জাতীয়

নজিরবিহীন নিঃসঙ্গতায় সংসদ, চারদিকে শুধু কাকের ডাক

অধিবেশনের সময় জাতীয় সংসদ থাকে কোলাহল ও উৎসবমুখর। এ সময় ব্যস্ততা দ্বিগুণ হয় সংশ্লিষ্টদের। সেই ব্যস্ততা চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

Advertisement

সংসদ সদস্য ছাড়াও তাদের নিজ নিজ এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর থাকে। দামি দামি দৃষ্টিনন্দন গাড়িতে ভরে যায় গ্যারেজ। এমনকি গ্যারেজে ঠাঁই না পেয়ে বাইরের রাস্তায় সারি সারি লাল, কালো, সাদা রঙের মার্সিডিস, ল্যান্ডরোভার, পার্সে গাড়িতে ভরে যায়। শুধু অধিবেশনের সময় নয়, অন্যান্য সময়ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও বিদেশ থেকেও অনেক লোক আসেন সংসদ ভবন দেখতে। কিন্তু সংসদের বিশেষ অধিবেশন বাতিল, এখন যেন কোথাও কেউ নেই।

আজ বুধবার। সংসদে ভবনের দক্ষিণে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের ব্যস্ত রাস্তায় যেন ঘুঘু চরছে। সেখানকার সংসদের গেটে ছোট্ট একটি গাছের ছায়ায় উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন পুলিশ কনস্টেবল। তাদের দৃষ্টি দূরে কোথাও। হয়তো গ্রামে থাকা প্রিয়জনদের জন্য উদ্বেগ। তারই একটু দূরে কাচঘেরা ঘরে পুলিশের আরও কয়েকজন।

সংসদে প্রবেশের সময় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন এগিয়ে এসে বাইক থামান। তথ্য অধিদফতর থেকে দেয়া অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখানোর পরও আটকে দেয়া হয়। সংসদে এ সময় প্রবেশ নিষিদ্ধ বলেও জানানো হয়। এরপর সংসদের সার্জেট অ্যাট আর্মসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মেলে।

Advertisement

এ সময় ডেপুটি সার্জেন্ট অ্যাড আর্মস (অপারেশন) এ এম সিরাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে সংসদের নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া অন্যদের প্রবেশের ওপর কড়াকাড়ি আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে দর্শনার্থী ঢোকা নিষেধ। ঢুকতে পারছেন না গণপূর্তের কাজে নিয়োজিত লোকজনও। তবে সাংবাদিকদের প্রবেশের ওপর কোনো কড়াকড়ি নেই।’

ভবনের দক্ষিণে বিশাল মাঠে লাগানো লাল-সবুজ ফুলগুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে। হাওয়া এতটায় অল্প যে ফুলগুলোর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যেন গায়ে গায়ে ঢলে পড়তে পারছে না। প্রাকৃতিক এক বাধা তাদের বন্দি করে রেখেছে।

এলাকার দুশ একরজুড়ে শুধু নীরবতা। দুপুরের তপ্ত রোদে চারদিকে তাকালে দেখা যায় উপরে কয়েকটি শকুন চক্কর দিচ্ছে। চারদিকে কা কা ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। পিনপতন নীরবতায় সেই কাকের শব্দে বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে যায়। গুটিকয়েক লোকজন পাওয়া গেলেও চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। অনিশ্চয়তা আর অসহায়ত্ব ফুটে ওঠেছে কারো কারো মুখে।

মূল ভবনের বাইরে আগে সংসদের মন্ত্রী হোস্টেল নামে পরিচিত ভবনগুলো এখন বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সভাপতিদের কার্যালয়। কিন্তু সেখানেও কেউ নেই। সবগুলো কার্যালয় তালাবদ্ধ। ভবনটির সামনে সংসদে কর্মরতদের যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা সারি সারি বাস।

Advertisement

সংসদ ভবনের মনিপুরী পাড়ার দিকে ভবনগুলোতে এমপিদের কার্যালয়। এসব কার্যালয় সব সময় মুখর থাকে। এমপিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রতিদিন শত শত লোক আসেন। সেখানেও কাউকে পাওয়া গেল না। তবে সেখানে সংসদের ক্লিনিকে ডাক্তার দেখানোর জন্য পাওয়া গেল একজনকে।

সেখানকার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য মইজ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেশ কয়েকদিন ধরেই লোক আসা যাওয়া কম। আমারও এখানে বড় একা লাগে। কিন্তু কি করব, চাকরি তো করতে হবে।’

সংসদের মূল ভবনে প্রবেশের জন্য ট্যানেলে ঢোকার সময় শরীর কেমন ছম ছম করে ওঠে। নীরবতার সুযোগ নিয়ে দিনের বেলায় শত শত বাদুড় ওড়াওড়ি করছে। অথচ অন্য সময় সন্ধ্যা নেমে আসলে এসব বাদুড় বাইরে আসে।

মূল ভবনে ঢোকার সময় একজন শরীরের তাপমাত্রা মাপলেন। এরপর স্যানিটাইজার নিয়ে হাত পরিষ্কার করানো হলো। মেটাল ডিটেক্টরে গেলে বরাবরের মতো উল্টেপাল্টে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড দেখার বদলে ভয়ে কেউ হাতও দিল না। পরিচিত এক কর্মকর্তাকে কুশল বিনিময় করলেও কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। হয়তো মাস্ক থাকার কারণে শুনতেই পাননি তিনি।

সংসদ ভবনে ঢুকে পাওয়া গেল অন্য এক পরিবেশ। অধিকাংশ টেবিল ফাঁকা। প্রিয়, অপ্রিয়, চেনা অচেনাদের সঙ্গে হাত মেলানো আর কোলাকুলি তো কবেই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এখন কেউ কথাও বলেতে চাচ্ছেন না। বাইরে ঘোরাঘুরি করতে হয় বলে এই প্রতিবেদককে নিয়ে তারা আরও বেশি সতর্ক। তাই অস্বস্তির মাত্রাও বেড়ে যায়।

সংসদ ভবনের তৃতীয় তলায় এমপিদের জন্য আধুনিক সুবিধা সংবলিত দৃষ্টিনন্দন সংসদ সদস্য ক্যাফেটিয়া জনশূন্য। সংসদের নবম তলায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ক্যান্টিনের দুপুরের খাবারের জন্য দু-একজনের আনাগোনা। একজন দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। দুজন চা।

সেখাকার কর্মচারী মুমিন বলেন, ‘দুপুরে দু-একজন আসেন। তাও বেশির ভাগই চা চান।’

সেখানে নারীদের দিয়ে পরিচালনা করা জয়িতা ক্যাফেটেরিয়ার নুসরাত বলেন, ‘এখানে কাজ করা বেশির ভাগ লোকই দেশে চলে গেছে। দুদিন ধরে অর্ডার বন্ধই বলা যায়।’

তবে সংসদ ভবনের মসজিদে মাগরিবের সময় বেশ কয়েকজনকে পাওয়া যায়। সবাই নামাজ ছাড়াও দোয়া দরুদ পড়ার জন্য গেছেন।

সংসদের এক কর্মকর্তা (লেজিসলেটিভ ড্রাফ্টসম্যান) হাসিবুল ইসলাম বলেন, ‘সংসদের মসজিদে আমরা এখন ফরজ নামাজ পড়ি। অন্যগুলো নিজ নিজ অফিসে। মসজিদ নিয়মিত স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে।’

সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া জাগো নিউজকে বলেন. ‘১৯৮২ সালে এই সংসদ হওয়ার পর এমন নজিরবিহীন নিসঃঙ্গতায় পড়েনি। মাঝে মাঝে সেনা ও স্বৈরশাসনের সময় বদলে গিয়েছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক কোনো মহামারিতে সংসদের অবস্থা এই প্রথম। আশা করি তাড়াতাড়ি আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারব।’

এসএইচ/এমএসএইচ/এমএস