মতামত

করোনা অতঃপর মানুষ

বিশ্ব আজ একই স্রোতে অবস্থিত। নেই কোনো প্রতিকূলতা নেই। শুধুই অনুকূল। দৃষ্টিগুলো যেন একই রকম। অধীর আগ্রহের দৃষ্টি। প্রত্যাশার দৃষ্টি। আবেগে নিংড়ানো ভালোবাসার দৃষ্টি। অশ্রুসিক্ত হৃদয় ভাঙানো দৃষ্টি। ও হে মানুষ। এটা অসহায়ত্ব না ভালোবাসার ইঙ্গিত? হারানোর বেদনাটা এ রকমই। মানবকুল আজ আক্রান্ত করোনাভাইরাসে। রক্তের সম্পর্কগুলো যেন আবার জানিয়ে দিল, ওগো মানুষ করিও হুশ। রক্তের সম্পর্কগুলো কখনও কি অস্বীকার করার বিষয়? কখনও কি অস্বীকার হয়েছে? হয়তোবা হয়েছে? মৌখিক। কিন্তু তা কখনও স্থায়ী হয়নি। রক্ত সে তো রক্তই। সে কখনও কোনো জাত-পাতের বাছ-বিচার করে না। তার রঙটা একই রকম। সে বারবার পরীক্ষা দিয়েও একই থেকেছে। রক্ত তার অবস্থান কখনও পরিবর্তন করেনি।

Advertisement

এই যে দেখুন না! মানবজাতি কতই না হুর হাঙ্গামা, ঝুট ঝামেলা, মারামারি, কাটাকাটি, জাতিগত ভেদাভেদ, ধর্মে ধর্মে দ্বন্দ্ব, মানুষে মানুষে খুনাখুনি, গালাগালিতে ব্যস্ত। কিন্তু কখনও কি মানুষ নামের মানবজাতিকে আলাদা করা গেছে? সকলের সৃষ্টির উৎস তো ওই একজনই। কেউ ডাকে আল্লাহ, কেউ ভগবান, কেউ ঈশ্বর, কেউ প্রভু, কেউ সৃষ্টিকর্তা, কেউ বা অবিনশ্বর। এই তো। কেউ কি কখনও সৃষ্টির স্রষ্টাকে অস্বীকার করেছে? অস্বীকার হয়েছে? হয়নি।

কিন্তু এই মানুষই বিভিন্ন সময়ে স্বার্থের জন্য জাতিগত দ্বন্দ্ব, দেশে-দেশে দ্বন্দ্ব, ধর্মে-ধর্মে দ্বন্দ্ব, গায়ের রং বেরং এ দ্বন্দ্ব, সাদা-কালো দ্বন্দ্ব, উঁচু-নিচু দ্বন্দ্ব, ধনী-গরিব দ্বন্দ্ব, পেশাজীবী-অপেশাজীবী দ্বন্দ্ব। কতই না দ্বন্দ্ব! কতই না অস্ত্রের ঝনঝনানি? কিন্তু কোনো দ্বন্দ্বই কখনও মানুষে মানুষের পরিচয়কে অস্বীকার করতে পারেনি। যখনই কোনো দুর্যোগ এসেছে, যখনই কোনো মহামারি হয়েছে, যখনই কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় এসেছে মানবসৃষ্টির সেরা জীবের ওপর তখনই মানুষ মানুষ কেমন করে যেন এক হয়ে গেছে। এটাই তো ধর্ম। এটাই তো বর্ণ। এটাই তো মানুষের অস্তিত্ব। এটাই তো মানবজাতি। এর আবার ভেদাভেদ কিসের?

এই যে দেখুন, চীনের উহান শহরে দেখা দিল করোনাভাইরাস। কিন্তু সেই ভাইরাস তো সেখানেই থাকার কথা ছিল? সেখানেই অবস্থান করার কথা ছিল? যা ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সেখানেই তো হওয়ার কথা ছিল? কিন্তু সেই করোনাভাইরাস গোটা মানবজাতির মধ্যে আজ বিস্তার ঘটেছে। সুদূর চীনের উহানে উৎপত্তি হওয়া করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বকে আজ গ্রাস করেছে। মানবজাতিকে গ্রাস করেছে। মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অসহায় হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। এটা কি হওয়ার কথা ছিল? হায়!!! আবার খেয়াল করুন, এই ভাইরাস মোকাবিলায় সারাবিশ্ব আজ চিন্তিত। বিশ্বের প্রতিটি মানুষ চিন্তিত, উদ্বিগ্ন, ভাবান্নিত। কীভাবে এই ভাইরাসকে মোকাবিলা করা যায়? কীভাবে এই ভাইরাসের হাত থেকে মানবজাতিকে, মানুষকে রক্ষা করা যায়।

Advertisement

দেখুন আজ দেশে দেশে কোনো বিভ্রান্তি নেই, কেনো ঝগড়াঝাঁটি নেই, কোনো হিংসা-বিদ্বেষের বক্তব্য নেই। সবাই যেন একে কাতারে এসে দাঁড়িয়ে বলছে এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হবে। কে মুসলমান, কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান, কে কোন জাতের তা মুখ্য বিষয় নয়? মুখ্য বিষয় মানুষের সেবা দিতে হবে। সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে। গবেষণার ওপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধুই বাঁচার আশা। কে কোথায় বসবাস করবে, কে কোথায় থাকবে সেটা যেন মাথায় নেই। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ, প্রতিটি মানুষ আজ ব্যস্ত সময় পার করছে। অন্য কোনো ব্যস্ততা নেই। ব্যস্ততা শুধু একটাই। কীভাবে এই রোগের চিকিৎসা দেয়া যায়, কীভাবে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়?

বিশ্বের বড় বড় বিজ্ঞানী বড় বড় চিকিৎসক, বড় বড় সেবা কোম্পানির কর্তারা গবেষণায় ব্যস্ত। কেউ বা রোগী, চিকিৎসকের পোশাক-আশাক তৈরিতে ব্যস্ত। সবাই আজ মানবজাতির সেবায় নিয়োজিত। হিন্দু-মুসললিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক কাতারে মিলিত হয়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ব্যস্ত। দেখুন তো! মানুষ মানুষের কত মিল? সবাই সবার বিপদে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সবাই সবার সেবায় ব্যস্ত। সবাই সবার পরিচর্যায় দিনরাত পরিশ্রমে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। কেউবা খাদ্যদ্রব্য দিচ্ছে, কেউবা চিকিৎসা দিচ্ছে, কেউবা ওষুধ দিচ্ছে, কেউবা আল্লাহর কাছে দোয়া-দরুদে ব্যস্ত, কেউ বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনায় ব্যস্ত, কেউ বা গির্জায়, কেউ ভগবানের কাছে প্রার্থনায় ব্যস্ত, কেউ প্রভুর কাছে।

দেখুন তো কত মিল। এটাই তো মানবজাতি। এটাই তো মানুষ। এই মানুষের কারণেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন। নেই কোনো দ্বন্দ্ব, নেই কোনো হিংসা....। নেই কোনো যুদ্ধ জয়-পরাজয়ের গল্প। মানুষ মানুষের জন্য। সবাই আজ শান্তির খোঁজে। মানুষ আজ মানুষের খোঁজে। এটাই তো আমাদের কাম্য। কথা ছিল এখানে থাকবে না কোনো সাম্প্রদায়িকতা, থাকবে না কোনো হিংসা, সমস্ত পৃথিবী হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার। সমস্ত পৃথিবীর পরিচয় হবে মানবজাতির আবাসস্থল মানুষ। বিশ্ব আজ মৃত্যুর মিছিল আর লাশের মিছিলে। কেউ বলছে না অমুক দেশের লাশ, তমুক দেশের লাশ। সবাই বলছে মানুষের মরদেহ। সমস্ত কিছুই আজ থমকে দাঁড়িয়েছে। মানবতা আজ বিশ্ববাসীকে জানাচ্ছে মানুষের গুরুত্ব। কৃত্রিমতা আজ কতই অসহায়। মানবকূলের পরিচয় আজ মানুষ।

ইতালির প্রধানমন্ত্রী কন্টির বক্তব্য, "আমরা মহামারির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি। আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারা গেছি, আর কী করতে হবে তা আমরা জানিও না, পৃথিবীর সমস্ত সমাধান শেষ হয়ে গেছে, আকাশই একমাত্র সমাধান।" এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়েই বাঙালিরা পথ চলা শুরু করেছিল ৭১ এ। আর সেই শিক্ষা যে আজও আমাদের চেতনাকে উজ্জীবিত করে রেখেছে তা সুনিশ্চিত।

Advertisement

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের বিশাল সমাবেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের কিছু অংশ দিয়ে শেষ করছি, "আমি বৈদেশিক নীতি সম্মন্ধে একটা কথা বলতে চাই। আমার দলের নীতি হলো, সকলের ওপর বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে আমাদের শত্রু না। আমরা পাড়াপড়শির সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করতে চাই। আমরা কো-একজিস্টেন্সে বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বশান্তিতে বিশ্বাস করি। আমি বিশ্ব দুনিয়ার বড় বড় শক্তিকে অনুরোধ করবো যে টাকা, যে অর্থ, যে সম্পদ আপনারা অস্ত্রের জন্য ব্যয় করেন এবং সেই টাকায় আর্মামেন্ট যাকে বলা হয় তা যদি আপনারা বন্ধ করে এই অর্থের দশ ভাগো বিশ্ব দুনিয়ার গরিব মানুষের জন্য ব্যয় করতেন এ দেশে, এ দুনিয়ায় গরিব মানুষ থাকতো না। তাতে আপনাদের ইজ্জত বাড়তো। আমি আপনাদের কাছে আবেদন জানাবো, অস্ত্র তৈরি করা বন্ধ করেন। মানুষ মারার কল তৈরি করা বন্ধ করেন এবং সেই অর্থ দিয়ে যেখানে কোটি কোটি মানুষ আইজ না খাওয়া- যেখানে কোটি কোটি মানুষ আইজ কাপড় পরে না- যেখানে কোটি কোটি মানুষ আইজ বাড়ি নাই- যেখানে কোটি কোটি মানুষ আইজ অশিক্ষিত- তাদের জন্য ব্যয় করেন- আপনাদের সন্মান দুনিয়ায় বাড়বে- মানুষ আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। অস্ত্র দিয়ে জয় লাভ করতে পারলে আপনারা দুনিয়ায় অনেকদিন জয় লাভ করতে পারতেন। আইজ অস্ত্রের দিন ফুরিয়ে গেছে। আইজ ভালোবাসা, মহব্বত মানুষের খেদমতের দিন এসে গেছে। সেইদিকে আপনারা নজর রাখবেন আমি অনুরোধ করবো।"

করোনা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে দিন শেষে মানুষ একই। নদী, সাগর, আকাশ বাতাস, চন্দ্র, সূর্য,আলো,অন্ধকারে অবস্থানরত দেশগুলোর নাম আলাদা হলেও বসবাসরত জীবগুলোর পরিচয় মানুষ। ক্ষমতার মোহে নয় মানবতার মোহেই হোক মানবিক বিশ্বের পরিচয়। সচেতন হই মানুষের পাশে দাঁড়াই, করোনাভাইরাস থেকে আল্লাহ পাক সবাইকে রক্ষা করুক এই কামনা।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক গণিত বিভাগ, সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও পরিচালক, বঙ্গবন্ধু চর্চাকেন্দ্র বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগ।

এইচআর/বিএ/এমএস