জাতীয়

যানজটের ঢাকা আজ মুখোশের নগরী

যানজটের নগরী খ্যাত ঢাকা এখন মুখোশের শহরে পরিণত হয়েছে। পাড়া-মহল্লার অলিগলি থেকে শুরু করে রাজপথ, ভিখারী থেকে কোটিপতি প্রায় সবার মুখে মুখোশ। রিকশা, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানগাড়ি, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের আরোহী ও চালক কমবেশি সবাই মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

Advertisement

সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করায় সব মিলিয়ে ১০ দিনের ছুটি পাওয়ায় রাজধানী ঢাকার হাজার হাজার বাসিন্দা আজ দিনভর বাস, ট্রেন ও লঞ্চযোগে ছুটেছেন গ্রামের বাড়িতে। তাদেরও অধিকাংশের মুখে ছিল মুখোশ। কেউ কেউ বাড়তি সতর্কতা হিসেবে হ্যান্ড গ্লাভস পরেছেন।

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে ধনী-গরিব নির্বিশেষে মুখোশের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে সুস্থ থাকতে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। হঠাৎ করে মুখোশ পরায় পরিচিত ঘনিষ্ঠজনকে অনেকে চিনতে পারছেন না। পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে যাওয়ার সময় কাশির আওয়াজে চমকে উঠছেন অনেকে।

জাগো নিউজের এ প্রতিবেদক আজ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে দেখেছেন, করোনা আতঙ্কে ভীত এক নগরীর চিত্র। সকালবেলা নিউমার্কেট থানা-সংলগ্ন নীলক্ষেত পেট্রলপাম্পের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশপথে বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অদূরে দুই ট্রাফিক সার্জেন্ট ও কনস্টেবলকে প্রায় জনশূন্য রাস্তায় মুখোশ পরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

Advertisement

ক্যাম্পাসে প্রবেশপথ বন্ধ কেন- জানতে চাইলে তিনি মুখোশ না সরিয়েই বলেন, কেউ বলছে বুয়েট ক্যাম্পাসে আবার কেউ বলছে ঢাবি ক্যাম্পাসে নাকি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ধরা পড়েছে। এ কারণে বাইরের লোকজনের প্রবেশ ঠেকাতে লকডাউন করা হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ বহির্বিভাগে প্রবেশ করতে দেখা যায়, মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিশেষ পোশাক পরে কয়েকজন (সম্ভবত চিকিৎসক-নার্স) বাইরে দাঁড়িয়ে নিচুস্বরে আলাপ করছেন। একটু এগোতেই চোখে পড়ল মুখোশ (মাস্ক) ও গ্লাভস বিক্রেতা। করোনা সংক্রমণের ভয় তারাও মুখোশ পরেছেন। প্রতিটি মুখোশ ৩০ টাকা ও গ্লাভস ১০ টাকা জোড়ায় বিক্রি করছেন।

বেচাকেনাও বেশ ভালো জানালেন জয়নাল নামের ওই বিক্রেতা। তিনি জানালেন, অন্য সময় বাদাম বিক্রি করেন কিন্তু করোনার কারণে মুখোশের চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় বাদাম বিক্রি ছেড়ে মুখোশ বিক্রিতে নেমেছেন।

বহির্বিভাগ ঘুরে দেখা গেল, অন্যান্য সময় বহির্বিভাগের বারান্দায় যেখানে রোগীর ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না সেখানে সুনসান নীরবতা। টিকিট বিক্রেতা একজনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা বিশেষ পোশাক পরে বসে থাকতে দেখা যায়।

Advertisement

তিনি জানান, অন্যান্য সময় প্রতিদিন ৩০০ রোগীর টিকিট বিক্রি হলেও আজ মাত্র ৫২টি বিক্রি করেছেন। এক ভদ্রলোক আনুমানিক ৪/৫ বছর বয়সী দুটি শিশুকে নিয়ে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালেন। তিনি নিজেও মুখোশ পরেছেন আর বাচ্চাদেরও মুখোশ পরিয়েছেন। শিশুরা বারবার মুখোশ খুলে ফেলার চেষ্টা করছেন আর শিশুর বাবা করোনাভাইরাস বলে নিজের হাতে মুখোশ পরিয়ে দিচ্ছেন সন্তানদের।

এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালের সামনে একটি রিকশায় দুজন যাত্রীকে মুখোশ পরে থাকতে দেখা গেল। রিকশাচালকের মুখে মুখোশ না থাকলেও তাকে গামছা দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখতে দেখা যায়। শাহবাগ মোড়ে বিভিন্ন রুটের বাসচালককে মুখোশ পরে দ্রুত গতিতে বাস চালাতে দেখা যায়। বাসে যাত্রী সংখ্যা কম থাকলেও প্রায় সবার মুখে মুখোশ।

ধানমন্ডি এলাকার একটি কনফেকশনারি দোকানের ভেতর প্রবেশ করতে দেখা গেল, ক্রেতা ও কনফেকশনারির কর্মচারীদের সবার মুখে মুখোশ। মুখ না খুলে আলাপন চলছে। ক্রেতা পণ্য নিয়ে মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করে কাউন্টারে দিতেই মধ্যবয়সী মালিকগোছের একজনকে উচ্চস্বরে পাশে দাঁড়ানো কর্মচারীকে ডেকে ‘এই বিলটা কত, রাখ তো’ বলে দূরে সরে যেতে দেখা যায়।

কলাবাগান মাঠের সামনে বাসস্টপে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। একটি মোটরসাইকেলে মুখোশ ও হেলমেট পরিহিত এক ব্যক্তি এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে ‘এই কেমন আছিস, মুখোশ পরিসনি কেন’ বলতে শোনা যায়।

ভদ্রলোক বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ডোন্ট মাইন্ড, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।’ এবার মোটরসাইকেল আরোহী হেলমেট ও মুখোশ খুলতেই ওই ভদ্রলোক জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললেন, ‘দোস্ত, কী লজ্জার বিষয়, হেলমেট মুখোশ আর রোদচশমা দেখে তোকে ঠিক চিনতে পারিনি। সব দোষ করোনার’, একথা বলেই দুজন হাসতে লাগলেন।

সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ব্যস্ত নগরী ঢাকার বিভিন্ন সড়কে গভীর রাতের নিস্তব্ধতা নেমে আসে। রাস্তাঘাটে স্বল্পসংখ্যক যাও বা লোকজন দেখা যায় তাদেরও করোনার ভয়ে মুখোশ লাগিয়ে চুপিসারে হেঁটে যেতে দেখা যায়।

এমইউ/বিএ