অন্যরাও নিরাপদ থাকতে পারে। সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এ ধরনের কাজের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

Advertisement

হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু খেলাফতের সময় ফিলিস্তিনে ‘আমওয়াস’ নামক মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে মিসর বিজেতা সাহাবি হজরত আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু সেখানে উপস্থিত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেন-‘যখন এ ধরনের মহামারি দেখা দেয় তখন তা আগুনের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি (উপস্থিত) সবাইকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে পাহাড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাদের প্রতি এ মর্মে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেন যে- কেউ কারো সঙ্গে মিশতে পারবে না। অতপর তারা পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে দীর্ঘ দিন পাহাড়ে অবস্থান করেন। আর আক্রান্তদের অনেকে শাহাদাত বরন করেন। একপর্যায়ে আল্লাহ তাআলা মহামারি তুলে নিলে সাহাবি আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু জীবিতদের নিয়ে সুস্থ শরীরে শহরে ফিরে আসেন।’ (তারিখে দিমাশক)

>> লকডাউন পদ্ধতিএ শব্দটি কোনো ব্যক্তিগত নির্দেশনা নয় বরং কোনো দেশের সরকারি সিদ্ধান্ত। ব্যক্তিগত বা স্বাস্থ্য বিভাগ চাইলেই এ নির্দেশনা জারি করতে পারে না। এ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায়- সড়ক, নৌ, রেল, আকাশ ও পায়ে হেঁটে চলাচল বন্ধ থাকা। অর্থাৎ যে শহর লকডাউন, সে শহরের সঙ্গে সীমানা প্রাচীর থেকে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ পরিপূর্ণ বন্ধ থাকা।

লকডাউন পরিস্থিতি সম্পর্কেও হাদিসের একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে-হজরত ওমর ও হজরত আবু উবায়দাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদিস শোনালেন। আর তাহলো-‘তোমরা যখন কোনো এলাকায় মহামারি প্লেগের বিস্তারের কথা শুনো, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোনো এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়েও যেও না।’ (বুখারি)

আবার মহামারি আক্রান্ত অঞ্চলে প্রবেশ করতে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন এবং নিজ এলাকায় মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে মৃত্যুর ভয়ে এলাকা ছেড়ে পলায়ন করতেও নিষেধ করেছেন। হাদিসে এসেছে-‘মহামারি হচ্ছে একটি আজাবের নিদর্শন। আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। সুতরাং তোমরা যদি কোথাও মহামারির সংবাদ শোনো তাহলে কিছুতেই সেখানে যাবে না। আর যদি তোমাদের বসবাসের শহরে মহামারি দেখা দেয় তাহলে সেখান থেকে পলায়ন করবে না।’ (মুসলিম)এ হাদিসের আলোকেই ‘আউনুল মাবুদ’ গ্রন্থের লেখক বলেন, ‘মহামারি আক্রান্ত অঞ্চলে প্রবেশ এবং তা থেকে পলায়ন উভয়টাই শরিয়তে হারাম।’ কারণ হলো-‘মহামারি আক্রান্ত অঞ্চলে প্রবেশ করার দ্বারা আল্লাহ তাআলার ক্ষমতার সামনে নিজের সাহসিকতা প্রদর্শনী বুঝা যায়। আবার আক্রান্ত এলাকা থেকে পলায়ন করার অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহর হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা যা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।’

আল্লাহ তাআলা মৃত্যু সম্পর্কে কুরআনে উল্লেখ করেছেন-‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও। বস্তুত তাদের কোনো কল্যাণ সাধিত হলে তারা বলে যে, এটা সাধিত হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যদি তাদের কোনো অকল্যাণ হয়, তবে বলে, এটা হয়েছে তোমার পক্ষ থেকে, বলে দাও, এসবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। পক্ষান্তরে তাদের পরিণতি কি হবে, যারা কখনও কোনো কথা বুঝতে চেষ্টা করে না।’ (সুরা নিসা : আয়াত ৭৮)

>> কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতিকোয়ারেন্টাইন বা হোম কোয়ারেন্টাই বা স্বেচ্ছায় ঘরে আবদ্ধ থাকা। নির্দিষ্ট সময় বাইরে না যাওয়া। মহামারি কবলিত অঞ্চলের মানুষের জন্য বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশনায়ও এ রকম ইঙ্গিত পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে-হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মহামারি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘মহামারি হলো আল্লাহ প্রদত্ত একটি আজাব। যাদের উপর আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা হয় এ আজাব পাঠান। পরবর্তীতে তিনি তা ঈমানদারদের জন্য নিজ অনুগ্রহে রহমতে রূপান্তর করেন এভাবে যে- ‘কোনো ব্যক্তি যদি মহামারি আক্রান্ত এলাকায় থাকে এবং নিজ বাড়িতে ধৈর্য সহকারে সাওয়াবের নিয়তে এ বিশ্বাস নিয়ে অবস্থান করে যে, আল্লাহ তাআলা ভাগ্যে যা রেখেছেন তার বাইরে মহামারি তার কিছু করতে পারবে না তাহলে তার জন্য রয়েছে একজন শহিদের সাওয়াব।’ (মুসনাদে আহমাদ)

হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, মহামারির মধ্যে বাড়িতে অবস্থান করলে আর তাতে মারা গেলে শহিদের মর্যাদা লাভ করবে মুমিন। তবে এর মধ্যে ৩টি শর্ত থাকতে হবে।- সবর তথা ধৈর্যের সাথে অবস্থান।- পরকালের সাওয়াবের আশা থাকা।- আল্লাহ তাআলা কর্তৃক ভাগ্যে যা লেখা রয়েছে তা ব্যতিত কোনো ক্ষতি হবে মর্মে বিশ্বাস থাকা।

সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো ব্যক্তির আইসোলেশন, লকডাউন কিংবা কোয়ারেন্টাইনে অবস্থান কোনোটিই ইসলামের আলোকে নিষেধ নয় বরং মহামারি আক্রান্ত অঞ্চলের লোকদের জন্য ইসলাম উল্লেখিত সবগুলো পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে গ্রহণ করার দিকনির্দেশনা দেয়। আর তাতে ইসলামি শরিয়তেরও লঙ্ঘন হবে না।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৮-এ। আর তাতে মারা গেছে ৫ জন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৫ জন।

আল্লাহ তাআলা মসলিম উম্মাহসহ সারা দেশের সব মানুষকে মহামারির এ প্রাদুর্ভাবের সময় সরকার ঘোষিত দিকনির্দেশনা মেনে চলার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন এবং লকডাউন-এর নির্দেশনা আসলে তা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর কাছে করোনা মুক্তিতে ধৈর্যের সঙ্গে বেশি বেশি তাওবা-ইসতেগফার করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এমকেএইচ