তাহারে দেখিতে পাইয়া মোর তৃষ্ণার্ত কলিজাটি যেন প্রেমজলে ভিজিয়া গেল। প্রচেতা তাহার পড়ার টেবিলে মনোযোগ দিয়া পড়িতেছিল। আমি তাহার পড়ার টেবিল হইতে আট নচেৎ দশ ফুট দূরে ঘরের বাহিরে দরজার সামনে তাহার মাতার সহিত বাক্যালাপ করিতেছিলাম। তিনি অসংকৃৎ কহিতেছিলেন, ‘আয় রুদ্র ঘরের ভিতরে আয়, কিছু খেয়ে যা।’ কিছুক্ষণ পর প্রচেতার ছোট মাসি মুন্নি হাসিতে হাসিতে আমার সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। ‘কি রে রুদ্র, তুই সত্যিই বুঝি আমাদের ঘরে প্রবেশ করবি না? তোকে কান্তা দিদি কতই না বলিতেছে।’ ইহারা ব্যতীত সেদিন প্রচেতাদের ঘরে আর কাউকে দেখিতে পারি নাই। কান্তা এবং মুন্নি দিদি অকসর বলিয়াছে তাহাদিগের ঘরে একটু বসিতে—চা-নাস্তা খাইবার জন্য। কিন্তু আমি আমার প্রতিজ্ঞারক্ষে শাল গাছের মতন অটল ছিলাম। সেই ছোটবেলা থেকেই সব সময় আমি খুব ভেবে-চিন্তে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতাম—এবং একবার যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতাম স্বয়ং ব্রহ্মদেব হুকুম দিলেও সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিব তাহা ভাবিয়াই সিদ্ধান্ত নিতাম। কিছু কিছু মানুষ আছে ঘড়ির কাঁটার সাথে তাহারা নির্দ্বিধায় তাহাদিগের সিদ্ধান্ত বদলায়। কেন তাহারা এমন করিয়া তাহাদিগের সিদ্ধান্ত ক্ষণে ক্ষণে বদলাইতে থাকে—তাহা কখনো মোর বোধগম্য ছিল না। মানুষের সব সময় বুঝিয়া শুনিয়া যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আর একবার কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তাহাদিগের সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকা উচিত। কেননা তাহাদিগের সেই সিদ্ধান্ত যদি সঠিক হইয়া থাকে তাহলে তো বেশ ভালো—আর মন্দ হইলে সে সিদ্ধান্ত হইতে বহু কিছু শিখিবার থাকে। সিদ্ধান্ত নিলে মানুষ কখনো হারে না। বরং মানুষ তখনি জীবন যুদ্ধে হারিতে থাকে; যখনি তাহারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম হয় কিংবা বারবার তাহাদিগের সিদ্ধান্ত বদলাইতে থাকে।
Advertisement
তাই আমি পূর্বেই জানিতাম, যতই কান্তা ও মুন্নি দিদি আমাকে তাহাদিগের ঘরের ভিতরে বসিবার জন্য আমন্ত্রণ দিক না কেন আমি তাহাদিগের ঘরে প্রবেশ করিব না। মুন্নি দিদি কহিল, ‘একবার প্রবেশ করিলে কিচ্ছু হইবে না। আয় কিছু খেয়ে যা।’ আমি ভাবিলুম ইহারা আমারে এতবার ঘরের ভিতরে বসিবার জন্য কহিতেছে কিন্তু প্রচেতা আমাকে ঘরের ভিতরে বসিবার আমন্ত্রণ তো দূরের কথা একবার আমার দিকে তাকাইয়াও দেখিল না। মনটা একটু খারাপ হইয়া গেল। আবার ভাবিলাম—যতই আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল হই না কেন, প্রচেতা যদি একবার আমারে ঘরের ভিতরে বসিবার জন্য বলে। তাহলে তাহারে না বলিবার সাধ্য কি মোর আছে? আমি সর্প হইলে সে যে মোর সাপুড়ে—সে তাহার প্রেম বিন বাজালে আমিই বা না নাচিব কী করিয়া। তাই কিছুক্ষণ বাক্যালাপের পর একটি অজুহাত দেখাইয়া সেদিনের মত প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হইতে রক্ষে পাইলাম।
সাজুদের চায়ের দোকানে গেলাম—সেখানে বেশ কিছুক্ষণ ধরিয়া আড্ডা দিলাম। অতঃপর প্রদোষকালে আমাদের বাসায় ফিরলাম। বাসার সবাই আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল জানিয়া বেজায় খুশি। পিতাজি আমেরিকা হইতে ফোন করিল—কিন্তু তাহার কণ্ঠে খুশির আওয়াজটা শুনিলাম না। বুঝিতে পারিলাম আমার পরীক্ষার ফলাফল নিয়া তাহার মনে এক গভীর সন্দেহ বিরাজ করিতেছিল। ‘তুই ভালো করিয়া পরীক্ষার ফলাফল দেখেছিস?’ পিতাজি ফোনে কহিলেন। তিনি বিশ্বাস করিতে পারিলেন না যে আমি মাধ্যমিক পরীক্ষায় সত্যি সত্যি পাস করিয়াছি। তাহার কণ্ঠে সন্দেহ শুনিয়া নিজের প্রতি আস্থা আমার সেদিন অনেক কমিল। আবার ভাবিলাম—না কি আমি পরীক্ষার বোর্ডে ভুল দেখিয়াছি। সারারাত তাই আমার ঘুম হইল না। রাতেই ঠিক করিলাম পরের দিন আবার পরীক্ষার ফলাফল দেখিতে যাইব। কাছের মানুষ যখন আপন সক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ করে তাহার চাইতে বেশি ক্ষতি শরীর ও মনে নিয়মিত ধূমপান করিলেও হয় না। সেইদিনের সেই সন্দেহের ক্ষত আজও এই মনে কাঁকড়ার বিচ্ছিন্ন পায়ের মত আটকাইয়া আছে।
পরের দিন অরুণোদয়ে আবার পরীক্ষার ফলাফল দেখিতে প্রস্তুত হইলাম। পরীক্ষার ফলাফল স্কুলের বাহিরের বোর্ডটিতে লাগানো থাকে, যাতে যেকোনো সময়ে পরীক্ষার্থীরা আসিয়া তাহাদিগের ফলাফল জানিতে সক্ষম হয়। প্রাভাতিক তখন প্রায় দশটা বাজে। সাজুদের দোকানের বাহিরের বেঞ্চের উপরে আমি বসিয়া টাটকা গরম চা পান করিতে লাগিলাম। প্রচেতা তাহার বইয়ের ব্যাগটি কাঁধে নিয়া তাহাদিগের বাসার সম্মুখে যাচ্ছিল। বুঝিতে পারিলাম সে প্রাতঃকালীন প্রাইভেট পড়া পরিসমাপ্ত করিয়া তাহাদিগের বাসায় যাইতেছে। মোর কলিজার ভিতর হঠাৎ এক ভূমিকম্পনের মত হৃদয়ঙ্গম হইল—আর দেখিলাম কেমনে করিয়া আবার সে আমার পাণে একটি বারও না তাকাইয়া চলিয়া গেল। দয়া করে ফিরে দেখো আমি গগনতলেসমাহিত তব রূপে এ হৃদয় খুলিয়া তব অন্তর মন্দিরে পূজারী হবো বলেবকুল ফুলের মালা নিয়ে আছি বসিয়া।
Advertisement
কত বেলা গেল চলি মরি প্রেম তৃষ্ণায় কভু দেখো নাহি ফিরে একবার আমারে যদি মিটাতে পিপাসা সখি তুমি আমায়করিতাম সমর্পণ তব চরণে মোরে।
দেখিলো ধরণী মোরে বুঝিলো নিশিরাত্রিসবুজাভ মৃত্তিকার ঘাস কাঁদে শিহরে তুমি চলিলে একেলা চুপিচুপি পদ্মশ্রী অগ্নিদাহে দীর্ঘশ্বাস এ হৃদয় পাঁজরে।
একবার যদি তুমি বলিতে কি করিলেপাইব তোমারে আমি ভাসিব প্রেমজলেবকুলের মালাখানি দিতাম তব গলে।
সমাপিত কয়েক বছরে আমি শুধু তাহাকে ভালোবাসিয়া গেলাম—কিন্তু তাহাকে মনের কথাটি কভু বলিতে পারিলাম না। এত বছর অতিবাহিত হইল তাহার সাথে এখনো কোনো বাক্যালাপ পর্যন্ত হয়নি। আজ যদি ধরাধাম ত্যাগ করি সে কখনো জানিবে না যে, তাহারে আমি কত ভালোবাসিতাম। এই কথা ভাবিলে দুই চোখের অশ্রু সাগর স্রোত হইয়া লাফাইয়া পড়ে। তাহার সাথে অজস্রবার কথা বলিবার ইচ্ছে ছিল—তাহাকে এই মনের কথা বলিবার জন্য দিনেরাতে আধিক্য পরিকল্পনা যে করিয়াছি। কিন্তু যখন প্রেম প্রত্যাখানের কথা ভাবিতাম ঠিক তখনি বিড়ালের মত পিছু হটিতাম। যদি তাহারে মনের কথাটি বলিতাম এবং সে তাহা প্রত্যাখ্যান করিত তাহলে এই ধরায় শ্বাস বেশিক্ষণ নিতে পারিতাম না। তাই প্রচেতাকে ভালোবাসিবার লোলুপতায় তাহার সাথে কথা বলিতাম না। কারণ যতদিন বাঁচিতাম ততদিন তাহাকে ভালোবাসিয়া যাইতে পারিব। কিন্তু যাকে এত ভালোবাসি সে-ই যদি না জানিল তাহলে বুকের মধ্যে হুপিং কাশির মত একটি কষ্ট সর্বক্ষণ থাকিয়া যায়। শত চেষ্টায়ও সেই কষ্ট নিভানো যায় না।
Advertisement
অধুনা সেই কষ্ট সঙ্গে নিয়া মাধ্যমিকের ফলাফল জানিতে আমাদের গ্রামের স্কুলে পৌঁছলাম। পরীক্ষার ফলাফল ঠিক আগের মতই আছে। গতকল্যের ফলাফল দেখাতে আমার বিন্দুমাত্র ভুল ছিল না। অগত্যা শহরে ফিরিয়া বাসায় আসিলাম। এরপর মধ্যাহ্নভোজন শেষ করিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। একটু বিশ্রান্তি করিয়া সাজুসহ বিকেলবেলায় ক্রিকেট খেলিতে আমাদের বাসার পাশের স্কুলটির মাঠে অনুপ্রবেশ করিলাম। স্কুলের মাঠে পাড়ার সব ছেলে এসে উপস্থিত। এদের মধ্যে একজনকে আমি কিছুতেই চিনিলাম না। ছেলেটি বয়সে আমা হইতে বড় হইবে সেটা বুঝিতে পারিলাম—দেখিতে চিকন, ফর্সা তার গায়ের রং, এবং উচ্চতায় আমা হইতে একটু কম। তৎকালে সাজুকে জিজ্ঞেস করিলাম, ‘এই ছেলেটি কে রে?’ সাজু আমার দিকে অবাক হইয়া তাকাল। সে এমন-ভাবটি করিল যেন আমি এই ছেলে যুগ-যুগ ধরিয়া চিনিবার কথা। ‘কি রে কথা বলছিস না কেন?’ সাজুকে শাসালাম। সাজুর মুখমণ্ডল হইতে জীবদেহনিঃসৃত রস অদৃশ্য হইতে দেখিলাম। সে কহিল, ‘তোর শালা।’ এবার আমার মানসিক ধাত গরম হইয়া গেল আর সাজুকে বড্ড গালাগালি করিলাম। সাজু একটু শান্ত হইয়া কহিল, ‘উনি প্রচেতার বড় ভাই—সজল। তোর তো তাকে বহু আগে চিনিবার কথা।’ সাজুর কথা শুনিয়া একটু ভয় পাইলাম। প্রচেতার যে এক ভাই আছে সেটা আমি পূর্বে জানিতাম না। মনের ভিতর কত প্রশ্নই না জাগিল। এতদিন কোথায় ছিলেন এই সজল বাবু? আমিই বা উনাকে কেন চিনি না?
অকস্মাৎ ক্রিকেট খেলার উৎসাহটি হারিয়ে ফেললাম। পাড়ার সব ছেলেরা তৎকল্যে খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন দল ভাগ করিবার সময়। অদৃষ্টক্রমে সজল বাবু আমার দলে আসিয়া পড়িল। দেরি না করিয়া সজল বাবু আমার সাথে বাক্যালাপ শুরু করিল। নানা কথা জিজ্ঞেসও করিল। ভদ্রলোকটিকে বেশ বিচারশক্তিসম্পন্ন ও পরিনামদর্শী মনে হইল। উনার সহিত বাক্যালাপ করিতে আমি বেশ স্বাচ্ছন্দ্য-বোধ করলাম। যেহেতু উনি বয়সে আমার চেয়ে একটু বড় তাই উনাকে দাদা বলিয়া সম্বোধন করিলাম। কোনো এক অজ্ঞাত কারণবশত সজল দাদার আমাকে পছন্দ হইয়াছে। তিনি খেলার পাশাপাশি আমাকে বেশ কয়েকটি মুক্ত-উপদেশ দিয়েছেন। আমিও সজল দাদার উপদেশগুলো একাগ্রচিত্তে শুনিতে লাগিলাম। সেদিন আর আমার খেলাতে মনোযোগ ছিল না। সজল দাদার সাথে এত দ্রুত ভালো সম্পর্ক হইয়া যাইবে সেটা স্বপনেও কল্পনা করিতে পারিনি। খেলা শেষে সাজু, সজলদাদা, এবং আমি শহরের কলেজ-রোড দিয়া কোথায় যেন হাঁটিয়া যাইতেছি। তিন জন কত কথা বলিতেছিলাম—তবে আমি বেশিরভাগ তাহাদিগের কথা শুনিতেছিলাম। গোধূলিলগ্নে বেশ কিছু-দূর হাঁটিলাম। তখন আমার দু’পায়ে বেশ ব্যথা হইতেছিল কিন্তু আমি নিঃশব্দে তাহাদিগের সহিত হাঁটিতেছিলাম। প্রচেতার বড় ভাই বলে কথা—তাহার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখাই শ্রেয়।
তখনকার সময়ে প্রেম-ভালোবাসার নাম সমাজে এতটা গ্রহণযোগ্য বা প্রতিগ্রাহ্য ছিল না। কেউ যদি প্রেম করিত তখন তাহাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাজের লোক খারাপ ভাবিত। সেই যেই হোক না কেন। ভাগ্যিস শ্রী-কৃষ্ণ কলিযুগে আসেনি—তা না হইলে প্রেমের জন্য কলিযুগের মানুষ কখনো উনাকে ঈশ্বর ভাবিত না। এখনো কিছু ধর্মপ্রাণ হিন্দুধর্ম ব্যবসায়ীরা শ্রীকৃষ্ণের দ্বাপরযুগের প্রেম সম্পর্কে কিছু কহিতে চায় না। তাহারা ‘এসব ভগবানের লীলা’ বলিয়া শ্রীকৃষ্ণের রাধিকার সহিত প্রেমের বিষয়টি বর্ষাকালের গেছো ব্যাঙের মত লাফ দিয়া এড়াইয়া যায়। সজল দাদার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলিবার পর বুঝিতে পারিলাম যে তিনি একজন কৃষ্ণ-ভক্ত—কিন্তু তাই বলিয়া তিনি আমাদিগের প্রেম কভু মানিয়া নিবে তাহা বিশ্বাস করাটা ভুল হইবে। কারণ তখন আমি ছোট হইলেও বহু কৃষ্ণ-ভক্ত দেখিয়াছি, যাহাদিগের ‘প্রেম’ শব্দটি শুনিবার মাত্র সমগ্র শরীরে লোমগুলো ভালুকের মত দাঁড়াইয়া যেত। ইহারা বৈড়ালব্রতী। তাই সজল দাদার সাথে কথা বলিবার সময় টের পেলুম যে, যদি উনি কভু আমার প্রেমের কথা জানিতে পারে তাহলে লঙ্কাকাণ্ড হইতে পারে।
বহুদূর হাঁটিবার পর আমরা সাজুদের দোকানে আসিলাম। সামান্য নাস্তা করিতেছিলাম। যেহেতু এখন আমার পড়াশোনার চাপ নাই—তাই অনেকক্ষণ সময় সাজুদের দোকানে ব্যয় করিলাম। ‘তোর সাথে কথা বলিয়া ভালো লাগিলো রে রুদ্র।’ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সজল দাদা কহিল। কিছুক্ষণ পর সজল দাদা আবার কহিলেন, ‘রুদ্র, তুই আমাদের বাসায় সময় করিয়া একদিন আসবি।’ আমি উত্তরে কিছু বলিলাম না। শুধু হাসিয়া মাথাটি নাড়ালাম। রাত প্রায় দশটা বাজে। সজল দাদা বিদায় নিল। সজল দাদা যাইবার পরক্ষণে সাজু কহিল, ‘যা তোর তো সব ঠিক হইয়া গেল রে রুদ্র! একমাত্র শালা বাবু—সে তোকে বেশ পছন্দ করেছে। আবার তোর ভবিষ্যৎ শাশুড়ি মাতা ঐ দিন আমার বাবাকে কহিল যে রুদ্র ছেলেটি পাড়ার অন্য ছেলেদের চেয়ে ভালো।’ সে দিনটিতে বৃহস্পতি আমার তুঙ্গে ছিল—এবং ঐ দিন আমার প্রথমবারের মত মনে বিশ্বাস জেগেছিল যে, আমি নিশ্চয়ই একদিন প্রচেতাকে আমার জীবনে পাইবো। প্রচেতা একদিন আমার-ই হইবে।
সপ্তাহ-খানেক পর আমাদের বাসাতে শঙ্কর-দাদু আসিল। শঙ্কর-দাদু আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিল। শঙ্কর দাদুকে যখনই দেখিতাম, সঙ্গে সঙ্গে আমার মনটা কেন জানি ভালো হইয়া যাইত। ছোটবেলায় মূর্তির মধ্যে ঈশ্বর আছে সেটা পুরোপুরি বিশ্বাস নাহি করিলেও—এটা টের পেয়েছিলাম যে শঙ্কর দাদুর মধ্যে ঈশ্বর আছে। উনি ছিল পবিত্রতার প্রতিমূর্তি। উনাকে দেখিবার মাত্র শ্রদ্ধায় আমার মাথাটি নত হইয়া যাইত। উনার মত এমন মহাপুরুষ আমি পূর্বে কখনো দেখিনি। তিনি আবার জোতিষবিদ্যা জানিতেন—স্বল্প জোতিষবিদ্যা তিনি আমাকেও শিখিয়েছেন। পরের দিন সকাল বেলায় তিনি আমার হস্তরেখা দেখিবার পর কহিলেন—‘রুদ্র, জীবনে তুই অনেক কিছু করিতে পারবি। তোর অনেক নাম-যশ হইবে।’ আমি মনে মনে ভাবিলুম—‘যশ কৃতি দিয়া কি হইব দাদু, যদি তাহারে এই জীবনে না পাই। ইস, দাদু আপনি যদি আমার প্রেম জীবন সম্পর্কে কিছু বলিতেন।’ আমি ছোট মানুষ—দাদুকে এইসব জিজ্ঞেস করিবার বয়স তৎকালে হয়নি। তাছাড়া আমার হস্তরেখা বিশ্লেষণ করিবার সময় মাতাজিসহ অন্যরা সামনে ছিল। হস্তরেখা দেখা শেষ হইবার পর শঙ্কর দাদুকে প্রণাম করিয়া উনার কাছে আশীর্বাদ চাইলুম। দাদু হেসে দিল। বুঝিতে পারিলাম আজ দিনটি খুব ভালো যাইবে।
সকাল বেলায় মাতাজি বাজারের ব্যাগটি হাতে ধরিয়ে দিল—সাথে কলা-পাতার লম্বা একটি বাজারের তালিকা। বাসা হইতে বের হইলাম। পায়ে হাঁটিয়া প্রচেতাদের বাসার সামনে দিয়া যাচ্ছিলাম। ‘শুনেন—আপনাকে মা ডাকিতেছে।’ পিছন হইতে কে জানি স্বর্গ হইতে ধার করা কণ্ঠে ডাকিতেছিল। আমার মনে হইতেছিল এই কণ্ঠ আমি বহু বছর ধরিয়া শুনিয়া আসিতেছি। কী মধুর সেই কণ্ঠ—যেটা মোর এই হৃদয়ের গভীরে স্পর্শ করিল। সেই কণ্ঠ শুনিয়া মাত্র মোর চিত্ত বিনে বাজনায় করিল নৃত্য। বুঝিতে পারিলাম এই কণ্ঠ কোনো মানুষের হইবে না—নিশ্চয় কোনো স্বর্গীয় হইবে। কোকিল কণ্ঠের কথা বহু কবি ও লেখক বলিয়াছে, কিন্তু তাহারা কভু মোর প্রচেতার কণ্ঠ শুনিতে পায়নি। সে নহে মোটা কণ্ঠস্বর—নহে তাহার চিকন কণ্ঠস্বর। সেই সুমধুর কণ্ঠের নাম দিলাম নমোচিস্বর—ঠিক চার আঙুলের মতন তবে মাংশল মিশ্রিত কণ্ঠস্বর।
মাথা পিছনে ফিরিয়া দেখিলাম—প্রচেতা! সে আমাকে কিছু বলিল! নিজের কান দুটোকে একদম বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। ক্ষুধার্ত পালক কুকুর যেমন তাহার মালিকের দিকে তাকাইয়া থাকে—তেমনি প্রেম তৃষ্ণার্ত এই দুই চোখ তাহার পানে একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। আমার কিছু বলিবার সাধ্য ছিল না। প্রচেতাকে কভু এত কাছ হইতে দেখিনি। তাহার কপালটি যেন ঝিনুকের মতন—কিছুটা উঁচু তবে মসৃণ। তাহার কপালের উপর যখন বাতাসে কোঁকড়া চুলগুলো উড়িতেছিল—তখন তাহার কপাল ঠিক বাঁকা চাঁদের মতন দেখাইতেছিল। হাতের উপর স্বল্প-লোম যেন পৃথিবীর সর্ব স্পর্শ হইতে সুরক্ষা দিবার জন্য জন্মেছিল। চোখগুলো তাহার পটল চেরা—ভ্রু তাহার অর্জুনের তীরের মত যেন সে বিশ্ব-জয় করিতে জন্মিছিল। মসৃণ ও পাতলা ঠোঁট ও তাহার সবুজাভ জিহ্বা—বুঝিতে পারিলাম সে অম্লস্বাদের কিছু এইমাত্র খাইয়াছিল। পায়ের লম্বা আঙুলগুলো দেখিতে শিশুর পিছনের মত মসৃণ দেখাচ্ছিল। মুখমণ্ডলের বর্ণনা করিবার মত ভাষা হয়তো নেই—তবে তাহার মুখমণ্ডল দেখিলে যে কারো স্বর্গসুগের অনুভূতি হইবে।
প্রচেতা আবার কহিল, ‘আপনাকে মা কোনো কারণে ডাকিতেছে।’ এই বলিয়া সে তাহাদিগের বাসার দিকে হাঁটিতে লাগিল। তৎকালে আমার হুঁশ হইল। আমিও তাহার পিছনে পিছনে হাঁটিতেছিলাম। একটা নেশার ঘোরে ছিলাম। কান্তা দিদি তাহাদিগের বাসার দরজাটি খুলিল। তিনি কহিলেন, ‘কি রে রুদ্র, কেমন আছিস! তোর দাদা বাসায় নেই আবার সজলও বাসায় নাই। আমাদের একটু বাজার কিনে আনতে পারবি?’
চলবে...
এসইউ/এমকেএইচ