মতামত

আগামী ১৮ মাসে কী হতে পারে?

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনই নেয়া হলে সেটার স্থায়িত্ব কয়েক সপ্তাহব্যাপী থাকার কথা। এরপর এ রোগের এরকম ব্যাপক বিস্তার দেখতে পারার কথা নয়। আর পুরো ব্যাপারটাই হবে জাতি ও সমাজের কিছু মূল্য দিয়ে, তবে সেটা মাত্রা ছাড়িয়ে নয়। কিন্তু যদি আমরা এই অমূল্য সময়টাকে হেলায় হারাই তাহলে বহু প্রাণহানি ঘটবে, অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হবে গোটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং দেশের রাজনৈতিক অবস্থা। বহু লক্ষ লোকের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং তাদের অনেকেরই মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা উদ্ভব হবে এবং এর থেকে সম্পূর্ণভাবে উত্তরণ সম্ভব নাও হতে পারে। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই অনেকগুলো দেশের মনমানসিকতা : ‘এটা কোন ব্যাপারই নয়’ থেকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার মতো হয়েছে। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বেশকিছু দেশ রয়েছে যারা ঝুঁকির মধ্যে থেকেও খুব বেশি ব্যবস্থা নিতে পারছে না বা নিচ্ছে না। কিন্তু কেন? প্রতিটি দেশ একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে কীভাবে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এর উত্তরটি কিন্তু সার্বজনীন নয় এবং খুব সহজও নয়। আসুন আমরা গোড়া থেকে বেশকিছু দেশের উদাহরণ দেখার চেষ্টা করি এবং এর থেকে কোনো শিক্ষা নিতে পারি কিনা সেটা চেষ্টা করি।

Advertisement

বেশকিছু দেশ, যেমন ফ্রান্স স্পেন ইন ফিলিপাইন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে এবং সেটা কার্যকর করেছে। আবার বেশকিছু দেশ যেমন আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস কিছুদিন আগ পর্যন্ত ইউকে একটু মনে হচ্ছে ইতঃস্তত করছে এবং সোশ্যাল ডিস্টেন্স করাটাকেই যথেষ্ট মনে করছে কিংবা সেটাও ঠিকভাবে পালন করছে না। এই লেখায় আমরা অনেক তথ্য উপাত্ত মডেল উপস্থাপন করব এবং নিচের বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করব।

১. বর্তমান পরিস্থিতিটা আসলে কেমন২. আমাদের আসলে আর কি কি করার আছে৩. এখন আসলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কি (উত্তর: সময়)৪. করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে একটা খুব ভালো কর্মপদ্ধতি আসলে কেমন হওয়া উচিত৫. আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কীভাবে ভাবা উচিত

এই লেখাটি পড়ার পর আপনার যে বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা হবে তা হলো:

Advertisement

আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখনই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। প্রতিটা দেশের হাতে দুটি অপশন রয়েছে : খুব শক্তভাবে এর মোকাবেলা করা অথবা বড় আকারের মহামারি এবং প্রাণহানি মেনে নেওয়া। তারা যদি প্রাণহানিটা মেনে নেয় তাহলে সেই সংখ্যা কয়েক হাজার নয়, কয়েক লাখ পার হয়ে যাবে এবং শুধু করোনাভাইরাস নয় এরপর অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাটা আরো বেড়ে যাবে। কিন্তু আমরা যদি এখনই খুব শক্তভাবে প্রস্তুতি নেই, মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমিয়ে নিতে পারব। আমাদের ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে : আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। পৃথিবীতে আর কোনো বিষয় নিয়ে এত দ্রুত শিক্ষা নেয়ার নজির দেখা যায়নি। এবং আসলে আমাদের এটাই প্রয়োজন এখন কারণ আমরা এই ভাইরাস সম্পর্কে খুবই কম জানি। এত কিছু করার, এত কথা বলার একটাই কারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া : হাতে কিছু সময় যদি আরো পাওয়া যায়।

আমরা যদি খুব শক্ত ভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি তাহলে এই যুদ্ধ এর মাত্রা প্রথমে হবে খুব দ্রুত এবং তারপর ধীরে ধীরে কমে আসবে। সবচেয়ে ভালো যে ফলাফলটি হবে সেটা হচ্ছে মাত্র কয়েক সপ্তাহে আমরা এটা শেষ করতে পারবো, কয়েক মাস নয়। ধীরে ধীরে আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবো। যদিও দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। শুধু নিজেদের নয়, সারা পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থার কথা চিন্তা করে আমরা এটা করতে পারব।

আসুন দেখি কি করা যায় :

গোটা পরিস্থিতি টা কেমন?

Advertisement

চার্ট ১ : মার্চ ৪, ২০২০ পর্যন্ত দেশ প্রতি করোনা রোগীর সংখ্যা (চীন ছাড়া)

মার্চ ৪, ২০২০ পর্যন্ত আমি একটি কার্ভ থেকে আলোচনা শুরু করছি খেয়াল করুন, এই চিত্রে দেখানো হয়েছে চীন ছাড়া সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস এর প্রকোপটা কীভাবে বেড়েছে। বাকিদের সংখ্যা এতই কম যে চিত্র কেবল দক্ষিণ কোরিয়া ইতালি আর ইরান এই আলাদা ভাবে দেখা যাচ্ছে। আমরা নিচের অংশটা পরে আরো জুম করে দেখব অন্যান্য দেশের চিত্রটা আসলে কেমন। এই লেখার মূল বক্তব্য হচ্ছে শিগগিরই আমরা এই তিন দেশের কাতারে দাঁড়াতে যাচ্ছি।

চার্ট ২ : মার্চ ৪ এর পর দেশ প্রতি করোনা রোগীর সংখ্যা (চীন ছাড়া)

দ্বিতীয় চিত্রটি এবার খেয়াল করুন মার্চ ৮ তারিখের পর থেকে কারণগুলোর নাটকীয় উত্থান। যেমনটা ভাবা হয়েছিল আরও ডজনখানেক দেশে সংখ্যা ভীষণভাবে বেড়ে চলেছে। যেসব দেশে এক হাজারের বেশি রোগী পাওয়া গেছে কেবল তাদেরই এখানে দেখানো হয়েছে।

কতগুলো বিষয় লক্ষণীয় এখানে :

স্পেন জার্মানি ফ্রান্স আমেরিকা সবগুলো দেশেই রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। যে সময়ে কিনা ইতালিতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। আরো ১৬টি দেশে আজ চীনের হুবেই প্রদেশের থেকে বেশিসংখ্যক রোগীর কথা জানা গেছে এবং সেগুলোকেও লক ডাউন করে দেয়া হয়েছে। জাপান, মালয়েশিয়া, কানাডা, পর্তুগাল, অস্ট্রেলিয়া, চেচনিয়া, ব্রাজিল এবং কাতারে এক হাজারের বেশি রোগী পাওয়া যায়নি কিন্তু হুবেই প্রদেশ থেকে শতকরা হার এদের বেশি ছিল।

সুইজারল্যান্ড সুইডেন নরওয়ে অস্ট্রিয়া বেলজিয়াম নেদারল্যান্ডস এবং ডেনমার্ক সবার এক হাজারের বেশি রোগী ছিল। একটা অদ্ভুত ব্যাপার কি লক্ষ্য করতে পারছেন দেশের নাম গুলো দেখে? চীন এবং ইরানের কথা আলাদাভাবে কারণ এদেশে খুব ভয়াবহভাবে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে এবং বহু লোক আক্রান্ত এবং নিহত হয়েছেন। ব্রাজিল এবং মালয়েশিয়াসহ লিস্টের প্রত্যেকটি দেশ বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম!

আপনার মনে হচ্ছে ভাইরাস ধনী দেশের মানুষকে বেশি টার্গেট করে থাকে? নাকি ধনীদের গুলো ভালোভাবে ভাইরাসকে শনাক্ত করতে পারে।

এমনটা হওয়া খুবই অস্বাভাবিক যে গরিব রাষ্ট্রগুলোকে ভাইরাস এড়িয়ে চলে। গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়া ভাইরাস এজন্য খুব আদর্শ নয় কিন্তু এটা রোগ ছড়িয়ে পড়া কে ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তা না হলে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া এবং ব্রাজিলের এত রোগী পাওয়া যেত না।

সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে ব্যাখ্যাটি দেয়া যায় তা হচ্ছে এসব দেশে করোনাভাইরাস দেরিতে এসেছে কারণ তারা ব্যাপারটি দেরিতে শনাক্ত করেছে এবং তারা ভাইরাস শনাক্ত করার বিষয়ে ততটা সাবধানী ছিল না এবং অর্থ খরচ করেনি। ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন এটা সত্য যে বেশিরভাগ দেশ এই কর্মে ভাইরাসের মহামারী এড়াতে পারবে না। এটা কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার যখন তারা এই ভাইরাসকে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে দেখবে এবং ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।

অন্য দেশে আসলে কি ব্যবস্থা নিতে পারে?

আমাদের আসলে কি করার আছেচোখের সামনে অনেকগুলো উদাহরণ দেখার পর এখন কথা সুর বদলে গেছে প্রত্যেকটা দেশের। এখন কিছু উদাহরণ দেখি :স্পেন এবং ফ্রান্সের নেয়া পদক্ষেপস্পেন এবং ফ্রান্স সম্ভবত সবচেয়ে বড় উদাহরণ ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে।- মার্চ এর ১২ তারিখে স্পেনের প্রেসিডেন্ট এককথায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন যে তাদের বিশাল স্বাস্থ্যের ঝুঁকিকে ছোট করে দেখছে।- ১৩ তারিখে তারা স্টেট অফ ইমার্জেন্সি ঘোষণা করে।- ১৪ তারিখে তারা লকডাউন এ চলে যায় এবং নিচের ব্যবস্থাগুলো নেয় :

মানুষ ঘরের বাইরে বের হতে পারবে না খুব দরকার ছাড়া যেমন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা, পেশাগত, ফার্মেসি, হাসপাতাল, ব্যাংক কিংবা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি কিন্তু সেটার জুতসই কারণ থাকতে হবে।

বিশেষ করে বাচ্চাদের বাসার বাইরে নিয়ে যাওয়া হাঁটতে বের হওয়া বন্ধুদেরকে কিংবা পরিবার-পরিজনকে দেখতে যাওয়া ধরনের সকল কাজকে বন্ধ করতে বলা হয়েছে।তবে কারো যদি বিশেষ শারীরিক সাহায্যের প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম করা যাবে।

সকল রেস্টুরেন্ট ও বার গুলোকে বন্ধ করা হয়েছে শুধুমাত্র খাবার কিনে বাসায় নেওয়া যাবে বসে খাওয়া যাবে না।

বিনোদনের সব জায়গাগ বন্ধ করা হয়েছে যেমন খেলাধুলা সিনেমা দেখা মিউজিয়াম একত্রে লোকসমাগম ইত্যাদি। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান করা যাবে না। অনুষ্ঠান করলে কোন অতিথিকে একত্র করা যাবে না।কেউ মারা গেলে তার অন্তেষ্টিক্রিয়ার জন্য গুটিকতক লোক থাকতে পারে।পরিবহন ব্যবস্থা খোলা রাখা হয়েছে

১৬ তারিখে তারা সকল স্থলবন্দর এবং বর্ডার বন্ধ ঘোষণা করে।

এই উদাহরণ দেখে কেউ কেউ আছেন এর খুব প্রশংসা করেন, মনে করেন খুব ভালো কিছু পদক্ষেপ নেয়া নেয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ আছেন দুই হাত উপরে তুলে বলবেন আমাদের এটা করার উপায় নেই এবং সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে কান্নাকাটি করবেন।

আমরা দেখার চেষ্টা করি এই দুই ধরনের ক্ষেত্রে যেই দুই ধরনের ফলাফল পাওয়া যায় তাদের তুলনা কেমন।

ফ্রান্স খুব কাছাকাছি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল কিন্তু তারা একটু দেরি করে ফেলেছিল এবং এখন তারা আরও বেশি শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। ছোটখাটো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জন্য তারা বিদ্যুৎ পানি এসব বন্ধ করে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের নেয়া পদক্ষেপ

যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র এই দুটি দেশই সুইজারল্যান্ড কিংবা নেদারল্যান্ডসের মতো পদক্ষেপ নিতে বেশ দেরি করে ফেলেছেন। আসুন যুক্তরাষ্ট্রে নেয়া পদক্ষেপগুলো টাইমলাইন গুলো দেখি।

মার্চের ১১ তারিখে ট্রাভেল ব্যানমার্চের ১২ তারিখে জাতীয় ইমারজেন্সি ঘোষণা কিন্তু সোশ্যাল ডিসটেন্স এর কথা বলা হয়নি।মার্চের ১৫ তারিখ সরকারিভাবে জাতির উদ্দেশ্যে সোশ্যাল ডিসটেন্স এর কথা বলা হয়েছে কিন্তু এটা কিভাবে ইমপ্লিমেন্ট করা হবে তার কোনো দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি। যেমন রেস্টুরেন্ট, বার এবং যেসব জায়গায় দশ জন মানুষের বেশি একত্রে উপস্থিত হয় সেখানে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

এরপরে বিভিন্ন স্টেট নিজের থেকেই আরো কঠিন ঘোষণা দেয়া শুরু করে।

যুক্তরাজ্যে ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে অনেক উপদেশ দেয়া হয়েছে কিন্তু কঠিন কোনো ঘোষণা বা আদেশ দেয়া হয়নি। যেই দুই ধরনের দেশের কথা বললাম তাহলে কে দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে তাদের নেয়া পদক্ষেপের ভিন্নতার কারণে। মিটিগেশন অ্যান্ড সাপ্রেশন অর্থাৎ উপশম করা এবং হতে না দেয়া।

অপশন ১ : কোন কিছুই না করা

চলুন দেখে নেই যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশ যদি এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে।

চার্ট ৩ আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা, যদি কিছুই না করা হয়

আমরা যদি কিছুই না করি তাহলে সবাই রোগে আক্রান্ত হবে এবং আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এর উপরে ভীষণ চাপ পড়ে যাবে। মৃতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে এবং প্রায় ১০ মিলিয়ন লোক মারা যেতে পারে। দ্রুত বোঝার জন্য কিছু সংখ্যা দেখা যাক। যদি কিছুই না করা হয় এবং তাতে শতকরা ৭৫ জন আমেরিকান আক্রান্ত হয় এবং শতকরা চারজন আক্রান্ত রোগী মারা যায় তাহলে আমরা ১০ মিলিয়ন মৃত্যু দেখব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর ২৫ ভাগের এক ভাগ লোক মারা গেছে।

আপনি হয়তো বলবেন এটা এক মোটেই বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা না, আমি এরচেয়ে অনেক কম সংখ্যার কথা শুনেছি। তাহলে এই ধরনের কথা বলার মানেটা কী! এতগুলো সংখ্যা দেখার পরে কনফিউজড হয়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু কেবল দু’টি জিনিস মাথায় রাখলে বোঝা সহজ হয়। পুরো জনসংখ্যার শতকরা কত ভাগ আক্রান্ত হবে এবং আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা কতজন মারা যাবে। যদি শতকরা ২৫ জন অসুস্থ হয় (ভাইরাস শরীরে থাকলেই একজন মানুষ বিভিন্ন উপসর্গ দেখানো শুরু করবে এমন কোন কথা নেই সুতরাং কারো শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি কেই আক্রান্ত মানুষ হিসেবে ধরা হয় না) আর যদি মৃত্যুর হার ০.৬% হয়, ৪% এর বদলে, তাহলে হিসাব করে মৃতের সংখ্যা পাওয়া যাবে পাঁচ লাখ। তা অনেক কিন্তু আগের হিসেবে থেকে ২০ ভাগের এক ভাগ। সুতরাং আক্রান্ত ব্যক্তির মারা যাবার শতকরা হার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, এটি নিয়ে বিশদ আলোচনার দরকার রয়েছে।

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী কিভাবে মৃত্যুবরণ করে? Fatality রেট কিংবা মৃত্যুর হার আমরা কিভাবে বিবেচনা করব?

চার্ট ৪ : হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বনাম হাসপাতালের বিছানার সংখ্যা

গ্রাফটি আগের মতোই কিন্তু আমরা এখানে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিংবা মৃতের সংখ্যা বিবেচনা না করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া় লোকের সংখ্যা বিবেচনা করছি। আমেরিকায় যেসব লোকের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার হবে তাদের মধ্যে কিছু মানুষের নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন হবে এবং তাদেরকে আই সি ইউ ইউনিট এ ভর্তি হতে হবে। দেখতে পাচ্ছেন সর্বোচ্চ এর সংখ্যা ৩ মিলিয়ন হতে পারে। এবার চিন্তা করুন যুক্তরাষ্ট্রে কতগুলো নিবিড় পরিচর্যার বিছানা রয়েছে। এখন সেই সংখ্যাটি ৫০ হাজার কিন্তু একে দ্বিগুণ করা যেতে পারে যদি আমাদের হাসপাতালের জায়গাকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়।

যদি খুব অবাক হয়ে থাকেন তাহলে আবার নিশ্চিত করে বলছি, না এখানে কোনো ভুল করা হয়নি এভাবে যে লাল ডাকতে দেখতে পাচ্ছেন সেটাই আমাদের ক্যাপাসিটি আই সি ইউনিটের। এই লাল দাগের উপরে যেই অসুস্থ জনসংখ্যা থাকবে তারা সবাই নিবিড় পরিচর্যার দাবিদার কিন্তু তাদেরকে আমরা সেটা দিতে পারব না! আর তাতে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

এবার আইসিইউ ইউনিটের বিছানা সংখ্যার বদলে আপনি ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বিবেচনা করতে পারেন কিন্তু আপনার ফলাফল খুব ভিন্ন আসবেনা। গোটা আমেরিকাতে এক লক্ষ এর ও কম ভেন্টিলেটর রয়েছে।

আজকের হিসাব অনুযায়ী সিয়াটল শহরে এমন কমপক্ষে একটি হাসপাতাল রয়েছে যাদের ৬৫ বছর বয়সের উপরের রোগীকে ভেন্টিলেটর দেয়ার উপায় নেই কারণ রোগীর সংখ্যা এতই বেশি এবং শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে তারা মারা যাবেন। ঠিক এ কারণেই চীনের হুবেই প্রদেশের হঠাৎ করে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল এবং একই কারণে ইতালি এবং ইরানেও হঠাৎ করে অনেক লোকের মৃত্যু হয়েছিল।

হুবেই প্রদেশ শতকরার মৃত্যুর হার অনেক কমিয়ে আনা গেছে কারণ তারা প্রায় দু’দিনের মধ্যে দু’টি বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করে ফেলেছে শুধুমাত্র করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর জন্য। ইতালি এবং ইরানের সে ধরনের দক্ষতা ছিল না এবং অন্যান্য বেশিরভাগ দেশের ক্ষেত্রে এই কথা সত্য। আমরা নিকট ভবিষ্যতে দেখতে পাব আসলে অন্যান্য দেশের অবস্থা কেমন হয়। একটা প্রশ্ন রয়ে যায়, মৃত্যুর হার ৪% কেন?

যদি আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫ ভাগের নিবিড় পরিচর্যা দরকার পড়ে এবং আপনি সেটা যোগান দিতে না পারেন তাহলে তার সবাই মারা যাবে।সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যের নিরিখে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর অবস্থা চায়না থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করছে। যদিও এই তথ্যটি বিশদভাবে সমর্থিত নয় কিন্তু এটা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই কারণ ভাইরাস খুব দ্রুত চরিত্র বদলায়।

পারিপার্শ্বিক ক্ষতি (collateral damage)

এখন পর্যন্ত আমরা যে নম্বরগুলো দেখেছি সেগুলো কেবল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষের সংখ্যা বিবেচনা করছে। এবার চিন্তা করুন এই কারণে যদি পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয় তাহলে অন্যান্য যেসব রোগে মানুষ সহজেই সুস্থ হয়ে যেত সেগুলোতেও মারা যাওয়া শুরু করবে। মনে করুন আপনার হার্ট অ্যাটাক হলো খুব দ্রুত আপনার এম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা হবার কথা। কিন্তু সেই এম্বুলেন্স এল ৫০ মিনিট দেরিতে যেখানে ৫ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে আসার কথা।কারণ এত বেশি করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী যে তাদেরকে সেবা দিতে গিয়েই বেশিরভাগ এম্বুলেন্স ব্যস্ত। যদিও বা আপনি হাসপাতালে পৌঁছতে পারবেন কিন্তু সেখানে কোন আইসিইউর ইউনিট কিংবা ডাক্তার জন্য খালি নেই। মৃত্যুর সম্ভাবনা কি তাহলে অনেক বেড়ে যাবে না?

প্রতিবছর আমেরিকাতে ৪ মিলিয়ন রোগী আইসিইউতে ভর্তি হয় এবং তার মধ্যে অর্ধ মিলিয়ন মারা যায়। শতকরা হার মাত্র ১৩ ভাগ। কিন্তু আইসিইউ বেড যদি খালি না থাকে তাহলে সেই হার ৮০ ভাগের দিকে চলে যাবে। যদি ৮০ ভাগের জায়গায় ৫০ ভাগ মারা যায় তাতেও এক বছরব্যাপী একটি মহামারীর কারনে আপনি এই মহামারীর রোগটি ছাড়াও আরও দুই মিলিয়ন মৃত ব্যক্তি দেখতে পাবেন যারা অন্য রোগে মারা গেছে কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে তারা বেঁচে যেত। সুতরাং আপনি অর্ধ মিলিয়ন এর পরিবর্তে দুই মিলিয়ন মৃত্যু দেখতে পাবেন কেবলমাত্র পারিপার্শ্বিক ক্ষতি (collateral damage) এর কারণে!

যদি আমেরিকাতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে দেয়া হয় তাহলে এর চিকিৎসা ব্যবস্থা মুখ থুবরে পড়বে এবং কয়েক মিলিয়ন মৃত্যু আমরা দেখতে পাবো, হয়তোবা সেটা দশ মিলিয়নেরও বেশি।

একই ধরনের চিন্তা ভাবনা কিন্তু অন্যান্য দেশের জন্য সত্য।আইসিইউ বেড সংখ্যা, ভেন্টিলেটরের সংখ্যা, ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য সাপোর্ট এর পরিমাণ আমেরিকার মতই উন্নত দেশে। কোনো কোনো দেশে এর চেয়েও কম। অনিয়ন্ত্রিত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সেসব দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা কে একেবারে পঙ্গু করে দেবে এবং তাতে এই ভাইরাস ছাড়াও অন্যান্য রোগে প্রচুর মানুষ মারা যাবে।

মূল লেখা : টমাস পুয়ো, জনপ্রিয় ব্লগ মিডিয়াম থেকে অনুবাদ করা।অনুবাদ : ড. জাফরী আল ক্বাদরী, টেকনিক্যাল লিড, ইলেক্ট্রিক গাড়ি বিশেষজ্ঞ, জেনারেল মটরস।

এসএইচএস/এমএস