মেরাজের রাত পার করার পর সকাল বেলা। সবে মাত্র শেষ করলেন মেরাজের দীর্ঘ সফর। ক্লাত শরীর ও চিন্তামগ্ন মন নিয়ে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসে আছেন হাতিমে কাবায়।
Advertisement
মেরাজের তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনায় যেমন অভিভূত হচ্ছেন আবার এ স্বল্প সময়ে সংঘটিত এ বিশাল ঘটনা মক্কার অবিশ্বাসীরা বা নও মুসলিমরাই বা কিভাবে গ্রহণ করবেন এ নিয়ে একটু চিন্তিতও তিনি। তিনি ভাবছেন, মেরাজের এ মহান ঘটনার বর্ণনাই বা কীভাবে শুরু করবেন তিনি।
বিশ্বনবি ভাবছেন, রাতে সংঘটিত সংক্ষিপ্ত এ সময়ের মধ্যে মেরাজ ও ইসরার ঘটনা প্রকাশ করলে মানুষ আমাকে মিথ্যুক বলে অভিহিত করবে নাতো? কিন্তু এ বিশাল মুজিজার কথা প্রকাশ করার জন্য যে আমার আল্লাহই যথেষ্ট! তিনিই যে মহান পরিকল্পনাকারী! তাহলে আর চিন্তা কিসের?
সে সময় সকাল সকাল কুরাইশদের নেতা আবু জাহল হাতিকে কাবার পাশ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। সে দেখলো বিশ্বনবি কী যেন ভাবছেন। সে সঙ্গে সঙ্গে তার যাত্রা বিরতি কর বিশ্বনবির পাশে বসে পড়লেন। এ যে মহান আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।
Advertisement
বিশ্বনবির পাশ বসে আবু জাহল বিদ্রোপের ছলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো, নতুন কোনো ব্যাপার আছে নাকি? নতুন কোনো খবর বা ঘটনা আছে নাকি?
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ’। তোমাদের জন্য এক মহা ঘটনার সুসংবাদ আছে।সে (আবু জাহল) বলল কী সে ঘটনা?আল্লাহর মহা অনুগ্রহ যে, এবার বিশ্বনবি মেরাজের ঘটনা বর্ণনার সুযোগ পেয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আজ রাতে আমার মেরাজ হয়েছে।সে (আবু জাহল) বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাইল, তবে মেরাজে কতদূর পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল?প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত।এবার সে (আবু জাহল) আরও ঠাট্টা করে বলে উঠল, চমৎকার তো! এরপর রাতের মধ্যে সকাল হওয়ার আগেই তুমি আমাদের কাছে এসে গেলে?
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দৃঢ়তার বললেন, ‘হ্যাঁ’।আবু জাহল ভাবলো, এটাই সুযোগ! মুহাম্মাদকে আক্রমণ করার মহাসুযোগ। কথা না বাড়িয়ে তাঁকে সে বলল, আচ্ছা! আমি যদি পুরো কওমকে ডেকে নিয়ে আসি তাহলেও কি তুমি একই কথা বলতে পারবে?
মেরাজের ঘটনা প্রচারে এটাও বিশ্বনবির জন্য ছিল মহাসুযোগ। তাইতো তিনি আরও সুদৃঢ়তার সঙ্গে বলে ওঠলেন, 'হ্যাঁ' অবশ্যই। শ্বিনবির জন্য এটা ছিল দ্বীন প্রচারে মহান আল্লাহর একান্ত অনুগ্রহ।
Advertisement
আবু জাহল এ বিষয়টি বিশ্বনবিকে অপমান করার সুযোগ মনে 'লুয়াই ইবনে কা’ব গোত্রের নাম ধরে পুরো কাওমকে ডাকতে লাগল। আজু জাহলের ডাকে তারাও দলে দলে হাতিমে কাবায় এসে সমবেত হতে লাগল।
পুরো কাওমের লোকে এসে উপস্থিত হলে আবু জাহল বিশ্বনবিকে বলল, আমাকে মেরাজের যে কথা শুনিয়েছিলে, পারলে তা এদের কাছেও বলে দাও।
এ সুযোগে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত জনতার সামনে মেরাজে যাওয়ার তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করলেন। যা নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন।
বিশ্বনবির মুখে মেরাজের ঘটনা শুনে উপস্থিত সবাই আশ্চর্য হলো। তারা বিস্ময়ে হাতের ওপর হাত রাখল। অনেকে এ ঘটনায় হতবাক হয়ে মাথায় হাত রাখল।
এবার উপস্থিত লোকেরা এটাকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে বিশ্বনবিকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি যদি সত্যি সত্যিই বায়তুল মাকদিস (মেরাজে) যাও, তবে তুমি কি আমাদের বায়তুল মাকদিসের বর্ণনা দিতে পারব? সেখানে বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে জানা ব্যক্তি উপস্থিত ছিল।'
এটিই ছিল বিশ্বনবির মুজিজা। কেননা কোনো মানুষ যদি কোথাও বেড়াতে যায় তবে, সে স্থানের সব বিষয় গুণে গুণে মুখস্ত করে না বা তা জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। অথচ বিশ্বনবিকে তারা বায়তুল মাকদিসের অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে থাকে।
তারপরও বিশ্বনবি তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে। কিছু বিষয় বিশ্বনবির কাছে অস্পষ্ট মনে হচ্ছিল। আর তাতে তিনি মনে মনে খুব চিন্তিত হচ্ছিলেন।
বিশ্বনবি বললেন, আমি তখনও কাবার হাতিমে পুরো কওমের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি দেখতে পেলাম, পুরো বায়তুল মাকদিস আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠলো। উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা বায়তুল মাকদিস আমি নিজ চোখে দেখে দেখে নিঃসংকোচে তাদের প্রশ্নের উত্তর বলতে লাগলাম।
উপস্থিত লোকেরা বিশ্বনবির দেয়া বর্ণনা শুনে আশ্চর্যে হতবাক হয়ে যান। উপস্থিত লোকদের মন্তব্য হলো- বিশ্বনবির সব বর্ণনাই বায়তুল মাকদিসের মানচিত্র ও অবস্থার সঙ্গে পুরোপুরি সঠিক।
এ মুজেজা বিনা বাক্যে মেনে নেয়ায় হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু হলে 'সিদ্দিকে আকবার'। মুসতাদরেকে হাকেমে বর্ণিত হয়েছে সে ঘটনা। মক্কার কোনো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। মক্কার কাফেররা তাকে এ বিস্ময়ের কথা বলল। আর জানতে চাইল, তবুও কি তুমি তাকে বিশ্বাস করবে?
তাদের এ প্রশ্নেও হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর হৃদয়ে ঈমানের বহ্নিশিখা জ্বলে উঠল। তিনি বিশাল আকাশ পরিমাণ আস্থা নিয়ে দীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি তো এর চেয়েও আরো দূরের অনেক জটিল বিষয়েও তাঁকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে আসা আসমানি বার্তাসমূহের উপর রয়েছে আমার অটল বিশ্বাস ও সুদৃঢ় ঈমান। অতএব…(মুসতাদরাকে হাকেম)
উল্লেখ্য, বিশ্বনরি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ মেরাজ নিয়ে অবিশ্বাসীদের তর্কের শেষ নেই। কেননা মেরাজ সংঘটিত হওয়ার সময় আবু জেহলও ঠাট্টাছলে বিশ্বনবি বলেছিল, কী নতুন কোনো চিন্তা নিয়ে এসেছো নাকি? মেরাজের কথা শুনে কাওমের লোকদের একত্রিত করেও চেষ্টা করেছে বিশ্বনবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার। বরং উল্টো আবু জেহলসহ সবাই পরাস্ত হয়েছিল।তারা প্রিয় নবিকে প্রশ্ন করেছিল ‘ হে মোহাম্মদ! তুমি যদি বায়তুল মাকদিসে গিয়ে থাকো, তাহলে বলো বায়তুল মাকদিসের কয়টা সিঁড়ি? কয়টা দরজা-জানলা আছে? ইত্যাদি…।
এ বিষয়টি বলে রাখা প্রয়োজন...কোনো লোক কারও বাড়ি বেড়াতে গেলে সেখানের বাড়ি ঘরের দরজা, জানালা কিংবা সিড়ি ইত্যাদি গুণে দেখেন না। তাই এ সবই ছিল তাদের উদ্ভট প্রশ্ন। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের এসব উদ্ভট প্রশ্নেরও যথাযথ ও সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন।
বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেরাজের ঘটনা মক্কার হাতে গোনা কয়েকজন নব মুসলিমের জন্য কার্যকরী টনিক ও ঈমানি স্পৃহা বাড়ানোর অন্যতম উপাদেয়। যা বিশ্বনবির রিসালাতের সত্যতার অন্যতম মুজেজাও বটে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মেরাজের ঘটনায় বিশ্বাস স্থাপন করে নিজেদের আক্বিদা-বিশ্বাসকে শক্তিশালী করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/পিআর