আন্তর্জাতিক

২৩ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ, অবহেলায় মৃত্যুকূপ ইতালি

২০১৯ সালের শেষ দিন। নতুন বছরকে স্বাগত জানানো, অস্ট্রেলিয়ার দাবানল এসব নিয়েই মূলত ব্যস্ত ছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। এরমধ্যে একটি খবর ছিল যেটি তখন সেভাবে নজর কাড়তে পারেনি। সেটি ছিল চীনের উহান শহরে ২৭ জনের ভাইরাল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার তদন্তে নামছে চীনা কর্তৃপক্ষ। ৩১ ডিসেম্বরে রয়টার্সে প্রকাশিত খবরে বলা হয়- ওই নিউমোনিয়ার সাথে সার্স ভাইরাসের কোনো যোগ থাকতে পারে- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর ঘটনার তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

Advertisement

সেই নিউমোনিয়া যে সার্স ছিল না সেটি পরিষ্কার হয়েছে তার কয়েক দিন পরই। ঘটনার জন্য দায়ী ছিল করোনা গোত্রের নতুন এক ভাইরাস। ৩১ ডিসেম্বর চীনের খবর যখন গণমাধ্যমে আসে তখনও বলা হচ্ছিল সেখানে কারও মৃত্যু হয়নি। এরপর পরিস্থিতি বদলেছে দ্রুত। পৌনে ৩ মাসের মাথায় এসে ওই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন পৃথিবীর সাড়ে ৩ লাখের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ১৫ হাজার ২৭৪ জন।

এই ভাইরাসের উৎস চীনের উহান। বলা হচ্ছে সেখানকার একটি সামুদ্রিক মাছের বাজার থেকে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। চীনে এখনও পর্যন্ত এ ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ২৭০ জনের। চীনা সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে সেখানে এই ভাইরাসের ধকল কাটিয়ে ওঠার ইঙ্গিত মিলছে। তবে বিপদ এখন চেপে বসেছে ইউরোপে। আক্রান্তের সংখ্যায় ইতালি এখনও চীনকে ছাড়াতে না পারলেও ইতোমধ্যে মৃত্যুর সংখ্যায় ছাড়িয়ে গেছে। ইতালিতে মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ৪৭৬। ২৩ মার্চ পর্যন্ত চীনে মোট আক্রান্ত ৮১ হাজার ৯৩ জন। আর ইতালিতে ৫৯ হাজার ১৩৮ জন।

ধারণা করা যায় ডিসেম্বরের কোনো এক সময় চীনে প্রথম কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। আর ২৩ ফেব্রুয়ারি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়- করোনা ইতালিতে পা রাখে চীনা এক দম্পতির মাধ্যমে। ২৩ জানুয়ারি উহান থেকে ওই দম্পতি ইতালিতে পৌঁছান। ইতালিতে আক্রান্ত তৃতীয়জনও আক্রান্ত হন চীনে গিয়ে।

Advertisement

২৩ জানুয়ারি ওই দম্পতির চীনে পৌঁছানোর ঠিক এক মাস পর অর্থাৎ ২৩ ফেব্রুয়ারি বিবিসিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- ইউরোপে সবচেয়ে খারাপভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে ইতালিতে। তখনও, অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫২, মৃত্যু ৩ জনের। যেখানে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩ জনেই ৩ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত করেছে আইইডিসিআর। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রারম্ভিক হিসেবে বেশ ভয়াবহ একটা চিত্রের ইঙ্গিত মিলছে।

এক মাস আগে কী ব্যবস্থা নিচ্ছিল ইতালিকরোনা ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে ইতালিতে মৃত্যুর হার ৯ শতাংশের কিছু বেশি; ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনে যেখানে এ হার ৪ শতাংশের কিছু বেশি। প্রশ্ন উঠছে ইতালিতে মৃত্যুহার এত বেশি কেন? প্রাথমিক অবস্থায় পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় ইতালির কোনো গাফিলতি ছিল কি-না।

মাসখানেক আগের সংবাদগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যাচ্ছে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছিল ইতালি। ২৩ ফেব্রুয়ারি বিবিসির একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়- ভেনিস কার্নিভাল শেষ হচ্ছে নির্ধারিত সময়েই আগেই, মিলান এবং ভেনিসের কাছে যে দুটি অঞ্চলে করোনা আক্রান্ত রোগী বেশি ছিলেন সেখানে কঠিন কোয়ারেন্টাইন বিধিনিষেষ আরোপ করা হলো, দুই সপ্তাহের জন্য ৫০ হাজার মানুষের চলাফেরা অবরুদ্ধ করা হলো, অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান-স্কুল তাদের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দিল, ফুটবল লিগ সিরি আ'র ম্যাচ বাতিল হলো, মিলানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বন্ধ হলো।

বাংলাদেশে চলতি সপ্তাহের মতো ইতালিতেও তখন কেনাকাটার হিড়িক। এভাবে কেনাকাটার দৃশ্য ইতালিতে বিরল তা উঠে এসেছে বিবিসির ওই প্রতিবেদনে।

Advertisement

একই তারিখে সিএনএন তাদের প্রতিবেদনে বলছে, অন্তত ১০টি পৌরসভায় পাবলিক ইভেন্টে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয়েছে।

এত এত ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও এক মাস পর এসে ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে ইতালি।

অবহেলার স্পষ্ট প্রমাণপরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে ইতালিতে, তার অনুমানে যে অবহেলা ছিল তারও স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি এসে ইতালিতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫০, মৃতের সংখ্যা ১৭। এই সময়ে দেশটির ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা নিকোলা জিনগারেত্তি মিলান সফরে যান বেশ কজন ছাত্র নিয়ে। ওই পরিস্থিতিতে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি পোস্টে লেখেন- আমরা আমাদের অভ্যাস বদলাবো না। ভয়ের চেয়ে আমাদের অর্থনীতি বেশি শক্তিশালী। সবাই বাইরে বের হন, পিৎজা খান, কফি খান।

একইদিন মিলানের মেয়র বেপ্পে সালা একটি ভিডিও শেয়ার করে লেখেন- মিলানকে থামানো যায় না। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার চিত্র ফুটে ওঠে ওই ভিডিওতে। দেখা যায়- মানুষজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরছেন, রেস্তোরাঁয় খাচ্ছে, পার্কে হাঁটাহাটি করছে, স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে।

মিলান সফরের ৯ দিন পর ক্ষমতাসীন দলের ওই নেতা- জিনগারেত্তি নিজে ঘোষণা করেন তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ততদিনে দেশটিতে মোট আক্রান্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮৮৩, মৃতের সংখ্যা ২৩৩।

সঙ্কটের শুরুর দিকে ইতালির এসব প্রতিক্রিয়া থেকে অন্যান্য দেশগুলো শিক্ষা নিতে পারে- রোববার এমনটাই বলেছেন বরিস জনসন।

ইউনিভার্সিটি অব মিলানের একজন সামাজিক মনোবিদ জুসেপ্পে পান্তেলো বলছেন, প্রথমদিকে মানুষ আসলে বুঝতেই পারছিল না যে হচ্ছেটা কী, তাই জিনগারেত্তি ও তার মতো অন্যান্য রাজনীতিবিদরা মানুষকে স্রেফ আশ্বস্ত করে গেছেন। তিনি অবশ্যই বিপদের মাত্রা বুঝতে ভুল করেছিলেন।

সেখানকার চিকিৎসকদের মধ্যেও দ্বিমত ছিল ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে। কেউ কেউ এ ভাইরাসকে ভয়ের কারণ হিসেবে মনে করছিলেন, আর কেউ কেউ এটাকে আর ১০টা ফ্লুর চেয়ে সামান্য একটু শক্তিশালী ভাবছিলেন। বিপদ আঁচে অবহেলায় পিছিয়ে ছিলেন না সাধারণ মানুষও। একদিকে যখন দেশটিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছিল আরেকদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছিল করোনাকেন্দ্রীক হাসি-তামাশ।

মূলত ৮ মার্চের আগে ইতালির মানুষের জীবনযাত্রায় বর্তমান বিপদের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। ৮ মার্চ পরো লমবার্দি ও দেশটির উত্তরাঞ্চলের কিছু এলাকা কোয়ারেন্টাইনের ঘোষণা দেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জুসেপ্পে কন্তে। কন্তে এ ঘোষণা আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়ার কয়েক ঘন্টা আগে ব্যাপারটি গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। আর আগেভাগে এ খবর পেয়ে উত্তরাঞ্চলের হাজারো লোক দক্ষিণে দিকে পালিয়ে যায়। এরপর ১০ মার্চ লকডাউন ঘোষণা করা হয়। তারও পর বার, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি বন্ধ করা হয়। অনেক দেরিতে মানুষের মধ্যে পরিবর্তন দেখা যায়।

এসব বিষয়ে সারা রেইনেলি নামে এক মনোবিদ বলছেন, যখন থেকে রাজনৈতিক নেতাদের কথার সুর বদলেছে তখন থেকে মানুষ বদলেছে, সচেতনতা দেখাতে শুরু করেছে। তবে মৃত্যুকুপে দাঁড়িয়েও ৪০ হাজার ইতালিয় নাগরিককে জরিমানা করা হয়েছে কোয়ারেন্টাইন আইন ভঙ্গ করার জন্য।

কঠোর পদক্ষেপ নিতে ধীরগতি ছিল ইতালিতে। আর এতেই পরিস্থিতি গেছে নাগালের বাইরে। এখন কঠোর নানা পদক্ষেপের ঘোষণাও আসছে। তারপরও জগিংয়ের মতো কাছে মানুষের ঘর থেকে বরে হওয়া পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি আর লাশের সংখ্যা ৬ হাজার ছুতে বসেছে।

বিবিসি, সিএনএন ও গার্ডিয়ান অবলম্বনে।

এনএফ/এমআরএম