বড় খারাপ সময়ে চলে গেলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আমরা সবাই এখন নিজের জীবন নিয়ে আতঙ্কিত। জীবন বাঁচানোর তাগিদে সকলেই যখন নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছি, অবস্থান করতে হচ্ছে ঘরের ভেতর- সে সময় এই আমাদের সবার শ্রদ্ধার মানুষটি চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর সব থেকে খারাপ লাগে এই ভেবে যে ভিড় এড়ানোর কারণে তাঁর মরদেহের পাশে যেতে পারব না। আর তিনি যে মাপের মানুষ ওই মাপের জানাজা তাঁর হবে না। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তাঁর গুণগ্রাহীরা আসতে পারবেন না। সব থেকে বেশি খারাপ লাগল এই ভেবে ১৯৬৯, ’৭০ ও ’৭১ এর প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী হিসেবে যারা আমাদের শহীদ মিনারের রাজপুত্র ছিলেন তাদের অন্যতম বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের মরদেহ আমরা সকলে মিলে কাঁধে করে শহীদ মিনারে নিতে পারলাম না। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল গোলাম কুদ্দুসের মুখটি। তাঁর মন হয়তো আমার থেকে আরও খারাপ, কারণ তিনিই তো গত কয়েক বছর ধরে আমাদের অগ্রজ যারা চলে যাচ্ছেন তাঁদের মরদেহে শ্রদ্ধা জানানোর সব বিষয় শহীদ মিনারে আয়োজন করেন।
Advertisement
অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে স্টাডিরুমে বসে রইলাম। মনে পড়তে থাকে তাঁকে ঘিরে অনেক কথা। বিশেষ করে আমরা যেমন বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি তেমনি ইনফরমেশনও খুব কম রাখি। আমরা জানি না একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অবরুদ্ধ ঢাকায় বসে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর জীবনবাজি রেখে কীভাবে কাজ করেছিলেন। কবি বেগম সুফিয়া কামালের ডায়েরি পড়লে কিছুটা জানা যায় সে সময় বোরহানউদ্দিন খানের ভূমিকা। বিশেষ করে ওই সময় ঢাকায় সব থেকে বড় অপারেশন ছিল ঢাকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নষ্ট করে দেয়া। সমগ্র ঢাকা ব্ল্যাকআউট হয়ে গিয়েছিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের এই সাফল্যের খবর আমরা শরণার্থী শিবিরে বসে ভারতের কাগজে সেদিন পড়েছি। পরবর্তীতে আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে শুনেছি, ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের তরফ থেকে এমন কয়েকটা বড় আক্রমণ আমাদের যুদ্ধের জন্যে প্রয়োজন ছিল। আর তেমনি একটা আক্রমন ছিল ঢাকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নষ্ট করে দিয়ে ঢাকাকে ব্ল্যাকআউট করা। যা ঘটেছিল পাকিস্তানি সেনাদের নাকের ডগায়।
অন্য আরেকটি ঘটনা ছিল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে যমুনা নদীতে অস্ত্রবাহী বার্জ আগুন ধরিয়ে ডুবিয়ে দেয়া। ওই দুটি আক্রমণের খবর বিদেশি পত্র-পত্রিকায় বড় করে ছাপা হওয়ার পরই বিদেশিরা নড়েচড়ে বসে। তারা স্বীকার করে যে বাংলাদেশের ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করছে। তাদের সহযোগিতা করা প্রয়োজন। আর এর ফলে সহজ হয় প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরীর পক্ষে বিভিন্ন দেশের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সাহায্য চাওয়া, আর বিনামূল্যে অস্ত্র না পেলে অন্তত অস্ত্র কেনার পারমিশন পাওয়া।
Advertisement
আমাদের এই প্রজন্মের অনেকেই জানে না, ঢাকার ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র উড়িয়ে দেয়া, ক্যান্টনমেন্টে পানির লাইন উড়িয়ে দেয়ার কাজে সেদিন জীবনের সকল মায়া ত্যাগ করে কে সহযোগিতা করেছিলেন? বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিটি স্থাপনার ম্যাপ, সোয়ারেজ লাইনের ম্যাপ সেদিন পাকিস্তানি সেনা প্রহরার ভেতরে বসে জোগাড় করেছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। আর তিনিই সেটা পৌঁছে দেন মুজিবনগরে। আর সেই ম্যাপের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় বিদ্যুৎকেন্দ্র উড়িয়ে দেয়ার হামলার নকশাসহ ঢাকার অনেক গেরিলা হামলার নকশা।
বোরহানউদ্দিন খানের জীবদ্দশায় তাকে অনেকবার বলেছি, আপনি সেদিনের আপনার ওই দুঃসাহসী কাজের বিবরণগুলো নতুন প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে যান। তিনি হেসে বলতেন, নিজেকে প্রচার করতে নেই। তাঁকে বুঝাতে পারেনি, এটা আত্মপ্রচার নয়, এটা ইতিহাসের অংশ। আর তিনি আমাদের ইতিহাস স্রষ্টাদের একজন। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বসে নয় মাস এমন অনেক কাজই করেছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। তার সকল বর্ণনা লিখতে গেলে এ লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। কারণ এ লেখায় যদি তাঁর ১৯৭১ পরবর্তী জীবন ও তাঁর জীবনের অন্যদিকগুলো যদি না ছুঁয়ে যাই তাহলে অন্যায় হবে।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর দীর্ঘ ২১ বছরের চড়াই-উতরাই পার করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে। ৯৬ এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ফলে। আর সেদিন তাঁর নেতৃত্বে শুধু দেশের সাধারণ মানুষই জনতার মঞ্চে আসেননি, ১৯৭১ এর মতো দেশের সিভিল প্রশাসনও নেমে আসে শেখ হাসিনার সঙ্গে। আর সেদিন এই সিভিল প্রশাসনের নেতৃত্ব দেন মহিউদ্দিন খান আলমগীর। বড় ভাই হিসেবে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সেদিন মহিউদ্দিন খান আলমগীরের কতখানি পাশে ছিলেন আবার জনতার মঞ্চে কী ভূমিকা রেখেছিলেন সেটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের প্রগতিশীল শাসন ফিরে আসার ইতিহাসের কম কিছু নয়।
তারপর ১৯৭২ সাল থেকে মিডিয়া আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। আমরা সাংবাদিকতায় ঢুকেই বুঝতে পারি, কোনো এক অলিখিত শক্তি এমন একটি কাজ করে যেন মিডিয়া সবার পক্ষে যেতে পারবে, খালেদার ডার্লিং হতে পারবে, কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষে যেতে পারবে না। তাছাড়া মিডিয়াও অনেকে আওয়ামী লীগের সব ধরনের বিরোধিতা করাকে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা মনে করে। মিলিটারি শাসকরা এই মানসিকতা গড়ে দিয়েছে মিডিয়ার একটি শ্রেণির। মিডিয়াকে এখান থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য অন্তত একটাবার আওয়ামী লীগকে সমর্থন নয়, আওয়ামী লীগ সম্পর্কে সত্য বলার জন্য ১৯৯৬ সালে শাহ এ এস এম কিবরিয়া, আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম পরিচালক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও তখনকার তরুণ বুদ্ধিজীবী ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন প্রতিটি পত্রিকা অফিসে গিয়ে সম্পাদকদের কাছে যে আবেদন রেখেছিলেন। তাদের ওই কাজটি ছিল সেদিনের নির্বাচনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সম্পাদকদের সঙ্গে এই আলোচনাগুলোতে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের যুক্তি নিজে উপস্থিত থেকে শুনেছি। সে স্মৃতি মনে করে কেবল তাকে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না।
Advertisement
ওই সময় আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির অন্যতম স্তম্ভ গাজীউল হকের সঙ্গে বোরহানউদ্দিন খানের সম্পর্ক ছিল বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের। এই দুই ভাইকে আরও দেখেছি ১৯৯১ এর যুদ্ধাপরাধী বিচারের গণআদালতের সময়। গাজীউল হক যেমন অন্যতম উদ্যোক্তা ও বিচারক তেমনি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর অন্যতম সাক্ষী। ১৯৯৬ এর নির্বাচনের সময় আবার এই দুই ভাইকে দেখেছি চিন্তার বিনিময় করতে। গাজীউল হকের বন্ধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার আগে এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের আগে গাজীউল হক অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বা কিবরিয়া সাহেবের সঙ্গে। তাদের সেসব আলোচনা ও কাজ প্রকৃত ইতিহাস হয়তো আমরাও লিখে যাওয়ার সুযোগ পাব না। অথচ জাতির এগুলো জানা অনেক প্রয়োজন ছিল।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে গাজীউল হককে একদিন বলতে শুনেছি, বোরহান আমাদের কনিষ্ঠ ভাষাসৈনিক তবে বয়োজেষ্ঠ গল্পকার। বাস্তবে ১৭ বছর বয়সে লেখা তাঁর ‘অবিচ্ছিন্ন’ গল্পটি একটি পরিণত হাতের লেখা। আর গাজীউল হক সম্পর্কেও এ প্রজন্ম হয়তো জানে, তিনি শুধু ভাষাসৈনিক। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছিলেন কবি, গীতিকার, গল্পকার, প্রবন্ধ লেখক ও ইতিহাসবিদ এমনকি একজন ভালো গায়কও। আর তাঁর জ্ঞানের পরিধি মাপতে হলে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয় পড়াশোনার রাজ্যে। তাই সেই গাজীউল হক যখন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে ‘বয়োজেষ্ঠ’ গল্পকার বলেন তখন কারও বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় কোন মাপের গল্পকার তিনি ছিলেন।
এইটুকু জীবনের বিভিন্ন সময় সচিত্রসন্ধানী থেকে শুরু করে নানান প্রেস্টিজিয়াস পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বে থাকার ফলে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের অনেক গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ ছাপার সুযোগ হয়েছে জীবনে। তিনি কখনই খুব জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না। তবে কোনো মানসম্পন্ন পত্রিকা বের করতে গেলে তাঁর লেখা ছাড়া ওই পত্রিকা বের করার কথা চিন্তা করা যেত না, তাঁর জীবদ্দশায়। তাঁর লেখা পড়তে পড়তে বা প্রুফ দেখতে দেখতে বারবার একটি কথাই মনে হতো; আসলে উনি আমাদের মতো লেখকদের জন্যই লেখেন। তাই সাধারণ পাঠকের কাছে হয়তো অত জনপ্রিয় নন। আসলে যুগে যুগে সব ভাষায় কিছু লেখক থাকেন, যারা লেখকদের লেখক।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সেই লেখকই ছিলেন। তাঁর লেখা যেখানেই আমি ছেপেছি সবসময়ই নিজে প্রুফ দেখতাম। আমি সংশোধনী বিভাগের কোনো সাংবাদিককে খাটো করছি না, তবে সম্পাদনার দায়িত্বে থাকার ফলে সবসময়ই ভয় থাকত, পাছে ভুল না হয়ে যায়। কারণ ওনার প্রতিটি লেখায় কিছু না কিছু নতুন শব্দ থাকত। আমরা যারা লিখি বা আমাদের দেশের অনেক জনপ্রিয় লেখক কিন্তু আজীবন কয়েক হাজার শব্দের ভেতর ঘোরাফেরা করে সব লেখা লিখে গেছেন। কিন্তু বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর নানান ভাষা থেকে শব্দ এনে বাংলা শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। যে কাজে আমরা এ মুহূর্তের প্রায় সব বাঙালি লেখক ব্যর্থ হচ্ছি।
সর্বোপরি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি কত বড় মাপের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছিলেন তাও কিন্তু ওইভাবে প্রচারিত নয়, কারণ তিনি পপুলার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি সবসময় মধ্যযুগীয় বিশ্বাসকে দূরে রেখে, একটি উদার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং মানবিক মূল্যবোধ সর্বোপরি মানুষের চিন্তার দ্বার মুক্ত হবে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা চাইতেন। মানুষের আধুনিক ও গভীর চিন্তায় তাঁর বিশ্বাস ছিল বড় বেশি। তাই তার এই চলে যাওয়াতে বলা যায়, একজন শতভাগ আধুনিক চিন্তানায়ক আমাদের সমাজ থেকে চলে গেলেন।
মৃত্যুর কিছুদিন আগের থেকে তাঁর লেখালেখি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অসুস্থতার কারণে। তবুও মনে হত তিনি আছেন। আজ তাঁর চলে যাওয়াতে মনে হচ্ছে, অনেকখানি জায়গা ফাঁকা হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও মনে আসছে, তাঁকে আমরা যোগ্য সম্মান দিতে সমর্থ হয়েছিলাম কি তাঁর জীবদ্দশায়! যদি না পারি, তাহলে অন্তত মৃত্যুর পর যেন তাঁকে সম্মান করে যাই, তাঁকে চর্চা করে যাই। কারণ এ মুহূর্তে আমাদের সমাজে সব থেকে বেশি প্রয়োজন আধুনিক চেতনা জাগ্রত করা। আর এ জন্য বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে আমাদের চর্চা করতেই হবে।
এইচআর/বিএ/জেআইএম